×

অর্থনীতি

কাঁচা চামড়া রপ্তানিতে কার লাভ, কার ক্ষতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০১৯, ১১:৫১ এএম

কাঁচা চামড়া রপ্তানিতে কার লাভ, কার ক্ষতি
কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্তে আড়তদাররা খুশি হলেও ট্যানারি মালিকরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। পাশাপাশি চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরিয়ে নিতে চলছে নানা আলোচনা। এদিকে সরকারের দেরিতে এমন সিদ্ধান্তের ঘোষণায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন তারা। কারণ তারা ইতোমধ্যে যথেষ্ট কম দামে ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া বিক্রি করেছেন। তাই এখন চামড়ার দাম বাড়লেও সাধারণ মানুষের কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশের অনেক মাদ্রাসা এবং এতিমখানা কুরবানির পশুর চামড়ার ওপর নির্ভর করে। অনেকে তাদের জবাই করা পশুর চামড়া বিনামূল্যে মাদ্রাসা এবং এতিমখানায় দান করে। সে চামড়া বিক্রির মাধ্যমে মাদ্রাসাগুলো অর্থ উপার্জন করে। এবার চামড়ার দাম নিম্নগামী হওয়ায় মাদ্রাসাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখন সরকার রপ্তানির অনুমোদন দিলেও মাদ্রাসাগুলোর কোনো লাভ হবে না। তবে অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ মনে করেন, সরকারের এ পদক্ষেপের সুফল আগামীতে পাওয়া যাবে। কুরবানি ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ পশুর চামড়া। ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী কুরবানিকৃত পশুর চামড়ার ওপর হক থাকে এতিম-মিসকিনদের। অথচ এ চামড়া নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় অনেক জায়গায় চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলে, নদীতে ভাসিয়ে নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চামড়া রপ্তানি করে লাভবান হবেন পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। জানা গেছে, ট্যানারি মালিকদের কাছে বিগত কয়েক বছরের চামড়া বিক্রির টাকা বাকি থাকায় কাঁচা চামড়া রপ্তানিতে আগ্রহী পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। আড়তদাররা মনে করেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা হলে ট্যানারি মালিকদের কাছে বছরের পর বছর টাকা বাকি রাখতে হবে না। আর দেশের মানুষও চামড়ার ন্যায্যমূল্য পাবেন। তবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ কাঁচা চামড়া রপ্তানি হলে তাদের আর প্রয়োজন পড়বে না। ফলে তারা বেকার হয়ে যেতে পারেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্ক্রিন মার্চেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি হাজি দেলোয়ার হোসেন বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে আমরা খুশি হয়েছি। ইতোমধ্যে বাইরে থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। তবে আমাদের লাইসেন্স না থাকায় কিছুটা সমস্যায় পড়তে হবে। তিনি বলেন, সরকার ইচ্ছা করলে ১০-১৫ দিনের মধ্যে লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা হলে কোনো ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে মনে করেন তিনি। পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ী নিজামুল হক এন্ড সন্সের মালিক নিজামুল হক বলেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানিতে আমরা অবশ্যই উপকৃত হব। তবে সরকার নাকি ব্যবসায়ীরা রপ্তানি করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। সরকার আমাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে রপ্তানি করলে বেশি উপকৃত হবো। তবে এতে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, চামড়া রপ্তানি হলে এই সেক্টরের শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ছাড়া ফিনিশড চামড়া তৈরির জন্য অনেকে বিদেশ থেকে মেশিন কিনে এনেছেন। এগুলোর কী হবে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে শান্তিনগর বাজার মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের কমিটির পক্ষে মুফতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, এ বছর ৫১৩টি কুরবানির গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, ঢাকা হাইড নামে ট্যানারির কাছে এ চামড়া দেয়া হয়েছে। তবে ওই ট্যানারির কাছে গত বছরের চামড়ার দামও পাওনা রয়েছে বলে তিনি জানান। মুফতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, কাওমি মাদ্রাসায় বছরের বেশিরভাগ খরচ এই চামড়ার টাকায় হয়। অথচ গত কয়েক বছর ধরেই চামড়ার নির্ধারিত দাম তো পাওয়া যায়ই না, আবার যে দাম দেয়, সেটাও সঠিক সময়ে পাই না। সরকারের কাঁচা চামড়া রপ্তানির বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার এমন সিদ্ধান্ত আরো আগে কেন নেয়নি? তাহলে তো মানুষ অসহায় হয়ে চামড়া এভাবে ফেলে দিত না। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এতিম মিসকিনরা। তিনি বলেন, যাই হোক এর সুফল আগামীতে পাওয়া যাবে, এটাই এখন ভরসা। তবে যদি মাদ্রাসাগুলোতে চামড়া সংরক্ষণ করার কথা বলে তবে সেটা সমস্যা হবে বলে মনে করেন এই ইমাম। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত জায়গার যেমন অভাব, তেমনি কুরবানি ঈদে লবণের দামও থাকে চড়া। সিপিডির সিনিয়র গবেষক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সার্বিক বিবেচনায় এই বিপুল পরিমাণ চামড়া দেশের ভেতর ব্যবহারের সুযোগ সীমিত। সুতরাং ব্যবসায়ীরা চাইলেও এত চামড়া কিনে দেশের ভেতর ব্যবহার করার মতো অবস্থা তাদের নেই। তিনি বলেন, ঈদের দিন থেকে যদি আমরা দেখি, তবে দেখা যাবে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হচ্ছে, নদীতে ফেলে দেয়া হচ্ছে, অথবা রাস্তায় ফেলে দিলেও কেউ তা সংগ্রহ করছে না। এতে করে বোঝা যায়, আসলে ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ চামড়া ব্যবহার করার সামর্থ নেই। ফলে সরকারের চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে যোক্তিক বলেই মনে হয়। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল, দেশের উৎপাদন ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে চামড়া রপ্তানির বিষয়ে আরো আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া। এখন চামড়া রপ্তানি করা হলেও সাধারণ মানুষ তার সুফল পাবে না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ট্যানারি মালিকরা এতদিন; আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা নেই, ট্যানারিগুলোতে আগের বছরের ৫০ শতাংশ চামড়া অবিক্রিত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থায় এত চামড়ার চাহিদা নেই, চামড়া কেনার জন্য পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায়নি এসব নানা অজুহাত দেখিয়ে কাঁচা চামড়া কেনার প্রতি অনাগ্রহ দেখায়। আর এ কারণে সারাদেশে এবার কুরবানির কাঁচা চামড়া বিক্রিতে ধস নামে। এতে করে অনেক স্থানে একটি মাঝারি সাইজের গরুর চামড়া মাত্র ৫০ টাকায়ও বিক্রির কথা জানা গেছে। আবার কোনো কোনো এলাকায় চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে কিংবা নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত ১৩ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে না। তাই চামড়ার উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হবারও আহ্বান জানানো হয়। সরকারে এমন সিদ্ধান্তে ট্যানারি মালিকরাও ইতোমধ্যে নড়ে চড়ে বসেছেন। বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন (বিটিএ) ও বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এন্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) গত বুধবার আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসারও দাবি জানিয়েছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্তে এখনো অটল রয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে সিনিয়র বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম জানান, চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। এখনো এ বিষয়ে সরকার অটল আছে। তিনি বলেন, দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প উন্নত হউক। সেজন্য আমরা প্রথমে ওয়েড ব্লু চামড়া আগে রপ্তানির অনুমতি দেব। এরপর পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনে লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App