×

সাময়িকী

আড়ালের আলো রিজিয়া রহমান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০১৯, ০৭:০৮ পিএম

আড়ালের আলো রিজিয়া রহমান

বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনায় বসলে চল্লিশের দশক থেকে একবিংশের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত সময়ে আমরা নিশ্চয়ই সহ¯্রাধিক নামের একটা তালিকা পেয়ে যাবো। কিন্তু কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানকে নিয়ে আলোচনায় বসে আমরা যদি আলোচনাটাকে পঞ্চাশ-ষাট দশকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে আনি, তাহলে সে তালিকা নিশ্চয়ই অর্ধশতকের নিচে নেমে আসবে। তালিকাকে সংক্ষিপ্ত করে আনার আরো কিছু কৌশল যদি অবলম্বন করা যায়, হয়তো সে তালিকা দশ-বারোতে নামিয়ে আনাও কষ্টকর হবে না। সবাইকে পাশে রেখে যদি আমি রিজিয়া রহমান-এ সীমাবদ্ধ হতে চাই, তারও একটা কৌশল নিশ্চয়ই আছে; কিন্তু আমি কোনো কৌশল অবলম্বন না করেই আলোচনা রিজিয়া রহমানে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। বলতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে রিজিয়া রহমান একা যে কাজটি করেছেন নিষ্ঠায়-একাগ্রতায় আর মগ্নতায়; সেখানে তিনি অগ্রবর্তী পথিকৃৎ। বাংলা কথাসাহিত্যের এমন এক কৃতীশিল্পী তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁর জীবদ্দশায়, ভাবতেও নিজে নিজে লজ্জিত হতে হয়। যদি তাঁর সাহিত্য জীবনকে পঞ্চাশ বছরের ধরে নিই, তাহলে দেখবো সেই পঞ্চাশ বছরের পঁয়তাল্লিশ বছরই শৃঙ্খলের সীমাবদ্ধতায় কেটেছে; পাকিস্তানের একযুগ, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একুশ বছর এবং তারও পর আরো একযুগ; একুনে পঁয়তাল্লিশ বছরই হয়। তাঁর শৃঙ্খলের বাড়তি কারণ তিনি নারী, তিনি গৃহী এবং তিনি কর্মজীবী। আমাদের সমাজ নারীর অধিকারের পক্ষে গলাবাজি করলেও কার্যক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষে বিরোধিতাই করে। সব বাস্তবতা মিলিয়ে আমরা তাঁকে সম্মান দিতে ব্যর্থই হয়েছি। আমার কাছে এ লজ্জা নিবারণের কোনো আয়োজন তো নেই; তাই তাঁকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অগ্রবর্তী তিনজনের একজন ঘোষণা করে, তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে চাই।

আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান, যিনি আমাকে তাঁর রচনায় আকৃষ্ট করেছিলেন প্রথম যৌবনে এবং তাঁর গদ্যশৈলী আর গভীর যত্নে লেখা বেশকিছু উপন্যাস আমার হৃদয়ে মুগ্ধতার স্মৃতি সেঁটে দিয়েছিল, যে মুগ্ধতা আজো আমার চেতনায় অম্লান। আমার এ দীর্ঘকালীন মুগ্ধতাকেও আমি জীবনশিল্পী রিজিয়া রহমানের শিল্পকৃতির যোগ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই; যাপিত জীবনে বিভিন্ন লেখকের সহস্রাধিক উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা এবং সেসবের স্মৃতিসঞ্চয় ঘেঁটে সহজেই বলতে পারি, তাঁর রচনাশৈলীতে এমন এক শক্তি নিশ্চয়ই আছে, যে শক্তি তাঁর উপন্যাসের কথা মনে রাখতে বাধ্য করে। যদি নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘রিজিয়া রহমান-এর উপন্যাসের মতো আর কার উপন্যাসের কথা তোমার মনে আছে?’ উত্তর আসে, ‘না খুব বেশি নয়, অঙ্গুলিমেয় মাত্র কয়েকজন।’ নিজেকে করা প্রশ্ন এবং উত্তর থেকে আমি কি সহজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি না, রিজিয়া রহমান একজন প্রভাববিস্তারী দুর্লভ গোত্রের কথাশিল্পী? শিল্পীর প্রতি আমার এ আপ্লুত মুগ্ধতার কারণেও দায় অনুভব করছি প্রিয় শিল্পীর প্রয়াণে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে; পাশাপাশি এ কথাও অস্বীকার করছি না, তাঁর মতো অত বড় মাপের একজন জীবনশিল্পীর সাহিত্যকৃতি নিয়ে বিস্তারিত বলবার অধিকার বা যোগ্যতা আমার নেই। তবুও নিজের ভালো লাগার অনুষঙ্গকে পাঠকের চেতনায় চালানের উদ্যোগ গ্রহণ করা। ক্ষমা করবেন, কেউ আমার সাথে ঐকমত্য প্রকাশ না করতে চাইলে ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার তো থাকছেই।

