×

সাময়িকী

নতুন কাব্য চিন্তাশৈলীর পথ প্রদর্শক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০১৯, ০৮:০৭ পিএম

কবি আবুল হোসেন জীবনব্যাপী একটি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়েছেন, তিনি লক্ষ্যের মাঝে পথ চলাকেই মনে করেছেন জীবনের গতি। তার কবিতা তাইতো কখনো জরাগ্রন্থ হয়ে ওঠেনি। তিনি খুব কম লিখলেও কবিতাকে করেছেন নিজস্বতায় সমুজ্জ্বল

বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক ধারার কবিদের অন্যতম কবি আবুল হোসেন আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিরিশের বাংলা কবিতার কবিদের মধ্যে যে ক’জন স্বল্পসংখ্যক বাঙালি মুসলমান কবির আবির্ভাবে বাংলা কবিতা আধুনিকতার ছোঁয়া লাভ করেছিল কবি আবুল হোসেন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনিই আধুনিক কবিতার অন্যতম দিকপাল ও মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক মননের কবি।

বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে ঘটনাবহুল দশকে আবুল হোসেন আবির্ভূত হন নতুন যুগের বাণী নিয়ে। তার কবিতায় বেজে ওঠে নববসন্তের নতুন বার্তা। তার কবিতা তৎকালীন কবিতার ভাষা ও স্বকীয়তাকে অতিক্রম করে একটা নিজস্ব ভাষা ও গতিময়তার পথে নতুন সন্ধানে এগিয়ে গেছে। তার কবিতায় বসন্ত এসেছে নতুন জাগরণের দ্যোতনা নিয়ে। সম্পূর্ণ নতুন কাব্য ভাষায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নববসন্ত’ (১৯৪০) প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র ১৮ বছর বয়সে। বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও মহামন্বন্তর থেকে বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলি তার নববসন্তে ধরা পড়েছে। তৎকালীন বুলবুল পত্রিকার সম্পাদক হাবীবুল্লাহ বাহারের তাগাদায় এবং বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, আবু সায়ীদ আইয়ুবের আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে নববসন্ত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নতুন কবিদের দৃষ্টি ও দুঃসাহসিক কাব্য ভাষার সৃষ্টি বাংলা কবিতার নতুন পথ নির্মাণ করেছিল।

আধুনিক নাগরিক কবি আবুল হোসেন কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে সাহচর্য পেয়েছিলেন বাংলা কবিতার যুগস্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দও, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, আবদুল কাদির, হুমায়ূন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সায়ীদ আইয়ুব প্রমুখ কবি ও সমালোচকদের। আবুল হোসেনের বিখ্যাত কবিতা ‘ডি এইচ রেলওয়ে’ পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের আমলে।

কবি আবুল হোসেন জন্মেছিলেন খুলনার ফকিরহাটের আড়ডাঙ্গা গ্রামে ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট। একই দিনে জন্মেছিলেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক মননের লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্ল্যাহ। দুজনের মধ্যে পরবর্তীতে গভীর বন্ধুত্বের সখ্য গড়ে ওঠে। কবি আবুল হোসেন জীবনব্যাপী একটি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়েছেন, তিনি লক্ষ্যের মাঝে পথ চলাকেই মনে করেছেন জীবনের গতি। তার কবিতা তাইতো কখনো জরাগ্রন্থ হয়ে ওঠেনি। তিনি খুব কম লিখলেও কবিতাকে করেছেন নিজস্বতায় সমুজ্জ্বল, যথেষ্ট আত্মশক্তিতে উজ্জ্বল। প্রৌঢ়ত্বে এসেও তিনি কবিতার আত্মচেতনায় ছিলেন বলীয়ান। কবিতায় উচচারণ করেছেন- ‘কারো দান নয়, যা পাওয়ার আমাকেই পেতে হবে।’ কবি সারাজীবন ধরে সত্য পথ অন্বেষণের পাশাপাশি গভীর নিবিড়তায় সত্য পথের সন্ধানী ছিলেন। প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি দিয়ে অনুভূতি, দিয়ে প্রতিটি পথ ফেলেছেন সযতনে।

কবি আবুল হেসেনের গ্রন্থ সংখ্যা ৩০. কাব্যগ্রন্থ- নববসন্ত (১৯৪০), বিরস সংলাপ (১৯৬৯), নব বসন্ত নবপর্যায় (১৯৭৭), হাওয়া তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২), দুস্বপ্ন থেকে দুস্বপ্ন (১৯৮৫), এখনও সময় আছে (১৯৯৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৭), কবিতা সংগ্রহ (২০০০), আর কিসের অপেক্ষা (২০০০), শাহানের বই (২০০০), রাজ কাহিনী (২০০৪), স্মৃতিকথা- আমার এই ছোট ভুবন (২০০০), আর এক ভুবন (২০০৫), অনুবাদ উপন্যাস ‘অরণ্যের কাছে’ ও ভ্রমণ কাহিনী ‘পার্বত্যপথে’ অন্যতম।

কবি আবুল হোসেন কবিতাকে নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষণের সঙ্গী করে চলেছেন জীবনযাপনে। কখনো অবহেলা করেননি বলেই তিনি অন্যদের চাইতে একটু আলাদা একটু স্বতন্ত্র অবয়বে নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছেন। জীবনে কী পেলাম আর কী পেলাম না তার অনুশোচনা ছিল না কখনো। তাইতো কবিতায় উচ্চারণ করেছেন অকপটে-

