×

সাময়িকী

অসময়ের বৃষ্টি ও কথাশিল্পী হয়েছেন মাটির প্রতিচ্ছবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০১৯, ০৮:০৭ পিএম

স্বতন্ত্র সৃষ্টিধারা ও কাব্যভাষার ব্যবহারিক সাহিত্যানুরাগী হিসেবে বেশ পরিচিত তিনি। রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য তাকে এ জগতে প্রবেশের ইচ্ছাকে জাগ্রত করে।

চল্লিশ দশকের সাহিত্যশিল্পী আবুল হোসেন। স্বতন্ত্র সৃষ্টিধারা ও কাব্যভাষার ব্যবহারিক সাহিত্যানুরাগী হিসেবে বেশ পরিচিত তিনি। রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য তাকে এ জগতে প্রবেশের ইচ্ছাকে জাগ্রত করে। সময়ের মননশিল্পী কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমীয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্রমিত্র, সমর সেন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সায়ীদ আইয়ুব প্রমুখের সঙ্গে মিশেছেন। ২১ বছর বয়সে ‘নববসন্ত’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে পাঠক ও বোদ্ধাশ্রেণির কাছে আলোচিত হয়ে উঠেন। কবিতায় নিমগ্ন হলেও তিনি কথাসাহিত্যেও সংযত-রুচিশীল শিল্পী ছিলেন। মানুষকে জেনে সমকালের সুখ-দুঃখ আনন্দ বেদনা, খুন রাহাজানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দুর্ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করলেও জনপদের বিস্তর সমস্যা, শোক, ভালোবাসা, জীবনসংগ্রাম, কুসংস্কারকেও অনুষঙ্গ করেছেন। অসহনীয় সময়ের গ্যাঁরাকলে প্রকাশিত লোকোপন্যাস অসময়ের বৃষ্টি। উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহ চিত্র উপস্থাপন ও নির্মাণ মনে হচ্ছে সমাজের গভীরে প্রবেশ করে মাটি খুঁড়ে আনা সমাজবাস্তবতা। উপন্যাসের ডলার ও লীরা জীবনবোধের সাথে সঙ্গত চরিত্র। কল্পনা ও বাস্তবতার আদলে কৌশলী ঔপন্যাসিক শিল্পভাষ্যেও দারুণ সৃজনশৈলিতা দেখিয়েছেন।

উপন্যাসে চমৎকার জুটি যাদের দেখলে সবার মন জুড়ায়। কপোত-কপোতির মতো একসাথে থাকে। ডলার ও লীরা নামে দারুণ মেলবন্ধন রয়েছে। দুটিই মুদ্রার নাম। ডলার আমেরিকার মুদ্রার নাম লীরা ইতালির। ভিন্ন আঙ্গিকের নাম দিয়ে সরলবর্গীয় ঘটনার অবতারণা করে চরম নাটকীয়তার বহিঃপ্রকাশ করেছেন।

