×

মুক্তচিন্তা

একটি রপ্তানি পণ্যের করুণ হাল!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০১৯, ০৯:১৯ পিএম

কুরবানির চামড়া নিয়ে এবারের মতো করুণ অবস্থা ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। সমস্যা একটু-আধটু হয়েছে অতীতে, কিন্তু এবারের মতো ভয়ঙ্কর ছিল না তার ধরন কখনোই। দেখভালের দায়িত্ব যাদের তাদের নজরদারি ও সতর্কতার ঘাটতি ছিল এ কথা সর্বমহলে আলোচিত। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ প্রধান করণীয় হবে। কুরবানির কলেবর খুব দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো হবে এ কথা মনে রেখে সতর্কতার মাত্রা বাড়াতে হবে।

দেশের রপ্তানি পণ্যের দ্বিতীয় প্রধান খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। প্রধান খাত গার্মেন্টস সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ আসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। মানসম্পন্ন পণ্য হিসেবে এর খ্যাতিও আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সরকার খাতটিকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত বলে গণ্য করে আসছে। অথচ এর কী করুণ পরিণতিই না লক্ষ করেছি আমরা ক’দিন আগের কুরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে! সংগৃহীত চামড়ার অর্ধেকাংশের জোগান আসে কুরবানির পশু থেকে। কুরবানির পশুর চামড়ার মাঠ পর্যায়ের প্রধান সংগ্রহকারক মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। যুগ যুগ ধরে এমনটি হয়ে আসছে। সংগ্রহ করে দেয়ার জন্য এই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আগাম টাকাও পেতেন অনেক সময়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এ টাকা দিতেন। তারা আবার টাকা পেতেন আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে। এবার সব দিক থেকেই ঘটল ব্যতিক্রমী ঘটনা। টাকার জোগান তো ছিলই না, উল্টো নিরুৎসাহিত করা হলো স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আবার যথারীতি হতাশার কথা শোনালেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের, তাদের আর্থিক সহায়তা তো করলেনই না। এরকম বিরূপ পরিস্থিতিতেও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের একাংশ যৎকিঞ্চিৎ দাম দিয়ে চামড়া কিনেছেন, কিনেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও নামমাত্র মূল্যে। কিন্তু সেই ক্রয়মূল্যও উঠে আসছে না তাদের। এতিমখানা, মাদ্রাসা ও কিছু কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান কুরবানির চামড়া সংগ্রহ করে থাকে প্রতি বছর। এবার সেই সংগ্রহ খরচও উঠছে না অনেক প্রতিষ্ঠানের। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী কোনো কোনো স্থানে সংগ্রহকারকদের কেউ কেউ ক্ষোভে-দুঃখে-হতাশায় সংগৃহীত চামড়া ভাগাড়ে ফেলছেন, মাটিতে পুঁতে ফেলছেন। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। কিছুদিন আগেও একই রকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গিয়েছিল ধানের মাত্রাছাড়া কম দাম নিয়ে, ক্ষেতের ধান ক্ষেতে রেখেই পুড়িয়ে ফেলার খবর দিয়েছিল পত্রিকা। এ ধরনের ঘটনা জাতির জন্য চরম ক্ষতিকর। সরকারের জন্যও বিব্রতকর, তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেশনের। ট্যানারি মালিক ও আড়তদার এখন একে অন্যকে দোষারোপ করলেও কাজটি তারা মিলেমিশেই করেছেন বলে সাধারণের ধারণা। অভিযোগ তৈরি হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের বিরুদ্ধেও। পরিস্থিতি দেখভালের দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত ছিল তারা সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। ঈদের আগে কুরবানির পশুর চামড়ার দাম কী হবে এ সম্পর্কে একটি ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন। তাদের সেই ঘোষণার সঠিক বাস্তবায়ন হলো কি হলো না কিংবা উদ্ভব হলো কিনা নতুন কোনো পরিস্থিতির তা নিয়ে বিশেষ পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং ছিল না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, অর্থাৎ মাঠ পর্যায়ে পানির দরে বেচাকেনা কিংবা অবহেলার শিকার হওয়ার পর, ঘোষণা দেয়া হলো কাঁচা চামড়া রপ্তানির। এ সিদ্ধান্তও পরবর্তী সময়ে তেমন কাজে দেবে বলে মনে হয় না। আগেই বলেছি যে দেশের মোট পশু চামড়ার অর্ধেক সংগৃহীত হয় কুরবানির ঈদের সময়। এর সঠিক ব্যবস্থাপনা এক বিরাট