×

সাময়িকী

সন্তান কখনো অবৈধ হয় না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০১৯, ০৮:০১ পিএম

ঘুম আসছে না রাত্রির। উঠে গিয়ে ডাইনিং থেকে পানি খেয়ে এলো। ফ্রিজ খুলে দেখলো এক ফোঁটা ঠাণ্ডা পানিও নেই। কঠিন ঠাণ্ডা পানি না হলে তৃষ্ণাই মিটে না রাত্রির। আর এখনতো গলা একদম চৈত্রের মাঠের মতো হয়ে আছে। অগত্যা ফিল্টার থেকে নিয়ে একগ্লাস পানি খেয়ে বোতল ভরে ফ্রিজে রেখে আবার ঘুমোতে গেল। এপাশ-ওপাশ করছে। ঘুম যেন আরাধ্য হয়ে উঠেছে আজকাল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় শেষের পথে। আরেকটু পর হয়তো ফজরের আজান দিবে। চারদিকের বাড়িগুলোতে সব ঘুমন্ত মানুষ। ঝিঁঝিঁ ডাকা অন্ধকার। দরজা খুলে বারান্দার চেয়ারটাতে এসে বসে রাত্রি। হঠাৎ করেই প্রচণ্ডবেগে কান্না পেয়ে গেলো। ইদানীং প্রায় এটা হচ্ছে। যখন তখন কান্না চলে আসে। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না। অথচ কত হাসিখুশি ছিল তার আগের দিনগুলো। চঞ্চলা হরিণীর মতো ছুটে চলতো। বন্ধু, আড্ডা, খানাপিনা চলতো প্রায়শই। প্রতি সপ্তাহে আড্ডা না দিলে দম বন্ধ করা লাগতো। সেসবের কিছুই করছে না রাত্রি। কেবল একাকিত্বকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে।

পেটের ভিতরে বাড়তে থাকা আরেকটি প্রাণ নড়ে উঠলো যেন। আস্তে করে পেটের ওপর হাত রাখলো রাত্রি। অনুভব করলো যেন আরেকটি অস্তিত্বকে। মুহূর্তেই নিজেকে ফিরে পেলো। চোখের পানি মুছে নিলো যেন সে দেখতে না পায়, কষ্ট না পায়। যে আসছে তার কী দোষ। সেতো কোনো অপরাধ করেনি যে দুনিয়া দেখার আগেই সে কষ্ট দেখতে শিখবে। না। আমি তোকে কখনো কষ্টের দুয়ারে প্রবেশ করতে দিবো না। পেটের উপরে হাত রেখে নিজেই বলে চলে রাত্রি। তুই আমার একমাত্র অবলম্বন। এই নিষ্ঠুর, নির্দয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রেরণা। ভালোবাসাহীন দুনিয়ায় তুই আর আমি হবো একে অপরের ভালোবাসার সাথী। তোর জন্মদাতা কেবল আমি। আর কারো ভাগ নেই তোর উপর। দাবিও নেই। হয়তো তুই ভাবছিস, অভিমানও করতে পারিস। কেন তোর মা তোকে তোর বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে। ভাবছিস তো? ভাবিস। ভাবতে তোকে হবেই, মা। না ভাবলে যে তুই সত্য থেকে দূরে থাকবি। এই যে তোর মা একা একা রাত যাপন করছে। নির্ঘুম রাত পার করছে এর পিছনের কারণগুলো তোকে জানতে হবে সোনা। না জানলে যে তুই নিজে ছোট হয়ে যাবি। তবে আমি জানি না সত্য জানলে তুই আমাকে কী বলবি। খারাপ জানবি না ভালো? জানি না আমি। জানতেও চাই না। আমি নিজে যেটাকে ভালো বলে মনে করেছি এবং নিজে যা বিশ্বাস করি সেটাকেই প্রতিষ্ঠা করবো বলে আজ তোকে আমি বয়ে চলেছি। আমার মাঝে ঠাঁই দিয়েছি তোর অস্তিত্বকে। রিফাত। তোর বাবা!! না, আমি তাকে তোর বাবা বলে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই না। কারণ যে তার সন্তানকে স্বীকার করতে চায় না সে কেমন করে বাবা হতে পারে? একফোটা স্পার্মের মালিকায় কেউ পিতা হয়ে উঠতে পারে না। মানি না আমি এই নিয়ম। হয়তো রিফাত আর আমি কাগজে কলমে সই করে সংসার পাতিনি। একই ছাদের নিচে থাকা হয়নি আমাদের। কবুল বলে লোকালয়ে কণ্ঠ বাড়াইনি। তবে কী হয়েছে? তারচেয়ে কি কম ছিল আমাদের দুজনের সম্পর্ক?