লাইব্রেরি শিক্ষা ও জ্ঞানসিঁড়ি স্থান সেখানেই চরিত্রের পরিচয়সূত্রিতা। বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে দুজনই মনোযোগী হয়ে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করছে। ডলার জুওলজিতে অনার্স এবং লীরা বোটানিতে পড়ে। নিরিবিলি গ্রন্থগারে তারা দুজনই আছে সময় অতিবাহিত হওয়ায় গ্রন্থাগারিক সময় শেষ বলে তাগিদ দেয় ডলার ঝটপট টুকরো নোট গুছিয়ে করিডোরের দিকে এগিয়ে গেলে বাইরে বৃষ্টি দেখে ধমকে দাঁড়ায়। পিয়নের ধারণা জানুয়ারি মাসে বৃষ্টি অনাকাক্সিক্ষত। বৃষ্টি সম্পর্কে দুজনের কথোপকথনে মুহূর্তে হঠাৎ নারীকণ্ঠ তাকে পেছনে ফিরতে বাধ্য করে। অনবরত বৃষ্টি প্রস্থানের জো নেই পিয়ন এবং লাইব্রেরিয়ান চলে গেলে তারা দুজনই দাঁড়িয়ে থাকে। ঔপন্যাসিক বৃষ্টিসময়ের বর্ণনায় অসাধারণত্ব দেখিয়েছেন তারা দুজন যেভাবে দাঁড়িয়েছিল মনে হচ্ছে অভিসারে এসেছে মনোমালিন্যের কারণে নির্জন পরিবেশে দুজন দুদিকে চেয়ে আছে। কিন্তু অনেকক্ষণ কারো সাথে কারো আলাপ নেই। ডলারের মুখে ঔপন্যাসিক কথা তুলে দেন। বাসা সম্পর্কে অবগত হলেও লীরা মনে করে ছেলেটা অভদ্র নয়। দুজনের আলাপনে কিছুটা অসঙ্গতি লক্ষ করা যায়। ডলার যখন লীরাকে একা রেখে যেতে চায় না। ডলারের উত্তরটা ছিল এরকম- ‘আমার অবস্থান মনে হয় আপনার পছন্দ নয়। আর নির্জনতাও মনে হয় আপনি খুব পছন্দ করেন সেক্ষেত্রে আমার মতো অবাঞ্ছিত লোক না থাকাই শ্রেয় অতএব আমার প্রস্থান হওয়াই ভালো।

ভৌতিক চিত্রভাষ্যে তার অসাধারণ কৃতিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। লীরাকে রেখে ডলার চলে গেলে ঝোঁপঝাড়ের মাঝে দুটো ঝল্ ঝল্ চোখ দেখতে পায়। গ্রামে রাতে বিড়ালের ঘোরাফেরা দেখে জনপদের মানুষ অভ্যস্ত হলেও হঠাৎ করে আতঙ্কিত হতে হয়। সেভাবেই লীরা দুটো চোখে আতঙ্কিত হয়েছে তারপরেরই বিড়াল দেখে ভয়মুক্ত হয়। ডলার রিকশা নিয়ে আসে লীরা টেনশনে থাকায় ডলারের পাশে উঠার প্রস্তুতিকালে পেছনে তার জন্য আরেকটা রিকশা আছে। এতে হাল্কা মনোমালিন্যের ভাব ধরা পড়ে এবং লীরা ডলারকে স্টুপিডও বলে। যেখানে পাশে দাঁড়ানোতে সমস্যা সেখানে সময়ের কারণে একই রিকশায় বসতেও আপত্তি নেই। দুজনের প্রস্থান হলেও লীরার মনে ছেলেটির সুন্দর সম্পর্কে কটূক্তি মোটেও মেনে নিতে পারেনি। বাথরুমে নিজের ছবি দেখে তাকে বকাঝকা করতে থাকে। সে তার মাঝে অসুন্দর বলতে খুঁজে পায় গালের গোটাটি কিন্তু নিজের মধ্যে ভূতের বীভৎসতা কঙ্কালরূপ দেখতে পায় না। তার মধ্যে দোলাচল দেয় ডলারের উপস্থিতি ও পরবর্তী ক্রিয়াদি। লীরকে ভূতের মতো দেখায় বিষয়টি পরীক্ষার জন্য লীরা বহুবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে শেষে অন্ধকারে নিজের ছায়া দেখে মনে করে ভূতই সে। ছেলেটির কথায় যৌক্তিকতা খুঁজে পায় এবং মনের অজান্তে গান ধরে ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে।’ টিটকারি ও অবহেলার সূত্র ধরেই প্রেমমোহে আবদ্ধ হয়।