ব্যাপার। চামড়ার একটা অংশ এতিমখানা, মাদ্রাসাসহ কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হলেও বৃহদাংশের বিক্রয়লব্ধ অর্থ পান গরিব আত্মীয়-স্বজন ও নিঃস্ব মানুষ। এর বিক্রয়মূল্য এরকম তলানিতে গিয়ে ঠেকলে তারা বঞ্চিত হন। চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য দেশের রপ্তানি খাতের দ্বিতীয়তম। সরকার ঘোষিত থ্রাস্ট সেক্টরের একটি এ খাত। অতীতে আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাট, চা, চামড়া। পাট ও চায়ের অবদান বর্তমানে নিম্নতর পর্যায়ে, তুলনায় কিছুটা সবল চামড়া। তবে গার্মেন্টসের ধারেকাছে নেই কোনোটিই। অবস্থাটি বিপজ্জনক। কোনো কারণে গার্মেন্টসে ধস নামলে রপ্তানি আয়েও ধস নামবে, যে কারণে বিকল্পের কথা বলা হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে। বিদেশে সুনাম থাকার কারণে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য অগ্রণী ভূমিকায় থাকতে পারে। সে জন্য সরকারের মনোযোগ থাকা দরকার খাতটির প্রতি অধিক, কিন্তু এবারকার ঈদ অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে উল্টোটি, সতর্কতা ও মনিটরিং বলতে গেলে ছিলই না। দেশের মানুষের সঙ্গতি দিন দিন বাড়ছে, সে সঙ্গে বাড়ছে কুরবানি দেয়ার পরিমাণ। কুরবানির পশুর উৎপাদনও বাড়ছে সমান তালে। গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প সম্প্রসারিত হচ্ছে, গ্রামে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গরু-ছাগল-মহিষ পালিত হচ্ছে অধিক হারে। এসব উদ্যোগের প্রায় সবই ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে হচ্ছে। ভবিষ্যতে চামড়ার পরিমাণ আরো বিপুলায়তন হবে, সতর্কতার প্রয়োজন হবে তখন অধিক। এবারকার সংকট থেকে শিক্ষা নেয়া গেলে ভবিষ্যতের জন্য তা হতে পারে পাথেয়। বাংলাদেশে ট্যানারির সংখ্যা ২ শতাধিক বলা হলেও কার্যরত আছে আরো কমসংখ্যক। এর মধ্যে দেড় শতাধিকের স্থান হয়েছে সাভারের চামড়া শিল্প নগর হেমায়েতপুরে। গুটি কতক বাদে সবাই সেখানে কার্যক্রম শুরু করেছে। প্রকল্প হাতে নেয়ার পর প্রায় ১৬ বছর অতিবাহিত হলেও সমস্যা মেটেনি এখনো সেখানে। বড় সমস্যা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের অসম্পন্নতা। সেটি সম্পন্ন করাসহ প্রতিশ্রুত সুবিধাদি দ্রুত মিটিয়ে ট্যানারি মালিকদের আস্থায় আনা দরকার। একই সঙ্গে বাড়ানো দরকার নজরদারি। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের ট্যানারি মালিকদের আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড সুবিধার নয়। নতুনদের কথা জানি না, পুরনো যারা আছেন তাদের বেশিরভাগ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সময়মতো ফেরত দিতে অভ্যস্ত ছিলেন না। কুরবানির সময় হলে নানান ছুতায় ব্যাংক থেকে টাকা তারা নিয়েছেনই কেবল, ফেরত দেয়ার কথা ভাবেননি। তাদের এ প্রবণতা দেখতে দেখতে ব্যাংক এখন নতুন করে টাকা দেয়ার বেলায় সতর্ক। ফলে নিজ কর্মদোষে বিপাকে পড়েছেন ট্যানারি মালিকদের অনেকে। এদিকে গত কয়েক দিনের খবরাখবরে যা প্রকাশ পাচ্ছে তাতে দেখা যায় আড়তদাররা তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ পান। পুরনো পাওনা পরিশোধ না করায় প্রতিবাদী হয়েছেন তারা। এখন মুখোমুখি অবস্থান উভয়পক্ষের। এরকম অচলাবস্থা শিল্পের জন্য হিতকর নয়, সরকারের দৃষ্টি এ ক্ষেত্রেও প্রসারিত হওয়া দরকার। বাংলাদেশে এখন বহু ফুটওয়্যার তৈরির কারখানা হয়েছে যারা ব্র্যান্ড খ্যাতি অর্জন করেছে ইতোমধ্যে। দেশ ও বিদেশ উভয় জায়গায় এসব কোম্পানির বাজার রয়েছে। তারা বিদেশ থেকে চামড়া এনে পণ্য তৈরি করছে। দেশের চামড়া পচেগলে নষ্ট হচ্ছে, অথচ আমদানি করে প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে- এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? কুরবানির চামড়া নিয়ে এবারের মতো করুণ অবস্থা ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। সমস্যা একটু-আধটু হয়েছে অতীতে, কিন্তু এবারের মতো ভয়ঙ্কর ছিল না তার ধরন কখনোই। দেখভালের দায়িত্ব যাদের তাদের নজরদারি ও সতর্কতার ঘাটতি ছিল এ কথা সর্বমহলে আলোচিত। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ প্রধান করণীয় হবে। কুরবানির কলেবর খুব দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো হবে এ কথা মনে রেখে সতর্কতার মাত্রা বাড়াতে হবে।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App