‘বুকের পকেটে ছিল যা টাকা ও সোনা

কিছু বাস্তব, খানিকটা কল্পনা

গলিয়ে এসেছি সাদামাটা কিছু ছবি

দিয়েছি আমার যা ছিল দেবার সবই।

দিয়েছি অনেক সংশয় সংকোচে

করিনি কখনো এতটুকু অবহেলা’

(এতকাল খেলেছি লেখার লেখা- আবুল হোসেন)

কবি আবুল হোসেনের কাছে পথ চলা মানে অন্বেষণ, পথ চলার পথের সন্ধানে ছুটে চলা আজন্ম কাম্য ছিল। তিনি শুধুই বলতেন, আমি চিরকাল অন্বেষণ করে যাবো, কিসের অন্বেষণে সত্যের অন্বেষণ, সেই আমার অন্য পথ। পথের ভাবনার পাশাপাশি কবি চলার পথের বাহন ট্রেনের কথা কবিতায় বলেছেন বারবার। যেমন-

 ‘অবিরাম হুইসেলবাজে, ট্রেন আর ট্রেন, কোলাহলময় রাত্রিদিন। ট্রেন আসে থামে, হাঁটে। ছুটে চলে যায়।

অবিশ্রান্ত সময় মেল, গুডস, সাটল, স্পেশাল, প্যাসেঞ্জার,

অবিশ্রান্ত গতি বাঁধা ইস্পাতের আগুনে’। (নববসন্ত- আবুল হেসেন)

কবি আবুল হোসেনের পরম সৌভাগ্য যে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্রোহী কবি নজরলের সান্নিধ্যে পেয়েছিলেন। ১৯৪০ সালের ১৪ কি ১৫ জুলাইতে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন মংপুতে। সেই খবর পেয়ে সেখানে কবি হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাইসহ রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার জন্য মংপুতে পৌঁছান কবি। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি তিনি নিজের ভাবনায় বর্ণনা করেছেন- ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথকে না পেয়ে কলিংপুতে ছুটে গেলাম। আমরা যখন পৌঁছলাম রবীন্দ্রনাথ তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। রুমের বাইরে আমরা যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি রবীন্দ্রনাথ কথা শুনে তার সেক্রেটারিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কে এসেছে? সেক্রেটারি বললেন আবুল এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে ভেতরে আসতে বললেন, গিয়ে দেখলাম একটা খাটে রবীন্দ্রনাথ শুয়ে আছেন, একটা কালো চাদরে ঢাকা পা পর্যন্ত, আমি পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। পা ছুঁতে চোখ তুলে বললেন- ‘জানো বড় দুর্দিন, প্যারিসের পতন হয়েছে। জার্মানরা গিয়ে প্যারিস দখল করেছে, দেখ, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সেটা এই জার্মানদের হাতে। তারপর আর বেঁচে কী লাভ। আবার চোখ বন্ধ করলেন, আবার চোখ খুললেন’। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ পাওয়া কবি তার স্মৃতি ও ভাবনার কথা কবি তার কবিতার শব্দমালায় প্রকাশ করেছেন।

‘সেদিনের কথা স্মরি যবে ঘরে ভীর কম্পিত হদয়ে

গভীর সংকোচ ভরে করেছিনু তোমারে, হে কবি,

মোর শ্রদ্ধা নিবেদন। অক্ষম অপটু হস্তে লয়ে

দিয়েছিনু নিঃশেষিয়া মোন ক্ষুদ্র অন্তর সুরভী।

প্রসাদহীন মোর চিত্তের সে গুরু অপরাধ,

মৃদু হাসি হয়তো বা লীলাচ্ছলে, হে কবি সম্রাট,

সেদিন পাঠিয়েছিলে মোরে তব স্নেহ-আশীর্বাদ’।

  (রবীন্দ্রনাথ- আবুল হোসেন)

কীভাবে কাব্যের বন্ধুর পথে নিষ্ঠা নিয়ে পথ চলতে হয় আবুল হোসেন তার বিরল দৃষ্টান্ত। তাইতো তিনি কবিদের কবি।

কবি আবুল হোসেন জীবনের শেষ সময়ে ছিলেন জীবন অনুসন্ধানের চেষ্টায় নিমগ্নতার ভাবনায় ছিলেন সর্বদা বিভোর। জীবনের চাওয়া ও পাওয়ার হিসাব মিলাতে কবিতায় ভেবেছেন অতৃপ্তি নির্মোহ উচ্চারণ। তাই বলেছেন কবিতায়- দিন আসে দিন চলে যায়

নির্বিঘ্নে ঘুমাই নিজের বিছানায়

তবু কী যেন চেয়েছিলাম

কী যেন পেলাম না

এক দারুণ অতৃপ্তি

সারক্ষণ কুরে কুরে খায়

এ জীবন।

শুধু কী সেই অতৃপ্তি

যদি জানতাম। (বন্দির জীবন- আবুল হোসেন)

কবি আবুল হোসেনের কাব্য চিন্তা ও বিশিষ্টতা নিয়ে যে সংশয় তা তিনি কবিতা নির্মাণের শৈলীতে প্রকাশ করেছেন অবলীলায়। কবিতার মধ্য দিয়ে নিজের পথ চলতে গিয়ে তিনি ধীর চলার পথকে অবলম্বন করেছেন জীবনের দীর্ঘ সময়ে নিজের জীবনের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পেরেছেন বলেই তিনি আজ শক্তিমান কাব্য প্রতিভার মহীমায় অসীন। কীভাবে কাব্যের বন্ধুর পথে নিষ্ঠা নিয়ে পথ চলতে হয় আবুল হোসেন তার বিরল দৃষ্টান্ত। তাইতো তিনি কবিদের কবি। রবীন্দ্র পরবর্তীতে নতুন কাব্য চিন্তা শৈলীর পথ প্রদর্শক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App