×

মুক্তচিন্তা

বাকশাল প্রেক্ষাপট ও সমালোচনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৩৩ পিএম

বাকশাল প্রেক্ষাপট ও সমালোচনা
বাকশাল প্রেক্ষাপট ও সমালোচনা

সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত, অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত মাঝারি র‌্যাংকের পদাধিকারীরা এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে সিনিয়র মাস্টারমাইন্ডরা পর্দার অন্তরালেই রয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন জার্মানিতে থাকার কারণে বেঁচে গেছেন। এটি ছিল শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড এবং প্রতি বছর জাতীয় শোক দিবস হিসেবে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।

বাকশাল কর্মসূচি বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে কি দেশে কোনো খারাপ কিছু হয়েছিল? প্রশ্নটি অবান্তর কারণ বাকশালের কর্মসূচি কখনো বাস্তবায়িতই হয়নি। যে কর্মসূচি কখনো বাস্তবায়িতই হয়নি তা নিয়ে সমালোচনা জনমনে নিশ্চয়ই কৌতূহলের জন্ম দেয়। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ জুন সর্বদলীয় জাতীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ১১৭-ক অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি নতুন জাতীয় দল গঠন করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, যা একদিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সংঘটিত নানাবিধ অনাচার প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেবে, অন্যদিকে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর জাতি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করবে। এরূপে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি জাতীয় দল গঠন করে এর নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। বাকশালের বিধিবিধানে বিভিন্ন সরকারি চাকুরে ও সেনাবাহিনীর সদস্যসহ অপরাপর সব দল ও সংগঠনকে জাতীয় দলে যোগ দিয়ে অপশক্তির মোকাবেলা করা এবং দেশ পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা বলা হয়। বাকশালের বিভিন্ন দিক, কার্যক্ষেত্র এবং সম্ভাবনা সবিস্তারে বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এই উদ্যোগকে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। প্রসঙ্গক্রমে বাকশাল ঘোষণার সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট আলোচনা করা যেতে পারে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে অফিসিয়াল হিসাবের সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, শুধু ১৯৭৩ সালেই বিভিন্ন ধরনের গুপ্ত ও সশস্ত্র হামলায় ১৮৯৬ জন মানুষ নিহত হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে পাটের কলে ও গুদামে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নৈরাজ্যকর অবস্থার দিকে মোড় নিচ্ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনীয় মাধ্যমে জরুরি অবস্থা জারির বিধান পাস করা হয়। দ্বিতীয় সংশোধনী পাস হওয়ার পরপরই রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মোহাম্মদুল্লাহ ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ১৯৭৪ সালে একজন জাতীয় সংসদ সদস্যকে (এমপি) হত্যা করা হয়। এমনকি জরুরি অবস্থা জারির পরও পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। জরুরি অবস্থা থাকাকালেও ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুজন এমপিকে হত্যা করা হয়েছিল। সার্বিক অবনতিশীল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান, সরকারের শ্রেণি-বিভাগ, গভর্নেন্স, গণমাধ্যম ও দলীয় ব্যবস্থা নিয়ে সিরিয়াস ধরনের চিন্তা-ভাবনা করতে বঙ্গবন্ধুর সরকার বাধ্য হয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত গোষ্ঠী এবং সরকারের প্রতি আগে থেকেই অসন্তুষ্ট (জাসদ, সর্বহারা পার্টি এবং রাজাকার, আল বদর প্রভৃতি) গোষ্ঠী এই পদক্ষেপে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে পুনর্গঠন ও সম্পূর্ণ নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করে স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে পাস করে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীতে বিধান রাখা হয় যে, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বাকশালে যোগদান না করে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকতে পারবেন না। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন ও সংস্থার স্থলে একক দল হিসেবে নবগঠিত জাতীয় বাকশাল ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে সরকারিভাবে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। বাকশাল পদ্ধতির বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে একটি ছিল সংবাদপত্র অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে জারিকৃত এই অধ্যাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকনায় মাত্র চারটি সংবাদপত্র প্রকাশনার ব্যবস্থা রেখে অন্য সব পত্রপত্রিকা প্রকাশের অনুমতি বাতিল করা হয়। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বাকশালের চেয়ারম্যান হিসেবে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ নামে দলের পাঁচটি অঙ্গ সংগঠনকে মনোনয়নদান করা হয়। নির্বাহী কমিটির সদস্যরা মন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগের অধিকারী ছিলেন। দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে গণমুখী করার লক্ষ্য ঢেলে সাজানোই ছিল বাকশাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। বাকশালের একটি বড় লক্ষ্য ছিল দেশের প্রভাবশালী আমলাতন্ত্রের সংস্কার সাধন। নতুন ব্যবস্থায় পুনর্গঠিত আমলাতন্ত্রকে দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছিল। এর একটি ছিল জাতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং অপরটি জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল। এই ব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রতিটি মহকুমাকে একজন নির্বাচিত গভর্নরের অধীনে জেলায় রূপান্তরের বিধান রাখা হয়। জেলার সংসদ সদস্যরা, বাকশালের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট জেলার বেসামরিক, পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হবে জেলা প্রশাসনিক কাউন্সিল। গভর্নর হবেন জেলার প্রধান নির্বাহী এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হবেন গভর্নরের সচিব। উদ্দেশ্য ছিল, জেলা গভর্নর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শোষণমূলক ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রশাসনকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে জেলা গভর্নর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শোষণমূলক ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রশাসনকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং স্বাধীনতাকে তাদের কাছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অর্থবহ করে তোলা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে বাকশালের পরিকল্পনায় ব্যাপকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দেশপ্রেমিক জনগণের এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বাকশাল ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য স্থায়ীভাবে মঙ্গল বয়ে আনত। কিন্তু দেশের জন্য স্থিতিশীলতা ও দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যে কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন বাস্তবায়নের আগেই হত্যার মধ্য দিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলেও তিনি চিরদিন বাঙালির মনে এবং তাঁর প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশে বেঁচে থাকবেন। মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়নি। বাঙালিদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার বিরোধিতার সূত্রপাত ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় (মার্চ ২৫, ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১ পর্যন্ত) থেকেই। আগস্ট মাস বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি শোকের মাস, বিশেষত যারা অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে। যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড আমরা পেতাম না, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের তাঁর ব্যক্তিগত বাসভবনে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত, অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত মাঝারি র‌্যাংকের পদাধিকারীরা এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে সিনিয়র মাস্টারমাইন্ডরা পর্দার অন্তরালেই রয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন জার্মানিতে থাকার কারণে বেঁচে গেছেন। এটি ছিল শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড এবং প্রতি বছর জাতীয় শোক দিবস হিসেবে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App