বেলুচিস্তান বিদ্রোহের পটভূমিতে তিনি যখন রচনা করলেন উপন্যাস ‘শিলায় শিলায় আগুন’ (১৯৮০), পড়ে বিস্মিত হয়েছি; ভেবেছি, উপন্যাসটা লিখতে তাঁকে যেমন ইতিহাস ঘাঁটতে হয়েছে, তেমনি ঐতিহাসিক ঘটনাকে কাহিনীও করে তুলতে হয়েছে; পাশাপাশি পাঠোপযোগীও করে তুলতে হয়েছে উপন্যাসকে; কাজটা যে সহজ নয়, তা উপলব্ধি করে শ্রদ্ধায় আকৃষ্ট হয়েছি শিল্পীর প্রতি। ‘শিলায় শিলায় আগুন’ই কি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রথম গল্প? তা নয় তারও আগে আমার মা’র সংগ্রহ থেকে নিয়ে পড়া ‘ঘর ভাঙা ঘর’ পড়েও একবার আকৃষ্ট হয়েছিলাম। নীলচাষ আর বিদ্রোহের পটভূমিতে খুলনা অঞ্চলের আমজনতার প্রতিনিধি রহিমউল্লাহর বোধোদয় আর চেতনার উন্মেষে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার ডাকে সোচ্চার হওয়ার বীরগাথা লিখলেন তাঁর ‘অলিখিত উপাখ্যান’ (১৯৮০) উপন্যাসে, তখন আমার চেতনায় রিজিয়া রহমান জন্ম দিলেন এক নায়কের স্বপ্ন। গল্প-উপন্যাস পড়ে এভাবে নায়ক হওয়ার স্বপ্নই বা জীবনে ক’বার দেখেছি? সে-ও তো অঙ্গুলিমেয়। অন্য সব স্বপ্ন মনে করতে গিয়ে কিছুতেই বিষয় থেকে বিচ্যুত হতে চাই না, আমি রিজিয়া রহমানেই স্থির থাকতে চাই। যখন ইতিহাস আর ঐতিহ্য খুঁড়ে তিনি যত্নে তুলে আনলেন লুপ্তপ্রায় উপাখ্যান ‘বং থেকে বাংলা’ (১৯৭৮) উপন্যাসে, তিনি যেন প্রত্ন -গবেষক হয়ে উঠলেন; সে উপন্যাস পড়ে আমি চমৎকৃত হলাম। সামান্য মনোযোগ দিলেই দেখবো ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের ব্যাপ্তিতে তিনি কী যত্নে বুনন করতে চেয়েছেন বাঙালি সমাজের সারল্য, আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতি আর বাঙালির জাতি গঠন এবং ভাষা-বিবর্তনের ইতিহাস। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ‘বং’ গোত্র থেকে তিনি তাঁর যাত্রা শুরু করে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরব ছুঁয়ে বিজয় অর্জন পর্যন্ত উপন্যাসের ব্যাপ্তি দিয়েছেন; ‘বং থেকে বাংলা’ পড়ে পুনর্বার উপলব্ধি করেছি, বঙ্গদেশের সাধারণ মানুষ যুগ যুগ ধরে কীভাবে অবহেলা, নির্যাতন এবং উপেক্ষার শিকার হয়েছে। যে বাঙালি সহ¯্র বছর ধরে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত, যে বাঙালি কখনো অর্থনৈতিক মুক্তির কথা কল্পনাও করেনি, গণতান্ত্রিক মুক্তির তো প্রশ্নই আসেনি; সেই বাঙালির চেতনায়, সেই পশ্চাৎপদ বাঙালির মননে কীভাবে স্বশাসিত হওয়ার স্বপ্ন পল্লবিত হলো এবং কোন শক্তিতে বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মর্যাদায় পৌঁছাতে পারলো, তারই ভাষাচিত্র যেন তাঁর ‘বং থেকে বাংলা’। আমরা লক্ষ করেছি বিস্তৃত ক্যানভাসের এ উপন্যাস লিখতে গিয়ে যৌক্তিক কারণেই তিনি নাতিদীর্ঘ একটা ভূমিকা লিখেছেন। আমার মনে হয়েছে, উপন্যাসটি পড়ার আগে ভূমিকাটি পড়ে নেয়া জরুরি। আসুন আমরা বরং তাঁর ভূমিকা থেকে সামান্য পাঠ করি।