গ্রামীণ জনপদকে ঘিরে পারিবারিক প্রথাও এসেছে। হৃদি ও সালাউদ্দিন চরিত্র বিন্যাসে। পারিবারিকভাবে পছন্দ হলে রিস্তা অনুযায়ী বিয়েশাদির প্রচলন ছিল আবার প্রেম পরিণয় হতেও বিলম্ভ হয় না। পরিবারও মেনে নেয়া না নেয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্ব সমীকরণে ব্যস্ত থাকে। সালাউদ্দিন নামাজের অজুহাত দিয়ে হৃদিকে প্রেমের জালে আবদ্ধ করে লীরা মনে করে এটা এক ধরনের ব্লাকমেইল। ভগ্নিপতিদের সাথে শালিদের রসবোধ থাকে বলে মাঝেমধ্যে খুনসুটি হয়। তাদের মধ্যেও এমন রসবোধ বিদ্যমান। কথা হচ্ছে বৃষ্টি নিয়ে লীরাকে কেউ আটকে রেখেছে কিনা তারপরই লীরা গ্রন্থাগারের বর্ণনা দিলো। ইগো নারীর অলংকার। ছেলেদেরই তাদের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে হয় না হলে লীরার ক্ষেত্রে যা হয়েছিল তাতে আত্মমর্যদায় লাগার কথা। লীরা নিজেকে সুন্দরী দাবি করে অথচ ডলার ফিরেও তাকালো না। এতে তার আত্মমর্যাদা ব্যাহত হয়।

ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকলে বাবা-মা উদ্বিগ্ন থাকেন। ছেয়েমেয়েদের প্রতি অপত্যস্নেহ মনে আঁকিবুঁকি খায়। তাই বের হলে তাদের চাপ বেড়ে যায়। লীরার মতো ডলারকেও বাসায় বিলম্বের ব্যাখ্যা করতে হয়। মাহমুদুল কবীর চৌধুরী তার বাবা তিনি ছেলের জন্য অস্থির হয়ে আছেন। ছেলে যথানিয়মে বিশ্লেষণ করলেও মন ধরে না। ডলার বাবার প্রতি বিরক্ত হয়ে সরে যায়। বাবা কার্টুন দেখেন তাতেও ডলার বিরক্ত সে মনে করে এটা বাচ্চারা দেখে বুড়ো বয়সে তিনি এসব দেখছেন। বয়সে লোকে হয় না বুড়ো তিনি দেখবেন এটা তার নিজস্ব ব্যাপার।

মেয়েরা বাবা মায়ের আদুরে সন্তান। ছেলে হলে মেয়ের আক্ষেপ, মেয়ে হলে ছেলের আক্ষেপ বাঙালির এ রীতিনীতি বহুকাল ধরে বিদ্যমান। ছেলেমেয়ে সন্তান ঐশ্বরিক দান। তাতে মানুষের হাত নেই তবুও চেষ্টাশীল। যারা মেয়ের অভাব বোধ করেন ছেলেকে বিয়ে করিয়ে সে সাধ পূর্ণ করেন সেক্ষেত্রে ভালোমন্দের প্রভাব রয়েছে। মাহমুদুল কবীর চৌধুরীর ক্ষেত্রেও তেমনটি লক্ষণীয়। বড় ছেলের বউ বৃন্দা লক্ষ্মী মেয়ে। মেয়ের মতোই দেখেন তিনি। সংসারের প্রতি এবং পরিবারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। ডলারে প্রতিও যত্নশীল। সে তার মেজাজ খারাপ হওয়া বিষয়ে জানতে চায়। এখানে পারিবারিক বন্ধন প্রকাশ পেয়েছে। প্রেম মানসিক অবস্থাকে বিপন্ন করে। ডলার ও লীরা দুজন দুজনকে খোঁজে। দুজনই মানসিক অবস্থা আবিষ্কারের আশায় চটপট করছে। লীরা পরদিন বান্ধবী রিনা ও শিলাকে নিয়ে ডলারের সন্ধানে বের হয়। গ্রন্থাগারের প্রতিটি টেবিল নিবিড়ভাবে দেখে বান্ধবীরা বিরক্ত হয়। এক পর্যায় ছেলেটি প্রসঙ্গে জানালে পিয়ন আরজ আলীকে বিষয়টি

