×

মুক্তচিন্তা

চামড়া শিল্পের জন্য সহায়ক নীতি প্রয়োজন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৩০ পিএম

চামড়া নিয়ে শিল্প বাংলাদেশে ইতোপূর্বে গড়ে উঠেছিল, সেই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার মধ্য দিয়েই এ শিল্পকে আরো মজবুত ভিত্তি দেয়া যেতে পারে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে শত-সহস্র কোটি টাকার রপ্তানি বাণিজ্য থেকে ক্রমেই দূরে সরতে থাকবে রাষ্ট্র। অন্যদিকে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও চামড়া কিংবা চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদনে উৎসাহ হারাতেই থাকবে। ব্যবসায়ী-সরকার কিংবা মনিটরিং বিভাগের মাঝে সমন্বয়হীনতা থাকলে এ রকম রপ্তানিনির্ভর ব্যবসা ক্রমেই হোঁচট খাবে।

প্রতি বছরই কুরবানির ঈদ এলে একটা আলোচনা জোরালো হয়। কুরবানির জন্য গরু কিংবা ছাগলের যে মূল্য ওঠে কিংবা মানুষ যেভাবে অধিক মূল্য দিয়ে এবারেও প্রাণী কিনে কুরবানি দিয়েছে, সেই হিসেবে গরু কিংবা খাসি কিংবা ছাগলের চামড়ার মূল্য পায়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে তুমুল আলোচনা আছে দেশব্যাপী। সহজ-সরলভাবে অনেকেই দায়ী করছেন চামড়া ব্যবসায়ীদের। অভিযোগ করছেন সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনেনি কিংবা ব্যবসায়িক কারণেই ইচ্ছে করেই তারা এবার চামড়া নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে। অর্থাৎ হাজার হাজার চামড়ার ন্যূনতম মূল্যটুকু দিয়েও তারা চামড়া ক্রয় করেনি। অনেকেই এ ব্যাপারটাকে ধর্মীয় লেবাস পরানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। সারাদেশেই চামড়া বিক্রি হয়নি। এবং এটা হুট করেই এ বছরই যে শুধু হয়েছে, তা নয়। বিভিন্ন মাদ্রাসা কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করার জন্য দান হিসেবে দেয়া চামড়াগুলোও বিক্রি হয়নি। চামড়ার এ অবিক্রিতে সারাদেশই যেখানে এ শিল্প থেকে লোকসানের ভাগিদার হচ্ছে, সেখানে ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা ধ্বংসের পাঁয়তারা বলাটা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ছাড়া আর কিছু নয়। গত কয়েক বছর থেকেই দেখা যাচ্ছে, চামড়ার দুর্দিন যাচ্ছে। দেশে চামড়া শিল্প যেভাবে বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। বরং এ শিল্প ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। চামড়া কিংবা চামড়াজাত দ্রব্যের চাহিদা সারা বিশ্বে কমেছে বলে প্রচার-প্রচারণা আছে। এবং সে জন্য বিদেশে চামড়া আগের মতো রপ্তানি করা যাচ্ছে না বলে ব্যবসায়ী এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও প্রচারণা আছে। এ কথার মাঝে সত্যতা যে নেই, তাও বলা যাবে না। সমীক্ষা বলছে, ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ পণ্যের রপ্তানি কমেছে ৬ কোটি ৫৭ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। তার আগের বছর রপ্তানি কমেছিল ১৪ কোটি ৮৬ লাখ মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতি বছরই রপ্তানি আয় কমছে। গত ২ মাসে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় কমেছে ২৬.২৬ শতাংশ। চামড়াজাত পণ্যের ব্যবহার পৃথিবীব্যাপী কমতে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই চামড়া রপ্তানি কমবেই। চামড়া রপ্তানি কমতে থাকলে এর জোগান থাকলেও পণ্য উৎপাদন না হলে স্বাভাবিকভাবে আগের মতো ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয়ে উৎসাহী হবেন না। অন্যদিকে চামড়া ব্যবসায়ীরা এবারে যে চামড়া নিয়ে চরম অরাজকতা করেছেন, তা যেমন বিভিন্ন পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছে, তা তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তা স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ঈদের দুদিন পর সংবাদ সম্মেলন করে চামড়া ব্যবসায়ীরা আবারো চামড়া ক্রয়ের যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, তাতে চামড়া বিক্রেতারা খুব একটা আশাবাদী হতে পারেননি, কারণ এর আগেই অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষ ওই চামড়া পানির চেয়েও কম দামে বিক্রি করে ফেলেছেন। কেউ কেউ বিক্রি তো দূরের কথা, এমনকি মূল্যহীনও কাউকে দিতে পারেনি। আর সে জন্য ফড়িয়া কিংবা ওই ব্যবসায়ীরা প্রকারান্তরে লাভবান হয়েছেন। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় সিন্ডিকেট করতেই পারেন, কিন্তু এ কথা তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না, পণ্যের জোগান থাকা সত্ত্বেও যদি এ পণ্য অবিক্রীত পড়ে থাকে, এতে ব্যবসায়ীদের অর্থও মৃত হয়েই পড়ে থাকে। যে কোনো পণ্যের বিক্রি যদি নিশ্চিত না করতে পারেন ব্যবসায়ীরা, তাহলে তারা কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। সে জন্যই ব্যবসায়ীরা গত বছরের তুলনায় এবার অন্তত ২৫ লাখ চামড়া কম কেনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলেন। গত বছর তারা ১ কোটি ২৫ লাখ পিস চামড়া ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু এবার তারা ১ কোটি চামড়া ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন। উল্লেখ্য, গত বছরের ৬০ লাখ চামড়া এখনো অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতি বছরই চামড়ার দাম কমছে। হিসাব করে দেখা গেছে, গত ৭ বছরে গরুর চামড়ার দাম কমে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে এবং খাসির চামড়ার দাম এক-তৃতীয়াংশের নিচে এসে পৌঁছেছে। এ তো গেল বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের চামড়া না কেনা নিয়ে তাদের পক্ষের কিছু কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পাশের দেশ ভারতের কিছু ব্যবসায়ী চামড়া ঠিকই বাংলাদেশ থেকে নিয়ে নিচ্ছে অল্প দাম দিয়েই। এই নিয়ে নেয়া রাষ্ট্রীয় রপ্তানিনির্ভর নয়। বিভিন্নভাবেই প্রচার-প্রচারণা আছে তারা চোরবাজারিদের মাধ্যমে এই চামড়া কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এবং সরকারের থেকেই বলা হচ্ছে, চামড়া যেন ভারতে পাচার না হয় সে জন্য বিজিবি সতর্ক আছে। এতে প্রতীয়মান হয়, যেভাবে ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমেছে, তা কিন্তু নয়। কারণ ভারত ঠিকই চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করছে এবং তাদের রপ্তানি আয় বাড়াচ্ছে। চামড়া নিয়ে শিল্প বাংলাদেশে ইতোপূর্বে গড়ে উঠেছিল, সেই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার মধ্য দিয়েই এ শিল্পকে আরো মজবুত ভিত্তি দেয়া যেতে পারে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে শত-সহস্র কোটি টাকার রপ্তানি বাণিজ্য থেকে ক্রমেই দূরে সরতে থাকবে রাষ্ট্র। অন্যদিকে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও চামড়া কিংবা চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদনে উৎসাহ হারাতেই থাকবে। ব্যবসায়ী-সরকার কিংবা মনিটরিং বিভাগের মাঝে সমন্বয়হীনতা থাকলে এ রকম রপ্তানিনির্ভর ব্যবসা ক্রমেই হোঁচট খাবে। এমনকি গত মৌসুমে এভাবেই চালের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে কৃষকরা হতাশ হয়েছেন, সরকারও সমালোচিত হয়েছে। এবারো মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের প্রতি ধিক্কার ওঠার পাশাপাশি সরকারকেও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চামড়া শিল্পের এ দুরবস্থার সময়ে বাংলাদেশের পশুর চামড়া সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছে। দেশটির ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশি অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে কালোবাজারে অল্প দামে বাংলাদেশি চামড়া কিনে লাভবান হচ্ছে এবং বাংলাদেশের চামড়ার হারানো বাজার পার্শ্ববর্তী দেশের দখলে চলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক চাউর হওয়া সমন্বয়হীনতা কিংবা অন্য কথায় শিল্পের জন্য সহায়ক নীতি না থাকার কারণেই মনে হচ্ছে চামড়া শিল্পটাই যেন ডুবতে বসেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই হাজারো কোটি টাকার এ শিল্পটি নিয়ে নতুন করে ভাবনার একটা জায়গা করে দিয়েছে এবারের ঈদ।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App