“.....বাংলাদেশে অস্ট্রো-এশিয়াটিকের একটি শাখা ছিল স্থলের অধিবাসী এবং আরেকটি শাখা নৌকায় বসবাস করে আসছে। এরাই ‘বেদে’ বা বাইদ্যা। আর্যরা উত্তর ভারতে প্রবেশ করলে তাদের সঙ্গে সংঘাতে পরাজিত হতে হতে দ্রাবিড় জাতি ক্রমশ দক্ষিণ ভারতের পর্বতসংকুল অঞ্চলে সরে আসে। দ্রাবিড়দের একটি শাখা চলে আসে সমতটে। এই দ্রাবিড়-গোত্রটি বং গোত্র বলে অনুমান করা হয়। অনেকে মনে করেন দ্রাবিড় বং গোত্রের নাম থেকেই ‘বঙ্গ’ ‘বঙ্গদেশ’ ও ‘বংআল’ নামের উৎপত্তি।....

বঙ্গদেশ যা কিছুদিন আগে পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ নামে পরিচিত ছিল, নদীর ভাঙাগড়ায় ও বারবার গতি পরিবর্তনের ফলে তার ভৌগোলিক সীমানাও বহুবার পরিবর্তিত হয়। তবে তৎকালীন বঙ্গ বলতে বাংলার এই পলি নির্মিত বদ্বীপ অঞ্চল এবং কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের সংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে গঠিত অংশ বোঝাত। রাঢ় এবং বরেন্দ্র ভূমি ছিল নদীর সীমানা দ্বারা বিভক্ত। রাঢ় এবং বরেন্দ্র পুন্ড্রর্ধনের নামানুসারে যে অংশকে পুন্ড্র মনে করা হতো, এ অঞ্চলগুলো অপেক্ষাকৃত উচ্চ ও শুষ্কভূমি ছিল বলে এখানে সহজেই আর্যরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

সমুদ্রগুপ্তের সময়ে বঙ্গদেশ গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত করদ রাজ্যে পরিণত হয়। কিন্তু এর বেশ কিছু আগে থেকেই এ দেশে আর্যবসতি গড়ে উঠতে থাকে। পাল এবং সেন রাজাদের দীর্ঘ রাজত্বকালে বাংলাদেশে অনার্য, দ্রাবিড় ও আর্য সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটে।....