ভালোবেসেছিলাম একে অপরকে। ভালোবাসার মাঝেতো কোনো ফাঁক ছিল না। না রিফাতের ছিল, না আমার ছিল। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জেনেবুঝে কাছে এসেছিলাম আমরা। বিশ্বাস যেখানে সম্পর্কের ভিত সেখানে কাগজে কলমের সইতো বাহানা মাত্র। এ সমাজে বিয়ে মানে অপরিচিত দুটি মানুষকে যৌন সম্পর্ক তৈরি করার আইনি স্বীকারোক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন সমাজ ছিল না যখন নারী-পুরুষের মাঝে বিয়ে নামক বিষয়টি ছিল না তখনো কি নরনারীর শারীরিক মিলন বন্ধ ছিল? না। ছিল না। সমাজ সৃষ্টি হলো আর তার জন্য দরকার হলো কিছু নিয়ম কানুনের কাঠামো। বিয়েতো তেমনি একটি বিষয়। কাগজে সই করে যাদের বিয়ে হয়, হাজার হাজার লোক দেখানো বিয়েতেই কী সুখ আসে? ভালোবাসা থাকে? প্রেম থাকে? হৃদ্যতা থাকে? যুগ যুগ ধরে কি একই মানুষের সাথে বিশ্বাস ধরে রাখা যায়? যায় না। ভালোবাসার মানুষের সাথে যদি শারীরিক সম্পর্ক হয় তবে সেখানে কেন পাপ পুণ্যের হিসাব আসবে? সেই সম্পর্কের পরিণতি যদি হয় আরেকটি প্রাণের সৃষ্টি তবে তাকে কেন অস্বীকার করা হবে? প্রেম কখনও পাপ পুণ্যের হিসাবে হয় না। সে প্রেম প্রেম হয় না। হয় হিসেবি সম্পর্ক। আমার আর রিফাতের মধ্যে ছিল আস্থা ও বিশ্বাসের এক দৃঢ় বন্ধন। কাছে এসেছিলাম দুজনের সমান সম্মতিতেই। মিলিত হয়েছিলাম দুজনেরই ইচ্ছায়। অথচ রিফাত আমার মাতৃত্বকে মেনে নিতে পারেনি। যেদিন জেনেছিলাম তুই আসছিস আমাদের দুনিয়ায় প্রথমে ভয় ও আতংকে কিছুদিন স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। কী করবো এখন আমি? নষ্ট করে ফেলবো? রিফাতকে জানিয়েছিলাম। সে চিতকার করে উঠেছিলা। সে এক অন্য রিফাতের চেহারা দেখেছিলাম আমি। আতংকিত হয়ে বলেছিল, না এ বাচ্চা রাখা যাবে না। কালকেই ডাক্তারের কাছে চলো। আমি এ দায়িত্ব নিতে পারবো না। বুঝেছিলাম সে ভয় পেয়েছে। দায়িত্বের ভয়, সমাজ সংসারের ভয়। লোকলজ্জার ভয়। বলেছিলাম চলো বিয়ে করে ফেলি তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজি হয়নি। কেন রাজি হয়নি আজো জানি না আমি। দিনের পর দিন ঝগড়া চলছিলো আমাদের। আমি রাতদিন কেবল কাঁদি। রিফাতের ভালোবাসাকে অস্বীকার করবো সে সাহস আমার নেই। তবে কেন পারেনি রিফাত? সমাজের কাছে কি তবে আমাদের দুজনের চাওয়াগুলো হেরে যাবে? রিফাত কি তবে আমাকে ঠকিয়েছে? সংশয় আসে মনে তবে রিফাতকে মুছে ফেলতে পারবো না আমি। ঢাকা থাকি এক বন্ধুর সাথে ফ্ল্যাট ভাড়া করে। বাড়িতে কাউকে জানানো যাবে না। বন্ধুটি পরামর্শ দিলো টেনশন করিস না। যা হবার হবে। কেন তুই এত চিন্তা করছিস? দুজনেই সচেতন তোরা। তবে আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এখন যা হয়ে গেছে। কেঁদেকেটে আর কী হবে? ভালোবাসার প্রতিদান পেয়েছিস। এখন বাচ্চার দায়িত্ব নেয়ার জন্য রেডি হ। এ সমাজ একজন অবিবাহিত নারীর মা হওয়াকে কোনোভাবেই মেনে নিবে না। রিফাতের ক্ষমতা নেই এর বিপরীতে যেয়ে তোর অবলম্বন হবে। চিনে নিতে শিখ। স্বপ্না অনেক করে বকেছিল আবার বুকে টেনে বুঝিয়েও ছিল। স্বপ্না বলেছিল, সন্তানের কোনো অপরাধ নেই। একটা প্রাণ জন্ম দিয়েছিস তোরা দুজনে মিলে। স্বজ্ঞানে, সচেতনে। তাহলে কেন তাকে মেরে ফেলবি? সাহস রাখ। নিজেকে শক্ত কর। নুতুপুতু হলে চলবে না। কেউ এগিয়ে আসবে না। রিফাতের কাছ থেকে আর চাওয়ার কিছু নেই। স্বার্থপরতার এক মারাত্মক উদাহরণ দিলো রিফাত। সন্তান কখনো অবৈধ হয় না। ভালোবাসা কখনো বৈধ-অবৈধতার নিয়ম মেনে চলে না। সুতরাং সেই ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ফল কোনোদিন অবৈধ বা পাপ হতে পারে না। রিফাত তার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি কিন্তু তুইতো সমস্ত দিয়েই ভালোবেসেছিলি। তোর মনে কোন দ্বিধা ছিল না। কেবল কবুল বলা হয়নি বলেই যদি সন্তানকে অস্বীকার করতে হয় তবে সেই কবুল না পড়াই ভালো।

