×

অর্থনীতি

চামড়ার ধস অব্যবস্থাপনায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০১৯, ১১:৫৫ এএম

কারসাজির মাধ্যমে দেশের চামড়ার বাজারে অস্বাভাবিক ধস সৃষ্টির পর এ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন খেলা। কুরবানির চামড়া গতকাল শনিবার থেকে বেচাকেনা শুরুর কথা থাকলেও তা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে একে অন্যের ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা। বিশ্লেষকরা বলছেন, চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যের দায় আছে সরকারেরও। রপ্তানিমুখী এই শিল্পের সুরক্ষায় সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বাস্তবতার নিরিখে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত যথার্থ হলেও তা এসেছে অনেক দেরিতে। ফলে সুফল তো মেলেইনি; সৃষ্টি হয়েছে নতুন জটিলতা। সরকারের এই সিদ্ধান্তে সিন্ডিকেটবাজি বুমেরাং হওয়ায় ট্যানারি মালিকরা এখন কাঁচা চামড়া কিনতে তৎপর হলেও সুযোগ বুঝে গো ধরেছেন আড়তদাররা। বিশ্লেষকদের মতে, চামড়া শিল্পের এই বিপর্যয় একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে সরকারের অবহেলার কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতি সহায়তা পায়নি চামড়া শিল্প। পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় টেকসই কৌশল প্রণয়নও হয়নি। বরং ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটবাজিকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। এই সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার পরিণতিতেই সৃষ্টি হয়েছে এখনকার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। এদিকে চামড়া শিল্পের এই সংকটের মুহূর্তে কথা উঠেছে সাভারের চামড়া শিল্পনগরী নিয়েও। এখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি বলে অভিযোগ ট্যানারি মালিকদের। বিশেষত কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর না থাকার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তাদের মধ্যে। তবে বিসিক তা মানতে নারাজ। কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে সিইটিপির। গতকাল শনিবার সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে এক মতবিনিময় সভায় শিল্প সচিব মো. আবদুল হালিম বলেন, সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীর সিইটিপি সম্পূর্ণ চালু রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অনিয়মে জর্জরিত এ রপ্তাতি খাত সার্বিকভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে সময়মতো সরকারের সঠিক পদক্ষেপের অভাবও অন্যতম একটি বড় কারণ। এ শিল্পে পূর্ণ যৌবন ফেরাতে দ্রুত সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন তারা। তা না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চামড়াজাত পণ্যের বহুমুখীকরণের পরামর্শও দিচ্ছেন কেউ কেউ। চলতি বছর ইতিহাসের সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয়েছে কুরবানি ঈদের পশুর চামড়া। চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে ক্ষুদ্র ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এতিম মিসকিনরা। আগে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকায় গরুর যে চামড়া বিক্রি হতো তা এবার ৩০০ টাকায়ও বিক্রি করা যায়নি। ১০০ থেকে ১৫০ টাকার ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ১৫-২০ টাকায়। বিক্রি করতে না পেরে প্রচুর চামড়া ফেলে দেয়া হয়েছে, এমনকি মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারে অপরিকল্পিতভাবে ট্যানারি স্থানান্তরের ফলে দেশের চামড়া শিল্প খাতে ধস নেমেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের আশঙ্কা, দ্রুত ট্যানারি কেন্দ্রিক সমস্যার সমাধান না হলে এ শিল্পে পূর্ণ যৌবন ফিরবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. শামসুদ্দিন বলেন, চামড়াজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারজাতকরণের দিকে আমরা যদি নজর না দেই; তাহলে এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আশা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমরা চামড়া দিয়ে ছোট ছোট কার্পেট তৈরি করতে পারি। দেয়াল সজ্জা বা মোবাইল সেটের কভারের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। চামড়া দিয়ে মোবাইল ফোনের কাভার কেউ কিন্তু তৈরি করে না। অথচ এটার অনেক ভালো মূল্য আছে। সুতরাং নতুন নতুন চামড়ার বাজার খোঁজার পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন তিনি। গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, নানা অনিয়মে জর্জরিত অন্যতম এ রপ্তানি খাত। যার মধ্যে নিজেদের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, পরিবেশ মানদণ্ড পিছিয়ে থাকাসহ আরো বিভিন্ন বিষয়কে দায়ী করেন তিনি। তার মতে, চামড়া শিল্পের সঙ্গে যুক্ত যারা, তাদের নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা নেই। পরিবেশগত ‘কমপ্লায়েন্স’ বলেও কিছু নেই। তিনি বলেন, সাভারের এমন একটা জায়গায় এ শিল্পটাকে নেয়া হয়েছে এবং সরকার এর দায়িত্ব দিয়েছে বিসিকের মতো অনভিজ্ঞ একটি প্রতিষ্ঠানকে, যা সরকারের মোটেও ঠিক হয়নি। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য উন্নত দেশ পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স ছাড়া কোনো পণ্য কিনবে না। ফলে বিশ্ববাজারে চামড়াশিল্প দাম পাচ্ছে না। গরু আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি উৎপাদন করছি। ফলে চামড়ার পরিমাণ বাড়তে থাকবে। সাভারে ট্যানারি পল্লীর বিষয়ে তিনি বলেন, সাভার ট্যানারি পল্লীতে চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। ওদের কোনো আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান নিয়ে ট্যানারিশিল্প গড়ে উঠেছে। তারা হচ্ছে সবাই ব্যাংকার। তাদের অনাদায়ী ঋণ হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। এমনকি এসব টাকা নিয়ে তারা কী করে তা কেউ জানেও না। কোনো রকমে একটা ফ্যাক্টরি খুলে রেখেছে। জীবনেও তার সম্প্রসারণ হচ্ছে না। অথচ এখানে ওখানে জায়গা কিনে রেখেছে। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় কিন্তু মানসিকভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়, এটা আর ব্যাংকে ফেরত দেবে না। কারণ এ টাকা দিয়ে তারা আসলে ব্যবসা করে না। করে অন্য কিছু। যে কারণে তাদের কাছে কোনো দিনও টাকা থাকে না। এ সেক্টরটাই হচ্ছে এখন পচা চামড়ার মতোই দুর্গন্ধময়। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সব সময়ই একটি আন্তর্জাতিক লেনদেনকে একটি ‘সেফটি ভাল্ব’ হিসেবে নেয়া উচিত। অর্থনীতিতে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। অর্থাৎ কোনো কারণে দেশে যদি অতিরিক্ত সরবরাহ হয় তবে রপ্তানি হবে বা কম সরবরাহ হলে আমদানি হবে। সুতরাং দুটোই সুরক্ষা ভাল্ব হিসেবে থাকবে (সো ইট ওয়াজ এ সেফটি ভাল্ব বথ ইজ)। কিন্তু আমরা যদি এটাকে বন্ধ করে রাখি- ‘আমরা এটা রপ্তানি করতে দেব না, ওটা রপ্তানি করতে দেব না’। তবে আমাদের এসব ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সমস্যা আরো প্রকট হবে। কাঁচা চামড়া রপ্তানির বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত আরো অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। এ ছাড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত কখনো বন্ধ করাই উচিত হয়নি। এ বছর দর কষাকষি এবং সিন্ডিকেশনই এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চামড়ার মান, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা, মসজিদ মাদ্রাসার এতিমরা। তাদের জন্য এ গল্প শেষ (এন্ড অব দ্য স্টোরি)। এখন এর লাভটা কে খাবে- এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কামড়াকামড়ি চলছে। অর্থাৎ চামড়া ব্যবসায়ীরা খাবে না ট্যানারি মালিক খাবে? অথচ এ লাভটা পাওয়ার কথা মসজিদ মাদ্রাসার। অথচ এখন ভাগাভাগি হচ্ছে দুটি পক্ষের মধ্যে। এক পক্ষ হচ্ছে- চামড়া রপ্তানি করলে লাভ বেশি পাবে। আরেক পক্ষ হচ্ছে- চামড়ার দাম কম হলেই আমরা কিনে নিতে পারব। লাভবান হবো। আর এ বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বারবার বৈঠকের তো কিছু নেই। সিদ্ধান্ত হয়েছে কাঁচা চামড়া রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে- এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চাপাচাপির মধ্যে পড়ে সরকারকে দোটানায় পড়তে দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতিকে যদি আমরা সচল গতিতে না চলতে দেই, তাহলে অসাধু মহল এসব থেকে লাভবান হবে। সুতরাং, এখন যদি সরকার বলে- আমরা কঠোরভাবে বলছি কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা যাবে। তাহলে আগামী বছর অন্ততপক্ষে চামড়ার দামটা ভালো থাকবে। নানা তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে, দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক খাত হচ্ছে চামড়া খাত। এক সময়ের পূর্ণ যৌবনা চামড়াশিল্পে হঠাৎ করেই ধস নামেনি। দীর্ঘ ৪-৫ বছর ধরে নানা অব্যবস্থাপনার কারণে এ শিল্পের আজ এমন দুরবস্থা। দেখা গেছে, গত প্রায় ৩০ বছর ধরে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত চামড়া কেনেন। অথচ তারা এখন বাংলাদেশ বিমুখ। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার কারণে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় এসব বিদেশি ক্রেতারা অন্যদেশ থেকে চামড়া কিনছেন। আর বর্তমানে সাভার ট্যানারি পল্লীর দুরবস্থার কারণে ইউরোপ আর আমেরিকার ক্রেতারা না থাকায় চীনের ক্রেতারা সুযোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের দিকে সরকার এক নোটিশে হাজারীবাগ থেকে ২২২টি ট্যানারি বন্ধ করে দেয়। দুই-তিন বছর সময় লাগে হেমায়েতপুরের ট্যানারিপল্লী স্থানান্তর হতে। বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মালিক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, পাঁচ বছর আগে হেমায়েতপুরে ট্যানারিপল্লী চালু করা হলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় পরিশোধন কেন্দ্র (সিইটিপি) এবং ডাম্পিংয়ের কাজ শেষ হয়নি। এমনকি অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়নও বাকি আছে। এ ছাড়া আমরা এখনো জমির লিজ বুঝে পাইনি। ফলে ব্যাংকঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আমরা মূলধারায় ফিরতে পারছি না। এজন্য ক্রেতারা চলে গেছেন অন্যত্র। তবে এখনো সুযোগ আছে। সরকার যদি আগামী এক বছরের মধ্যে সব সমস্যা সমাধান করতে পারে, তাহলে দুই বছরের মধ্যে আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরতে পারব। চামড়ার বাজারও চাঙা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App