×

মুক্তচিন্তা

৩৭০ ধারা বিলোপে কি কাশ্মির সংকট সমাধান হবে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৯, ০৮:১৮ পিএম

জম্মু-কাশ্মিরের জট এতই জটিল ছিল এবং পরিস্থিতি এতই স্পর্শকাতর ছিল যে, সে জট ছাড়ানোর প্রক্রিয়াটা একটু আড়াল রেখেই শুরু করার দরকার হয়তো ছিল। প্রথমে আটঘাট বেঁধে নিয়ে আচমকাই সরকারকে ঝাঁপাতে হতো তার সমাধানের লক্ষ্যে। সরকার সেই পথেই এগিয়েছে। কাশ্মিরের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য গণভোট যখন নেয়া যায়নি, তখন এ ছাড়া অন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া যেত কি?

নাহ! ভারতের কাশ্মিরে এবার বড় মসজিদগুলোতে ঈদ উপলক্ষে বহু মানুষের জমায়েত করতে দেয়নি প্রশাসন। স্থানীয় মসজিদেই সবাইকে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা পালন করলেন কাশ্মিরবাসী। কোন কাশ্মির? ভারতের অঙ্গরাজ্য জম্মু ও কাশ্মিরের একটি বিভাগ কাশ্মির। এই অংশ নিয়ে আজ তুমুল কলরব। ভারত তার অঙ্গরাজ্য জম্মু ও কাশ্মির থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নিয়েছে। যে কোনো পরিবর্তন কিছু মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। সেই বিক্ষোভ এড়াতে নিরাপত্তা আজ জোরদার এই অংশে। কিন্তু কাশ্মির সমস্যাটা কী? পুরোটা ক’জন জানেন? তাই আগে দেখা যাক কাশ্মির ইস্যুটা আদতে কী! কাশ্মির নামক ‘পিঠে’ ভাগাভাগি : ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ। লাদাখ অঞ্চল থেকে কাশ্মিরের ৩২ হাজার ৩৭৫ বর্গকি.মি. ছিনিয়ে নিল চীন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে চীন পাক পক্ষাবলম্বন করায় পাকিস্তান চীনকে দিয়ে দিল ৫ হাজার ১৮০ বর্গকি.মি.। ফলে চীন কাশ্মিরের ৩৭ হাজার ৫৫৫ বর্গকি.মি.র দখলদার। পাকিস্তানের দখলে ৭২ হাজার ৯৩৪ বর্গকি.মি.। ভারতের শাসনে ১ লাখ ৩৮৭ বর্গকি.মি.। ভারতের অংশের তিনটি বিভাগ- কাশ্মির (১৫ হাজার ৯৪৮ বর্গকি.মি.), জম্মু (২৫ হাজার ২৯৩ বর্গকি.মি.) ও লাদাখ (৫৯ হাজার ১৪৬ বর্গকি.মি.)। জম্মু অঞ্চল ও লাদাখ অঞ্চলের অধিবাসীরা মূলত সংখ্যাগুরু হিন্দু, বৌদ্ধ ও শিখরা অনেক দিন ধরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন দাবি করে আন্দোলন করছিলেন। এবারে ভারত সরকার ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে সে দাবি মেনে নিল। কাজেই আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার বলে যাদের কথা বলা হচ্ছে, সমালোচনার তীর ছোড়া হচ্ছে ভারতের দিকে। জনসংখ্যার বিন্যাস : এখনকার জনবিন্যাস এ রকম- ১. পাক শাসনাধীন কাশ্মিরের ৭২ হাজার ৯৩৪ বর্গকিমিতে বাস করে ৪৬ লাখ মানুষ। সবাই মুসলমান। ২. চীন শাসনাধীন কাশ্মিরের ৩৭ হাজার ৫৫৫ বর্গকিমিতে বাস করে আনুমানিক ৬ লাখ মানুষ। তারা প্রায় সবাই মুসলমান। পেশায় মেষ পালক। ৩. ভারত শাসনাধীন কাশ্মিরের তিনটি বিভাগ। প্রথম বিভাগ জম্মুর ২৫ হাজার ২৯৩ বর্গকিমিতে বাস করে ৫৪ লাখ মানুষ, যার ২২ লাখ মুসলমান ও ৩২ লাখ হিন্দু ও শিখ। দ্বিতীয় বিভাগ লাদাখের ৫৯ হাজার ১৪৬ বর্গকিমিতে বাস করে মোট ৩ লাখ মানুষ, যার ১ লাখ মুসলমান ও ২ লাখ বৌদ্ধ ও হিন্দু। তৃতীয় বিভাগ কাশ্মিরের ১৫ হাজার ৯৪৮ বর্গকিমিতে বাস করে ৭০ লাখ মানুষ, যার মধ্যে ৬৮ লাখ মুসলমান এবং ২ লাখ হিন্দু ও অন্যরা। বর্তমানে যত আলোচনা ও বিতর্ক চলছে তা এই কাশ্মির বিভাগের ১৫ হাজার ৩৪৮ বর্গকিমিতে বাস করা ৬৮ লাখ মুসলমানকে