পলি নির্মিত সমতট বঙ্গ পরে বঙ্গাল, মোগল আমলে সুবা-ই-বঙ্গাল থেকে ইংরেজ আমলে বেঙ্গল অবশেষে বাংলাদেশ নামে ভাস্বর হয়ে ওঠে। এ দেশের অধিবাসীরা পরিচিত হয় বাঙালি বা বাংলাদেশি নামে। মনে করলে বোধহয় ভুল হবে না ‘বংগাল’ বা ‘বাঙাল’ শব্দই হচ্ছে বাঙালি নামের প্রাথমিক উচ্চারণ... বাংলাদেশের জাতি গঠন ও ভাষার বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসের সৃষ্টি। তবে এর মূল কথা অন্য। আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু করে উনিশশ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কাল পর্যন্ত দীর্ঘ পরিব্যাপ্তির মধ্যে এ উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাস করা হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের বিভিন্ন যুগ থেকে বিভিন্ন ঘটনা গ্রহণ করে বিধৃত করা হলেও একটি মূল কথায় এসে এর সমাপ্তি ঘটান হয়েছে। বাংলার সিংহাসন চিরকাল বিদেশি ক্ষমতালিপ্সু এবং সম্পদলোভীর দ্বারা শাসিত হয়েছে। কিন্তু জনগণ থেকে তারা ছিল বিচ্ছিন্ন। বাংলার সাধারণ মানুষ চিরকালই ছিল অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং উৎপীড়িত।”

(বং থেকে বাংলা ॥ রিজিয়া রহমান ॥ মুক্তধারা ॥ ২য় প্রকাশ ১৯৮৫ ॥ ভূমিকা) বিশাল ক্যানভাসের পটভূমিতে রচিত এ উপন্যাসে আমাদের ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি কিন্তু তিনি খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপন করেছেন। এর কারণ হিসেবে ধরে নিতে পারি, উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৮-এ, আর দ্বিতীয় মুদ্রণ হয় ১৯৮৫তে; ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস উচ্চারণ দুরূহ ছিল বলেই কি তিনি অব্যক্ত যৌক্তিক কারণে এ সংরক্ষণবাদিতায় আশ্রয় নিয়েছেন? তাই কি তিনি তাঁর ভূমিকায় সচেতনভাবে ‘বাঙালি’ শব্দের পাশাপাশি ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন? তাই কি তিনি ভূমিকার শেষাংশে কৌশল করে বলেন, ‘তা ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের অধ্যায়টিকেও আমাকে মূল পাণ্ডুলিপি থেকে সংক্ষিপ্ত এবং সংযত আকারে আনতে হয়েছে। এর জন্য আমি নিরুপায়ভাবে পাঠকের কাছে ক্ষমা প্রার্থী।’ জিজ্ঞাসু একজন পাঠক হিসেবে আমাদের কিন্তু আগ্রহ থেকেই যায়, লেখকের মূল পা-ুলিপিতে কী ছিল?

