×

মুক্তচিন্তা

বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০১৯, ০৯:০৩ পিএম

একুশে আগস্টের আসুরিক আক্রমণের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর যে অশুভ প্রভাব ফেলেছে তা নিরসনে বোমা হামলার প্রধান শিকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা দিয়ে তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে পজিটিভ ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু দেশবাসীকে এ ঘটনা অনাগত কাল ধরে তাড়িয়ে বেড়াবে। তবে এ ঘটনা থেকে একটি বিষয় আবারো স্পষ্ট হয়েছে যে, বোমার আগুনে দেশ জ্বালিয়ে, রাস্তাঘাটে মানুষ মেরে নিঃশ্বাস বন্ধ করা রাজনীতি চর্চা করে কেউ পরিণামে জয়লাভ করতে পারে না।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, সাপ্তাহিক বন্ধের শেষ দিন। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমের শনিবার দিনটি ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল। সময় বিকেল ৫টা ২৫ মিনিট, দোর্দণ্ড মার্তণ্ডের খরতাপ অনেকটা কমে এসেছে। দলীয় প্রতিবাদ র‌্যালি এবং সভা চলছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের রাস্তায়। উন্মুক্ত ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তার বিশ মিনিটের বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ গগণবিদারী আওয়াজে চারদিকে হুলুস্থুল, দৌড়াদৌড়ি, আর্তনাদ, গোঙানি, বাঁচানোর আকুতি। সুন্দর রোদেলা বিকেল মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল ধোঁয়াচ্ছন্ন। বোমায় বিধ্বস্ত সড়কটি হয়ে উঠল নিহত-আহত মানুষের লাল লাল ছোপ ছোপ রক্তের কারবালা। আচমকা গ্রেনেড আক্রমণে হতবিহ্বল মানুষজনের ছোটাছুটি আর পদদলন পরিস্থিতিকে করে তুলল আরো ভয়াবহ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কানের আঘাত নিয়ে বেঁচে গেলেন ভাগ্যক্রমে অনুসারীদের বেষ্টনীর মধ্যে থাকার কারণে, কিন্তু দুই পা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেত্রী দলের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভী রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী)। আহত অবস্থায় তিন দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন আজীবন নারী জাগরণ আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা এই মহীয়সী নেত্রী।

একুশের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছিল সে বছরে প্রথম থেকেই সারাদেশে ‘বোমা বিস্ফোরণ’ সিরিজের সর্বশেষ ঘটনা; এ ঘটনার কয়েক দিন আগেই ৭ আগস্ট সিলেটে এক বোমা আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় নেতা। তারই প্রতিবাদে সন্ত্রাসবিরোধী র‌্যালি অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ২১ আগস্ট। সেদিনকার গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং চার শতাধিক আহত হয়েছিলেন। আহতদের কেউ পা হারিয়ে, কেউ হাত হারিয়ে বা শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে এখনো জীবস্মৃত অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। অনেকে চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন। বিবিসির এক তথ্যসূত্রে জানা যায়, এর পূর্বে বিগত পাঁচ বছরে শতাধিক লোক বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের জেলা সিলেট থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা পর্যন্ত ব্যাপৃত এলাকায় বিভিন্ন স্থানে সিনেমা হল, পত্রিকার সম্পাদক, রাজনৈতিক র‌্যালি, এমনকি বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপরও বোমা হামলা হয়েছে। অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্রতাপশালী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে হামলা-মামলায় জড়িয়ে হতভম্ব করে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়া। একুশের হামলাটি বিগত হামলাগুলোরই ধারাবাহিকতায় ঘটানো হয়। এ ঘটনার পরও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশে ৬৪ জেলার ৬৩টি শহরে সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। তৎকালীন সরকার কোনোটিরই সুবিচার করেনি, শুধু বিচারের নামে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়েছিল।