নিয়ে। পাক কাশ্মির বা চীন কাশ্মির নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। জম্মু বিভাগ ও লাদাখ বিভাগ তো বহুদিন আন্দোলন করছিল এই ৩৭০ ধারা তুলে এই দুই বিভাগকে কেন্দ্রীয় অঞ্চল ঘোষণা করা হোক। সেটাও হলো। তাহলে সমস্যা শুধু ভারতের কাশ্মির বিভাগ নিয়ে। কিন্তু কেন এই সমস্যা? ৩৭০ ধারা ও তার প্রয়োগ : ৩৭০ ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। ভারতভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করার সময়ে জম্মু-কাশ্মিরের তৎকালীন শাসক মহারাজা হরি সিংহ কিন্তু এই রকম কোনো সুনির্দিষ্ট শর্ত (৩৭০ ধারা) দেননি। ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’-এ কোথাও এই ধারার কথা উল্লেখ করা ছিল না। কিন্তু জওহরলাল নেহরু কাশ্মিরকে বিশেষ কিছু অধিকার দিয়ে সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযোজিত করেন। এই ধারাবলে জম্মু-কাশ্মিরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় (অনুচ্ছেদ ১ ব্যতিরেকে) এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেয়া হয়। কারণ যতক্ষণ না কাশ্মির বিতর্কের সম্পূর্ণ অবসান ঘটছে, শুধু ততক্ষণ পর্যন্তই অস্থায়ীভাবে ওই ধারা জারি রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল সে সময়ে। ৩৭০ ধারা এত বছর ধরে দেশের মধ্যে যেন আরো একটা পৃথক দেশ তৈরি করে রেখেছিল। প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে ভারতের আইন জম্মু-কাশ্মিরে প্রযোজ্য হচ্ছিল না। ৩৭০ ধারাকে হাতিয়ার করে জম্মু-কাশ্মিরের সরকার ৩৫ এ ধারা সে রাজ্যে পাস করিয়েছিল যে, দেশের অন্য কোনো রাজ্যের নাগরিক জম্মু-কাশ্মিরে জমি বা বাড়ি কিনতে পারতেন না। সে অধিকার ছিল না। ফলে জম্মু-কাশ্মিরে বাইরে থেকে কেউ বিনিয়োগ করতে পারছিলেন না, বড় শিল্প গড়ে উঠছিল না, অর্থনীতির উন্নতি ঘটানো যাচ্ছিল না। তবুও ভারতীয় জাতিসত্তা নয়, কাশ্মিরি জাতিসত্তার অভিমানে তারা গর্বিত ছিলেন। সে আঁতে এবার ঘা পড়ল। কেমন আছেন কাশ্মিরিরা : ভারতের জাতীয় গড় আয় ২৫ হাজার ৯০৭ টাকা। ভারতের কাশ্মিরের গড় আয় ১৭ হাজার ১৭৪ টাকা (ভারত সরকারের বার্ষিক কর্মসংস্থান বেকারত্ব জরিপ-২০১৯)। পাক অধিকৃত কাশ্মিরের নাগরিকদের গড় আয় ১৮৭ ডলার অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ১২ হাজার ৫৫৭ টাকা। ভারতের কাশ্মিরে শিল্প নেই। মূলত পর্যটন ও রাজ্যের বাইরে গিয়ে উপার্জন করতে হয় তাদের। অথচ শিল্প থাকলে এই রাজ্যের মানুষের গড় আয় জাতীয় গড় আয়কে সহজেই অতিক্রম করে যেত। পাক অধিকৃত কাশ্মিরের অবস্থা খুবই খারাপ। সেই কারণে গত বছর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল পাক অধিকৃত কাশ্মির। অভিযোগ ছিল, সরকারি ছত্রছায়াতেই জঙ্গিদের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে ওই অঞ্চল। রীতিমতো জঙ্গি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে অধিকৃত কাশ্মির। এসবের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালছে ইসলামাবাদ। কিন্তু পাক কাশ্মিরে না আছে শিক্ষা, চিকিৎসা, না রাস্তাঘাট, বাড়ছে বেকারত্ব। রাওয়ালকোট, তারার খেলসহ একাধিক আন্দোলনে জনসমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। আন্দোলনকারীদের আরো বক্তব্য, ৯/১১-এর পর থেকেই অধিকৃত কাশ্মিরে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছে লস্কর ও জইশের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো। তারা সংবাদ মাধ্যমকে আরো বলেন, প্রতিদিন লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। নিরাপদ নন নারী ও শিশুরা। মৃত্যু উপত্যকার অন্য নাম কাশ্মির : ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাশ্মিরে জঙ্গি হামলায় ১ হাজার ৩১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৮ জন সাধারণ নাগরিক (১০.