একজন নারী হয়ে যখন তিনি সমাজে অস্পৃশ্য-অবহেলিত-নিগৃহীত শ্রেণি, নিষিদ্ধপল্লীর দেহপসারিণীদের মানবেতর জীবনের ব্যথা, দৈনন্দিন জীবনের কার্যপ্রণালী আর নিত্যদিনের ঘটনাবলিকে আশ্রয় করে লিখলেন ‘রক্তের অক্ষর’ (১৯৭৮); তখন একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠক এবং একজন সাহিত্যকর্মী হিসেবে নিজের অক্ষমতাকে চিহ্নিত করার দিশা পেয়েছিলাম। কারণ তাঁর উপন্যাস পড়ে আমার মনে এ প্রতীতি জন্মেছিল ‘রক্তের অক্ষর’ নাটক-সিনেমা বা শোনা গল্পের আশ্রয়ে লেখা নয় বরং জীবনঘনিষ্ঠ রচনা; কী করে তিনি পারলেন! নিষিদ্ধপল্লীর জীবন পাঠের সুযোগ কোথায় তাঁর? কিন্তু তিনি পেরেছেন। আবার যখন রিজিয়া রহমান ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এক পরিশ্রমী শ্রমিক, যিনি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে কাজ করতেন, তারই সংগ্রামী জীবনচিত্র চিত্রিত করেন তাঁর ‘একাল চিরকাল’ (১৯৮৪) উপন্যাসে, অথবা ঢাকার অতীত-বর্তমান আর মহানাগরিক জীবনযাপনের আত্মজৈবনিক চিত্র আঁকলেন ‘প্রাচীন নগরীতে যাত্রা’ উপন্যাসে, কিংবা বিলুপ্ত মসলিন শিল্পের তাঁতিদের বঞ্চনা আর অতৃপ্তি নিয়ে লিখলেন ‘আবে রঁওয়ার কথা’, অথবা বঙ্গদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় সমুদ্র এলাকার দুর্র্ধর্ষ-হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্ব এবং দস্যুতার চিত্র তুলে ধরতে লিখেছেন- ‘উত্তর পুরুষ’ (১৯৭৭) উপন্যাস; যাতে বাক্সময় হয়েছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার; চিত্রিত হয়েছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বগাথা, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস। তখন তাঁকে কেবল অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী একজন কথাশিল্পী বলে থামতে পারি না; বরং রিজিয়া রহমানকে একজন দেশপ্রেমী-আত্মসচেতন দায়বদ্ধ কথাশিল্পী হিসেবে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়। তবে স্বীকার করতে বাধা নেই, আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রক্রিয়া নিয়ে কতটা আত্মতৃপ্তি পেতে পারি, তা নিয়ে আমার মতো অনেকের মনেই সংশয় আছে।

রিজিয়া রহমান ২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার ভবানীপুরে। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পরিবারের সাথে চলে আসেন বাংলাদেশে। ষাটের দশকের প্রথম থেকে ছয় দশকের অধিক সময় ধরে লিখে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০১৯-এর ১৬ আগস্ট ঢাকা মহানগরীর উত্তরার নিজ বাসভবনে ৮০ বছর বয়সে প্রয়াত হন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠ অধ্যাপক। সজ্জন-সুহৃদ বলে যেমন তাঁর সুখ্যাতি ছিল, তেমনি ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক-নিভৃতচারী।

সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর নিবেদন ঈর্ষণীয়। রিজিয়া রহমানের ভাষাশৈলীর সামর্থ্য জানতে আমি এখানে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি- ‘বঙ্গোপসাগর থেকে উড়ে এসেছে বৃষ্টির ঝাপটা নিয়ে কালো মেঘ। ফুলে-ফেঁপে উঠেছে খাল বিল নদী হাওর। সেই সময়েই একদিন বঙ্গআলদের সামন্তসেনার ছিপ নৌকার জলযুদ্ধ বাহিনী গাঙে ভাসল। ঘিরে ফেলল নতুন আলোর সীমানা। বৃষ্টির ফলার মতো বর্ষিত হতে লাগল তীরের ঝাঁক।’ (বং থেকে বাংলা ॥ রিজিয়া রহমান ॥ মুক্তধারা ॥ ২য় প্রকাশ ১৯৮৫ ॥ পৃষ্ঠা-৪৫)