গণতন্ত্রের ইতিহাসে পরপর ১৩টি গ্রেনেড ছুড়ে নিরীহ মানুষের ওপর এ রকম বর্বর আক্রমণ নজিরবিহীন। আশপাশের ভবনগুলোর ছাদ থেকে এলোপাতাড়ি ছুড়ে মারা গ্রেনেডের আক্রমণ ছিল স্পষ্টত একটি হত্যাপ্রচেষ্টা এবং কার্যত পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। মূল টার্গেট ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধানকে এভাবে জনসভায় হঠাৎ আক্রমণ করে হত্যা করার প্রচেষ্টা একমাত্র ওদের পক্ষেই সম্ভব যারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করে না এবং খুন-রাহাজানি যাদের ক্ষমতা দখলের একমাত্র অস্ত্র। এ ঘটনার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুখে শুধু ‘dastardly attack’ বলেই দায়িত্ব শেষ করেছেন (বিবিসি নিউজ, ২২ আগস্ট, ২০০৪); অপরাধী গ্রেপ্তার বা কোনো প্রকার তদন্ত এবং বিচারের ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই নীরব। তিনি এবং তার দলটি আজ পর্যন্তও নির্বিকার। মতিঝিলের একজন পকেটমারকে অ্যারেস্ট করে তাকে দিয়ে সাজানো ‘জজ মিয়া’ নাটকটিও শেষ পর্যন্ত গুবলেট হয়ে গেছে। বিচারপতি জয়নাল আবেদিনকে দিয়ে এক ব্যক্তিবিশিষ্ট জুডিসিয়াল কমিশন করে তদন্তের নামে মকারি করা হয়েছে। এ বিচারপতি দেশবাসীকে জানাতে চেয়েছেন যে, বোমা হামলাটি ছিল দেশি-বিদেশি শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত একটি ঘটনা। তাকে পরবর্তী সময় সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনের বিচারক নিয়োগ দিয়ে পরিকল্পিত মকারির জন্য পুরস্কৃত করা হয়। অথচ ২০১২ সালের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২১ আগস্টের আক্রমণটি ছিল একটি বিশাল ষড়যন্ত্রের ফসল। আর এ ষড়যন্ত্রটি করেছিল যৌথভাবে জঙ্গিগোষ্ঠী হুজি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবশালী কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ প্রশাসন, ডিজিএফআই, এনএসআই এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কয়েকজন দুষ্ট চরিত্রের কর্মকর্তা।

সুখের খবর, গত বছরের ১০ অক্টোবর গ্রেনেডে বোমা হামলা সংক্রান্ত মামলার রায় দেয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১৯ জনের ফাঁসি আর ১৯ জনের যাবজ্জীবনসহ আরো অনেকের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। যারা এর পেছনে কুশীলব ছিল তারা যথাযথ শাস্তি পেয়েছে; যে ছিল মাস্টারমাইন্ড-মূল পরিকল্পনাকারী তারও যাবজ্জীবন হয়েছে। এ বিচারের কারণে প্রমাণিত হলো, এ দেশে সব সময় বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে না। ষড়যন্ত্রেরও বিচার হয়।

সব দেখেশুনে মনে হয়, এ জঘন্য আত্রমণটি করার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যাকে সরিয়ে এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতানেত্রীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে দেশকে বিরোধী নেতৃত্বশূন্য করা তথা আওয়ামীবিহীন করা, ঠিক যেভাবে তারা এর আগে ১৯৭৫-এ দেশের স্থপতিকেই সরিয়ে দিয়েছিল মহাষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। তারই কন্যাকে তারা কেন ছেড়ে দেবে? তিনি তো ছিলেন তখন তাদের জন্য বিশাল বাধার পাহাড়। এ ছাড়া তারা চেয়েছিল বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসের রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলতে, যেখানে তারা সন্ত্রাস কায়েম রেখে জনগণকে শোষণ করতে পারবে।

কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকে না, স্থবিরও থাকে না। চলমান ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য ঠিকই সঠিক জায়গায় আসন বিছিয়ে দিয়েছে। জাতির জনকের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ জনগণই তাকে দিয়েছেন এবং তিনি সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশকে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিতও করতে সক্ষম হয়েছেন। আর যারা ষড়যন্ত্র করে তাকে ২১ আগস্ট নিশ্চিহ্ন করতে অপতৎপরতা চালিয়েছিল তারাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষ শক্তির সরকারের প্রধান হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। জোট সরকারের কূটকৌশল আর বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত সব প্রমাণ গায়েব করে দেয়ার অপচেষ্টার পরও বিচারের প্রক্রিয়া ঠিকই শুরু হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। অভিযুক্তদের আটজন আছেন জামিনে, ২৩ জন কারাগারে আর ১৮ জন পলাতক।

একুশে আগস্টের আসুরিক আক্রমণের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর যে অশুভ প্রভাব ফেলেছে তা নিরসনে বোমা হামলার প্রধান শিকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা দিয়ে তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে পজিটিভ ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু দেশবাসীকে এ ঘটনা অনাগত কাল ধরে তাড়িয়ে বেড়াবে। তবে এ ঘটনা থেকে একটি বিষয় আবারো স্পষ্ট হয়েছে যে, বোমার আগুনে দেশ জ্বালিয়ে, রাস্তাঘাটে মানুষ মেরে নিঃশ্বাস বন্ধ করা রাজনীতি চর্চা করে কেউ পরিণামে জয়লাভ করতে পারে না।

ড. এম এ মাননান: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App