বলে এবং গতকালকের ছেলেটিকে চেনে কিনা জানতে চাইলে আরজ আলী কুদ্দুসের প্রসঙ্গ টানে। সে তার টেবিলের বই উঠিয়েছে। বইগুলো প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কিত তাহলে সে প্রাণিবিদ্যার ছাত্র হবে। তারা তিনজন কিছু লিঙ্ক পেয়ে আশ^স্ত হয়। ডলারের মাঝেও মেয়েটি সম্পর্কে কৌতূহল নানাভাবে নাড়া দিচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ লাইব্রেরিতে গিয়ে মেয়ে সম্পর্কে জানার আগ্রহ। পিয়নের কাছে জানতে পেরে মেয়েটি বান্ধবীদের নিয়ে তাকে খুঁজছে এবং তার রিপুগুচ্ছে নড়ে উঠে। প্রেমে পড়লে পরস্পরকে পাওয়ার উন্মাদনার চিত্র ডলার চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

সময়ের পালাবদলে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম অর্জনের করিডর। রাজনীতিক সমাজপতি এবং কর্ণধার তৈরি হয়েছে এ বিদ্যায়তনে। এখানকার প্রতিটি নিশ্বাস দেশপ্রেম ও ভালোবাসার। শেখে ও শেখায় সৃজনশক্তির উর্বরভূমি। দেশের নানা অনিয়মের প্রথম হুঙ্কার এখান থেকে ধেয়ে আসে।

শিক্ষালয়ে শিক্ষা সফর গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বছরজুড়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্লান্তি দূর করতে বাৎসরিক শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়। ক্লান্তি অবসন্নতা দূরীকরণের পাশাপাশি বাস্তবিক শিক্ষাও লাভ করা যায়। উপন্যাসে জুওলজি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষা সফর তারই অংশবিশেষ। তাদের ভ্যানু মিরপুর চিড়িয়াখানা। তাদের উদ্দেশ্য জীবজন্তু ও পশুপাখি সম্পর্কে হাতেকলমে শিক্ষালাভ কিন্তু ক্লান্তিকর মুহূর্তে ডলারের চোখে ধরা পড়ে কয়েকজন যুবক যুবতী। তাদের রোদে লজ্জাবতী গাছ দেখার মুহূর্ত তাকে বিমোহিত করে। শিক্ষক সংবেদনশীল গাছটি সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন গাছটির সাইন্টিফিক নাম মিমোসা পুডিকা গরসড়সংধ ঢ়ঁফরপধ। ডলারের রক্ত হিম হয়ে যায় মেয়েরা অবাক হয়ে গা টেপাটেপি করে। শিলা বুঝে না বলে ঐ লাইব্রেরি লোকটা বলে তাকে বুঝায়। তাদের পরিচয় হলে কথাবার্তায় নানা প্রসঙ্গ আসে। রাগ ও মুডের পরিসমাপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে দেখা-কথা ও সম্পর্কের বাঁধন নিবিড় হতে থাকে।

ডলারের সামনে যুবতীর প্রতিচ্ছবি। বৃন্দার চোখে তার নাওয়া খাওয়া বিষয়ে ছন্দপতন দেখা দেয়। আস্তে আস্তে ডলার সাহসী হয়ে উঠছে। সাহস চোখে পড়ে যখন হাত বাড়িয়ে দেয় এবং লীরার হাত তার সাথে যোগ হয়।