এমনি অসাধারণ বাক্যবিন্যাস আমাদের মুগ্ধ করে বারবার। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে অগ্নিস্বাক্ষরা (১৯৬৭), ঘর ভাঙা ঘর (১৯৭৪), অরণ্যের কাছে (১৯৭৯), সূর্য-সবুজ-রক্ত (১৯৮১), ধবল জ্যোৎস্না (১৯৮১), হে মানব মানবী (১৯৮৯), হারুন ফেরেনি (১৯৯৪), নদী নিরবধি (আত্মজৈবনিক), পবিত্র নারীরা, সীতা পাহাড়ে আগুন, ভালবাসা দাও, মানুষের জন্য, প্রেম আমার প্রেম, একটি ফুলের জন্য, বাঘবন্দি ইত্যাদি। উপরের গ্রন্থগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’, ‘ভালবাসা দাও’ এবং ‘মানুষের জন্য’-এ তিনটিই গল্পসংকলন, অন্য সব উপন্যাস। এ ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত গল্প (১৯৭৮), স্বনির্বাচিত গল্প, প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আমার ভাবনা’, কাব্য ‘অন্ধ প্রজা’ এবং অনুবাদ ‘সোনালী গরাদ’ (১৯৯৫)। স্মরণ করতে পারি ২০১৭-তে চন্দন আনোয়ার-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘গল্পকথা’ রিজিয়া রহমান সংখ্যা; এক মলাটে রিজিয়া রহমানকে জানার জন্য সংখ্যাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি লাভ করেছেন সত্যি; কিন্তু তাঁর উচ্চতায় যতটা তাঁর পাওয়া সঙ্গত, তা পেয়েছেন কি? এসব দেখে প্রশ্ন জাগে, যাঁরা পুরস্কার-স্বীকৃতি-পদক প্রদানের দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের কাছে কি মেধা-মনীষা-কৃতী-নিষ্ঠা-নিবেদন-যোগ্যতার কোনোই মূল্য নেই? কেবলই স্বার্থ, কেবলই স্তুতি-স্তাবকতা, কেবলই আনুগত্য চাই?

আমেরিকান লেখক ক্লিনটন বি সিলি, যিনি জীবনানন্দ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাদের সমীহ কুড়িয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ ছাড়াও বাংলাদেশের রিজিয়া রহমানকে নিয়ে কাজ করেছিলেন সিলি। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে ক্লিনটন বি সিলির শেষ গ্রন্থে তিনি রিজিয়া রহমানের সাহিত্যকে সিরিয়াস সাহিত্য উল্লেখ করে গদ্য লেখেন। সিলির লেখাটি পড়ে, আমাদের কারো কারো হয়তো বোধোদয় হয়েছে; বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমানকে আমেরিকান লেখক ক্লিনটন বি সিলি আবিষ্কার করলেও আমরা পারিনি। এ কথা সত্য অত বড় মাপের লেখক হবার পরও রিজিয়া রহমান একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বড় পুরস্কার পাননি, অথবা জীবনের শেষ দিনগুলোতে খুব বেশি আলোচনায় আসেননি, মঞ্চ আলো করে বসেননি, কিংবা তাঁকে নিয়ে সে অর্থে খুব বেশি হৈচৈও হয়নি। এর কারণ অবশ্য আমার বিবেচনায় অবহেলা নয়; বরং পাদপ্রদীপের আলোয় যাঁরা আছেন বিভিন্ন কারণে, যাঁরা মধুভাণ্ডের পিছনে ছুটতে পারেন, মধুভা-ের মোহে স্তুতি-স্তাবকতা করতে পারেন, অথবা পাবার আকুতি যাদের প্রবল থাকে, তাঁরাই আলোর সান্নিধ্যে পৌঁছে যান। রিজিয়া রহমান আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন নিরহংকারী-নিভৃতচারী-নির্লোভ-সৎ-আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কথাশিল্পী; উচ্চাভিলাষী হয়ে মধুভাণ্ডের পেছনে তিনি ছুটবেন কেন চেয়ারের আশায়? তেমন মোহ-বাতিকতা সম্ভবত তাঁর কমই ছিল; এবং সে কারণেই অত বড় মাপের একজন কথাশিল্পী হয়েও থেকে গেছেন আলোর আড়ালে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির যে দ্যুতি, তাঁর গদ্যের যে শক্তি, সে শক্তি নিজের দীপ্তিতেই আলো ছড়াবে, যে আলোয় নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়ার সুযোগ পাবো আমরা। প্রশ্ন হলো, সে সুযোগ কাজে লাগাবার ঔদার্য আমাদের আছে তো? রিজিয়া রহমান-এর উপন্যাস পড়ার ধৈর্য এবং মানসিক সামর্থ্য আমাদের আছে তো?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App