×

জাতীয়

রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০১৯, ১২:০০ পিএম

রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট
জাতির পিতা হত্যার ঠিক ঊনত্রিশ বছর পর তার উত্তরসূরি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে ঘাতকরা আবারো জোট বেঁধেছিল আগস্টেই। শোকাবহ আগস্টেই আরেকটি রক্তাক্ত আগস্টের পুনরাবৃত্তির সুপরিকল্পনায় ঘাতক-হায়েনারা আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করে রক্তবন্যা বইয়ে ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে। টার্গেট ছিল এক ও অভিন্ন। তদন্তে প্রমাণিত হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ব্যাহত করা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতে সে দিন প্রকাশ্য দিবালোকে এই দানবীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে ঘাতক চক্র। বিশ্লেষকদের মতে, ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একটি মামুলি হত্যাকাণ্ড ছিল না। ভয়াবহ এই গ্রেনেড হামলা দেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। রাষ্ট্রীয় মদদে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন চেষ্টায় তাদের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ দেশের রাজনীতিকে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণেই রাষ্ট্র ও সমাজে আজ এক ধরনের বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যার মাসুল জাতিকে দিতে হচ্ছে আজও। তদন্তে বেরিয়ে আসে, সারা বিশ্বে শুধু অস্ট্রিয়া ও পাকিস্তানে আর্জেস গ্রেনেড তৈরি হয়ে থাকে। তাও আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে। ফলে এসব গ্রেনেড কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছাড়া বাইরের কারো কাছে থাকার কথা নয়। কয়েক দফা হত্যাচেষ্টার পরও বেঁচে যাওয়ার কারণে নিশ্চিতভাবে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই পাকিস্তান থেকেই আর্জেস গ্রেনেডগুলো আনা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড চট্টগ্রামে জড়ো করে সেগুলো পরে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী এডভোকেট আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনের কাছে পৌঁছে দেয় পাকিস্তানি জঙ্গি আবু ইউসুফ বাট ওরফে আব্দুল মাজেট বাট ওরফে আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ বাট। তাজউদ্দিন কিছু গ্রেনেড নিজের কাছে রেখে বাকিগুলো হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে দেয়। মুফতি হান্নান সেগুলো বাড্ডা থেকে হামলাকারী জঙ্গিদের কাছে দেয়। জঙ্গিরা গ্রেনেড নিয়ে বাসে করে সমাবেশের কাছাকাছি গিয়ে বিভিন্ন ভবনের ছাদে উঠে হামলা চালায়। হামলার আগে হাওয়া ভবনে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছিল। হাওয়া ভবনে তারেক রহমান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর নূর, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, আবদুস সালামসহ বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতা এবং মুফতি হান্নানসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের বৈঠকে গ্রেনেড হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেছিলেন। হাওয়া ভবনেই হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বৈঠকও হয়। জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসা থেকে নেয়া ১৫টি গ্রেনেড দিয়ে জনসভায় হামলা চালানো হয়। মুফতি হান্নানসহ আটজন আসামির আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব সত্য বেরিয়ে আসে। এ ব্যাপারে বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, পনেরো আগস্টের বর্বরতা ঘটেছিল রাতের অন্ধকারে জনগণের চোখের আড়ালে। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়েছে প্রকাশ্যে। কোনো জনসভায় হামলা চালিয়ে একটি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা চালানোর কোনো নজির স্মরণকালের ইতিহাসে বিরল। তিনি বলেন, ১৫ এবং ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল অভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বহুমাত্রিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য। দুটি ঘটনাই ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টা। ১৫ আগস্টের কুশীলবরা কেবল বঙ্গবন্ধুকে নয়, তার রাজনৈতিক আদর্শও হত্যা করতে চেয়েছিল। কারণ তারা জানত, বঙ্গবন্ধু এক অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য সর্বজনীন চেতনার শারীরিক প্রতিমূর্তি হিসেবে নিজেকে আসীন করেছিলেন। তাকে না সরালে পাকিস্তানি ভাবধারায় রাজনীতি বাংলাদেশে নির্মাণ অসম্ভব। আর ২১ আগস্টের হামলার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, আওয়ামী লীগকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক বিপর্যয় ও মেধার সংকটে ঠেলে দেয়া। গ্রেনেড হামলার পর দেশের রাজনীতি ফের প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে বিভক্ত হয়ে পড়ে গোটা সমাজ। আজও সেই বিভক্তি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তখনো জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ-মৌলবাদ মাথাচাড়া দেয়ার অপচেষ্টা করে। যদিও সরকার দক্ষভাবে সামাল দিচ্ছে। এদিকে গ্রেনেড হামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, রাজনীতি মানে কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? এই রাজনীতি এ দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে, তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চালানো হবে? রাজনীতিতে এমন ধারা চালু থাকলে মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, গ্রেনেড হামলা নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির ধারার পরিণত হয়েছে। শুধু রাজনীতিকরাই নন; শিক্ষক, চিকিৎসক, পেশাজীবীসহ পুরো সমাজ ব্যবস্থায় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতিতে সমঝোতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। কিন্তু এখন আর এটি নেই। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আস্থাবোধ নেই। এসব আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও উগ্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। জিয়া পরিবারের প্রতি এই বিরূপ রাজনৈতিক মনোভাব কারো কাম্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলছিল। বিচার হয়েছে। রায়ও হয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিলের রায়ে তারা যদি সত্যিই অপরাধী হন, তখন তাদের শাস্তি দেবেন আদালত। এর আগেই তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক মনোভাব প্রকাশ করা ঠিক নয়। পৈশাচিক হামলায় সে দিন প্রাণ হারান আইভী রহমানসহ ২৪ জন। স্প্লিন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন ৪শ-এর বেশি আহত নেতাকর্মী। সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা স্প্লিন্টারের কষ্ট নিয়েই মারা গেছেন জননেতা আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ অনেকেই। গ্রেনেডের বিকট শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত কানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখনো ব্যবহার করতে হয় ‘হিয়ারিং এইড’। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্নের এই রাজনীতিই দেশকে আজ দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতিতে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই ঘটানো হয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা। কারণ ১৫ আগস্টে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার জন্য বেপরোয়া খুনিরা একের পর একের বোমা হামলা করে ব্যর্থ হয়েছে। তখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান থেকে আর্জেস গ্রেনেড এনে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নের জন্য পরিকল্পিত হামলা চালায়। এই হামলার সঙ্গে সরাসরি বিএনপি এবং জিয়াপুত্র তারেক রহমান জড়িত ছিল। আর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সংসদে বললেন, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে বোমা নিয়ে নিজেই হামলা চালিয়েছেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং হাস্যকর যুক্তি। যে আর্জেস গ্রেনেড আমাদের সেনাবাহিনীতেই ব্যবহার করা হয় না, সেই আর্জেস গ্রেনেড কোথা থেকে এসেছে, আজ জাতি জানে। ২১ আগস্টের ঘটনায়ও পাকিস্তান জড়িত। বিএনপি এবং পাকিস্তান মিলে বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল। এই বিভাজনের রাজনীতি জাতি ভুলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায় বিএনপিকে সংগঠনগতভাবে নিতে হয়নি। তখন বিএনপির জন্ম হয়নি। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার দায় বিএনপির। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের জন্য যেমন তদন্ত কমিশন গঠন করে শ্বেতপত্র প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন, তেমনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার শ্বেতপত্রও প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন। এদিকে এক যৌথ বিবৃতিতে ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২১ আগস্ট একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই কলঙ্ক মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের জনগণ কখনো এই ধরনের হিংসাত্মক রাজনীতিকে মেনে নিতে পারে না। প্রতিহিংসার কোনো রাজনীতি কখনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App