মিলনের প্রদক্ষেপ উপন্যাসে নাটকীয়তার প্রকাশ। মেঘ না চাইতে জল এখানে অসময়ের বৃষ্টি পাঠককে টেনে টেনে নিয়ে যায় প্রেম সত্তায়। বারবার উদ্বেগ লক্ষ করা যায় হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে যেখানে লীরা শিলা পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত থাকলেও পারিবারিকভাবে স্বীকৃত হয়ে তাদের অগোচরে সম্পর্ককে সমর্থন করে। তাদের উভয় পরিবারের উদ্দেশ্য প্রেমমোহে পড়াশুনা যেন বিনষ্ট না হয়। দায়বদ্ধতা থেকে তারা উভয়ের ভবিষৎ জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির দোলাচলে তারা আচমকা মিলে যায়। পরিবারে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের কারণে ছেলেমেয়েরা বিপদসীমা থেকে রক্ষা পায়। তাদের পালিয়ে বিয়ে করার সুযোগ না দিয়ে ঔপন্যাসিক সামাজিক দায়বদ্ধতাও দেখিয়েছেন। সমাজবাস্তবতায় যা অহরহ ঘটছে মাঝে মাঝে কেউ কেউ যাচ্ছে আত্মহননের পথে। সমাজবিচারে উপন্যাসের চরিত্র বিন্যাস ও ঔপন্যাসিকের চিন্তন দক্ষতা অসাধারণ ও কৃতিত্বপূর্ণ।

প্রেমিক সবসময় দার্শনিক। প্রেমে পড়লে দর্শনচেতনা ভর করে। চিন্তন ও মনজগৎ উন্মুক্ত বাতাসে দোল খায়। কারো কারো মধ্যে কবি প্রবৃত্তিও আসে। মনের আকাশে ভারি বাতাস হালকা হতে থাকে। সত্যিকারের প্রেম নানা ছলে কলাকৌশলে মানব মানবীর দ্বৈতসত্তাকে একীভূত করে জীবনসঙ্গী পর্যন্ত গড়ায়। বোধের করিডোর খুলে সুনসান হয়ে ওঠে চারপাশ ও জীবনঘর। যেখানে মনের আলাপন হয়ে উভয়েই সুখ-দুঃখের সারথি হয়। ঠিক সেভাবেই গ্রন্থাগার থেকে বৃষ্টি নিয়ে এলো দুজনের মিলনবাতাস। উড়ো হাওয়ায় দোল খেতে খেতে তারা দূর থেকে অনুধাবন করছে অসময়ের বৃষ্টি। মাহমুদুল কবীর চৌধুরী ছেলের মন নিয়ে গবেষণা বিষয়টি দার্শনিকতাতেই উপলব্ধ হয়। বৃন্দা দেবরকে লীরা সম্পর্কে প্রশ্নবাণে আবদ্ধ করছেন। প্রেমের সূত্র পেলে পরিবার বন্ধু-বান্ধবের মাঝে কৌতূহল ধরা দেয়।

সময়ের ঘূর্ণনে প্রিয় মানুষের সাথে দেখা হলে মনে নানা উন্মাদনার মধ্য দিয়ে নতুন নামে আবদ্ধ করার প্রবণতা সাহিত্যে বেশ লক্ষণীয়। যুগলের মাঝেও আকর্ষণ বোধের প্রধান চিন্তা। কি নামে ডাকবো তোমায় অতএব একটা নাম চাই। মনের অজান্তে বৃষ্টির সময় দেখা লীরার নাম দেয়া হলো বৃষ্টি। ঔপন্যাসিক ঘটনার ভেতরে ছোট ছোট ঘটনার অবতারণা করে উপন্যাসে নতুন শিল্পশৈলীতে আবদ্ধ করেছেন। বৃষ্টি নামের মধ্য দিয়ে বৃষ্টির সাথে ডলারের কথোপকথন তারই ইঙ্গিত। বৃষ্টি নামটি তাকে তাড়া করে। বৃষ্টি মানুষের দেহমনকে প্রশান্তির রূপায়ণ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট দাঙ্গা-হাঙ্গামা অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকে। অস্ত্রবাজদের দৌরাত্ম্যে বাকিরা কাতর হয় এবং মাথানত করে। রনি চরিত্রে তা ধরা দেয়। রনি লীরাকে পছন্দ করে ডলারকে চিঠির মাধ্যমে বুলেট পাঠায়। ডলার লাজুক ও ভয়কাতর ছেলে তাই গাবড়ে যায়। লীরাকে বাঁচাতে রনির সাথে প্রেমের অভিনয় করে শিলাকে সে মনে করে তৃতীয় চোখ। একদিন রনি তার ভুল বুঝে শিলাকে পত্র লেখে তার ভার্সিটি জীবনপ্রবাহ তুলে ধরে। অজান্তে শিলাকে ভালোবেসে আর দেখা হবে না কোনোদিন। হবে অনন্তকাল। তার মধ্যে বেঁচে থাকার সাধ আছে কিন্তু দুর্ধর্ষ ক্যাডাররা ভালো হয়ে বাঁচতে পারে না তাদের অনেক দূরে চলে যেতে হয়। রনির মধ্যে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা। প্রেমবোধ কখনো কখনো খারাপ মানুষকে ভালো করে সে বিষয়টি রনি চরিত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়।