৪৯ শতাংশ), ৩৩৯ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য (২৫ শতাংশ) এবং ৮৩৮ জন সন্ত্রাসবাদী (৬৩.৭২ শতাংশ)। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট বলছে, ২০১৪ সালে জম্মু-কাশ্মিরে ২২২টি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছিল। পরের বছর ২০১৫ সালে তা কিছুটা কমে, ওই বছরে ২০৮টি হামলার ঘটনা ঘটে। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে হামলার ঘটনা ফের বাড়তে থাকে। ওই বছরে সংখ্যাটা হয় ৩২২। ২০১৭ সালে ৩৪২টি হামলার ঘটনা ঘটে, ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ৬১৪টি অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৫১টি জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু কেন এই জঙ্গি হানা? মদদ দিচ্ছে কে? এ কথা সবাই জানেন। পাকিস্তান। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের সাম্প্রতিকতম ডেমোক্রেসি ইনডেক্স ২০১৮তে বলা হয়েছে, শেষ পাঁচ বছরে পাকিস্তানের ডেমোক্রেসি ইনডেক্স ১০ শতাংশ ভেঙে পড়েছে। সেই সময়ে জঙ্গি হামলা প্রায় ১৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্ম থেকে শুরু করে হিংসা- পাকিস্তানের সব আলোচনা কাশ্মিরকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে। ‘জিহাদের’ নাম দিয়ে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে অঘোষিত যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। ১৪ ফেব্রুয়ারির পুলওয়ামা জঙ্গি হামলা, যে হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান শহীদ হয়েছে। এই হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে জইশ-ই-মুহাম্মদ। এই জঙ্গিগোষ্ঠী কিন্তু পাকিস্তানের মাটিতে বেশ সক্রিয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, কাশ্মিরে সন্ত্রাসবাদ জারি রাখতে পাকিস্তান প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করে। ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়া টুডেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পারভেজ মোশারফ জানিয়েছিলেন, আইএসআই লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। ভারতের মাটিতে সন্ত্রাসবাদ সেদিনই বন্ধ হবে যেদিন ভারত কাশ্মির সমস্যার সমাধান করবে। এভাবে আর কত দিন? : সব কিছুর একটা শেষ হওয়া দরকার ছিল। জম্মু-কাশ্মিরের জট এতই জটিল ছিল এবং পরিস্থিতি এতই স্পর্শকাতর ছিল যে, সে জট ছাড়ানোর প্রক্রিয়াটা একটু আড়াল রেখেই শুরু করার দরকার হয়তো ছিল। প্রথমে আটঘাট বেঁধে নিয়ে আচমকাই সরকারকে ঝাঁপাতে হতো তার সমাধানের লক্ষ্যে। সরকার সেই পথেই এগিয়েছে। কাশ্মিরের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য গণভোট যখন নেয়া যায়নি, তখন এ ছাড়া অন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া যেত কি?

অমিত গোস্বামী : কবি ও প্রাবন্ধিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App