সেদিনের পর থেকে তোর মা তোকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখে আসছে আমার কলিজা। স্বপ্নার চেষ্টায় একটা চাকরিও পেয়েছি আমি। স্বপ্না চলে গেছে অন্য আরেক দেশে। সেও একাকী জীবন বেছে নিয়েছিল কোনো এক রিফাতের কাছ থেকে স্বপ্নভঙ্গের পরেই। আমিও বিশ্বাস করতে শিখেছি সন্তান কখনো অবৈধ হতে পারে না। সমাজ তোকে খাওয়াবে না পরাবেও না। আমি যদি দায়িত্ব নিয়ে তোকে বড় করতে পারি তবে সমাজের কী যায় আসে? বিয়ের পর বাচ্চা হয়েও কি সব সংসার টিকছে? সব মেয়েরাই কী আর সুখী হতে পারছে? সব সন্তান কি তার পিতার আদর পেয়ে বড় হয়ে উঠছে?

তুই একদিন আসবি এই দুনিয়ায়। আমার কোলে মাথা রাখবি। মা বলে ডাকবি। সেদিনের সেই সুখটুকুই আমাকে পারে সকল না পাওয়ার বেদনাকে মুছে দিতে। তোর নাম তাই দিয়েছি আমি ‘সেতু’। তুই আমার আর রিফাতের ভালোবাসার মাঝে সেতু হয়ে এসেছিলি। আফসোস রিফাত সেটিকে রক্ষা করতে পারেনি কিন্তু আমি পারবো। তোর আর আমার মাঝে কোনদিন কোন বন্ধনের অভাব হতে দিস না সোনাই। তুই আমার একমাত্র ভরসা হয়ে থাকিস। তোকেও যে বড্ড ভালোবাসি আমি। একটি বৈধ ভালোবাসা তোকে অবৈধ বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আমি বেঁচে থাকতে সেটা হতে দিবো না। তুই আমার বৈধ অবৈধ হিসাবের ঊর্ধ্বের প্রাণভোমরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App