উপন্যাসে ধর্মপ্রীতি ও সাম্প্রতিক সমাজবাস্ততা দেখানো হয়েছে দুটো পথরেখায়। নামাজ হাদিস সম্পর্কে বক্তব্যের পাশাপাশি কার্টুন ও দাবা খেলা উত্তম কুমার ও সুচিত্রাসেনের অভিনয়প্রীতিও বিদ্যমান।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল শহর ও বহিঃবিশ্ব থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের জন্য একবুক আশা নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে টিকে অনেকেই আসন গ্রহণ করে। শ্যামল প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পাসগুলো তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়। দৃষ্টিনন্দন পথ, বিশাল গ্রন্থাগার, টিএসএসি এবং তরুণ-তরুণীদের জীবনগড়ার উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো।

সময়ের পালাবদলে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম অর্জনের করিডোর। রাজনীতিক সমাজপতি এবং কর্ণধার তৈরি হয়েছে এ বিদ্যায়তনে। এখানকার প্রতিটি নিশ্বাস দেশপ্রেম ও ভালোবাসার। শেখে ও শেখায় সৃজনশক্তির উর্বরভূমি। দেশের নানা অনিয়মের প্রথম হুঙ্কার এখান থেকে ধেয়ে আসে। তৈরি হয় দেশ ও সমাজের কর্ণধার। প্রেমবোধও চোখে পড়ে জীবন জীবনের সন্ধানে এরা একীভূত। ঔপন্যাসিক এখান থেকে ডলার ও লীরাকে প্রধান চরিত্র হিসেবে নিয়েছেন। বিজ্ঞান পাঠাগারে পরিচয় করিয়ে সূক্ষ্মদর্শী হয়ে চরিত্রের মধ্যে জৈবিক দাগমুক্ত রেখেই মানসিক প্রেমবোধে আকৃষ্ট করে পারিবারিক সূত্রিতায় আবদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি তার প্রত্যাশা অনুযায়ী আগামীর সৃজনকর্মী গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

উপন্যাসে দুটো পরিবার দুটো জীবন নানা সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে উত্তরণ হয়েছে। বাস্তবিক চিত্রকল্প ঘটনাপরম্পরা চরিত্রের মধুরতা আবেগ অনুভূতি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রবল ইচ্ছাশক্তি সহজেই পাঠকহৃদয়কে আকর্ষণ করে। এখানে শাব্দিক জড়তা বা ঘটনার উল্লম্ফন নেই টান টান উত্তেজনামুখর সৃষ্টিপথ। লক্ষ্য, আবেগ স্থির ও সহানুভূতিশীল। প্রেম সময়ের ব্যবধানে জড়ো হলেও সমতলীয় প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে এবং গৃহের বোদ্ধাশ্রেণির মানসিকতা বুঝার ক্ষমতাকে ধারণ করে যা বোঝা নয় পুজো হয়। সমগোত্রীয় ও সঠিক লেভেল ধরে ঔপন্যাসিক নিটোল চরিত্রকে ধারণ করেছেন। আঙ্গিকশৈলিতা উপস্থাপনে কাব্যফলে তৈরি করেছেন। পাঠ ও রস সন্নিবেশ তাঁর অতুলনীয় সে হিসেবে অসময়ের বৃষ্টি ও কথাশিল্পী হয়েছেন মাটির প্রতিচ্ছবি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App