×

মুক্তচিন্তা

শোক ও শঙ্কার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০১৯, ১০:০৯ পিএম

আগস্ট এলে কেবল শোকগ্রস্ত হলেই আমাদের চলে না, আমাদের সতর্কও থাকতে হয়। পায়ে পায়ে শত্রু, আমাদের ছায়ার মধ্যেও মিশে থাকতে পারে শত্রুবীজ। সুতরাং ছায়ার ওপরও নজরদারি প্রয়োজন, বিশেষত এই আগস্টে। কারা আমাদের শোককে শঙ্কায় পরিণত করে তোলে? তাদের স্পষ্ট পরিচয় সমগ্র জাতির সম্মুখে উন্মোচিত হওয়া জরুরি। কোনো ধরনের রাজনীতি নয়- জাতির পিতার হত্যাকারী এবং সাম্প্রতিক নানা হুমকিদাতাদের মধ্যে সম্পর্কের সূত্র আবিষ্কার ও প্রকাশ করতে হবে।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস। সেই শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঙালি জাতিকে ও বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে যিনি স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যার নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে এই আগস্টে বাংলাদেশ হাজার বছরের সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে নিঃস্ব করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রখর ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্বকে মেনে নিতে পারছিল না পাকিস্তানি ভাবধারার আদর্শপুষ্ট অনেকেই, ক্ষমতালোভীদের অনেকেই। তারা বঙ্গবন্ধুর কাছের অথচ লোভী ব্যক্তিদের ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে মুজিব হত্যায় উদ্বুদ্ধ ও দেশে পাকিস্তানি আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করে। এই ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর কিছু তরুণ কর্মকর্তা তাদের নিজ নিজ কল্পনাবিলাসী অভিলাষ চরিতার্থের জন্য যুক্ত হয়। মুজিববাদে ভীত বিদেশি কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও তাদের মদদ দেয়। বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রচক্রের মধ্যে পড়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট ভোর রাতে শিশুপুত্র রাসেলসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্য নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দুর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখানো এক মহানায়কের এমন করুণ পরিণতি দেখে বিশ্ববাসী বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশের জন্য, দেশের খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য যিনি সমগ্র জীবন অতুলনীয় ত্যাগই করে গেছেন তার জীবনের এরূপ পরিণতিতে বিশ্ববাসীর কাছে জাতিকেই একটি বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে যখন খন্দকার মুশতাকের ক্ষমতা দখলের উল্লাসের বার্তা পেয়েছে তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক করেছে এ দেশের অজস্র মানুষ। তখন থেকে নীরবে অশ্রু ফেলেছে বিচলিত দেশবাসী- তার ধারা এখনো অব্যাহত। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে ‘সমূলে বিনাশ’ করার লক্ষ্যেই আক্রমণ পরিচালনা করে। সমগ্র জাতি ও সমগ্র ভূখণ্ড নিয়ে একটি আদর্শ দার্শনিক অভিপ্রায়ে বঙ্গবন্ধু কোথা থেকে যাত্রা করে কোথায় এসে পৌঁছেছিলেন- এ দেশের মানুষের মানবিক অনুভূতির জগৎকে কীভাবে এতটা স্পর্ধায় উন্নীত করেছিলেন, এই দেশকে তিনি কতটা সম্মুখের দিকে নিয়ে এসেছিলেন তা অবিমৃশ্যকারীরা কখনো বিবেচনা করে না। অবিমৃশ্যকারী ও অবিবেচকদের দল ভারি হলেও হাজার বছরের ইতিহাসই বঙ্গবন্ধুকে যথাস্থানে আসন দিয়েছে। ইতিহাসের বরপুত্র বঙ্গবন্ধুকে নির্মোহ ইতিহাসই আজ বাঙালির জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাস তার অমোঘ দায় মিটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত ও যথাযথ মর্যাদায় ভূষিত করেছে। কিন্তু ইতিহাসের অপনায়কদের উত্তরসূরিরা এখনো সক্রিয় আছে। যারা বাংলাদেশ ও বিশ্বের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে তারা সফল না হলেও তাদের উত্তরসূরিরা পূর্ব প্রজন্মের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এখনো তৎপর রয়েছে। তাই আগস্ট এলে হত্যাকারীরা নবোদ্যমে জেগে ওঠে- নতুন নতুন পরিকল্পনার ছক এঁকে মাঠে নামে। এই ছকের অংশ হিসেবে সম্প্রতি শোনা যায় এবারের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাই জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর আঘাত হানবে, বোমা হামলায় ধ্বংস করে ফেলবে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ। এসব বার্তাকে সব সময় ‘উড়ো খবর’ বলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক নয়। খবরের উৎস সন্ধানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সক্রিয়তা দেখাতে হবে। কেননা, আমরা তো জানি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বিশবারের অধিক হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল। কুচক্রী মহলের কাছে আগস্ট শোকের বদলে নিয়ে আসে আনন্দবার্তা। আগস্ট এলে কেবল শোকগ্রস্ত হলেই আমাদের চলে না, আমাদের সতর্কও থাকতে হয়। পায়ে পায়ে শত্রু, আমাদের ছায়ার মধ্যেও মিশে থাকতে পারে শত্রুবীজ। সুতরাং ছায়ার ওপরও নজরদারি প্রয়োজন, বিশেষত এই আগস্টে। শত্রুশিবির এখনো এতটাই সক্রিয় যে, পিতৃহীনতার শোক করতে গেলেও শঙ্কার অন্ত থাকে না। কারা আমাদের শোককে শঙ্কায় পরিণত করে তোলে? তাদের স্পষ্ট পরিচয় সমগ্র জাতির সম্মুখে উন্মোচিত হওয়া জরুরি। কোনো ধরনের রাজনীতি নয়- জাতির পিতার হত্যাকারী এবং সাম্প্রতিক নানা হুমকিদাতাদের মধ্যে সম্পর্কের সূত্র আবিষ্কার ও প্রকাশ করতে হবে। ১৯৭৫ সালে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে ‘সমূলে বিনাশ’ করতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন রক্ষা পেলেও তাদের বিনাশের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। শেখ হাসিনা যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাকে এখন হত্যার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সেই ঘাতকদের। কারণ শেখ হাসিনার সক্রিয় ও উদ্যমী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবে রূপলাভ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হোক, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হোক, তা এ দেশের একটি গোষ্ঠী ও মহলবিশেষ ১৯৭১ বা তার আগেও চায়নি, এখনো চায় না। সুতরাং সাম্প্রতিককালে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকিদাতাদের প্রাথমিক পরিচয় সম্পর্কে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। বাকি সব তথ্যের জন্য গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আনুষ্ঠানিক বিবৃতির জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। আমাদের মনে রাখতে হবে আগস্ট এলে কেবল আনুষ্ঠানিক শোক করলে চলবে না- বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আদর্শটি উপলব্ধি করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে কেন হত্যা করা হয়েছিল তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হবে। বুঝতে হবে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ভাবাদর্শও। তিনি কীভাবে বাংলাদেশকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন আর আমরা তার স্বপ্ন পূরণে কে কী করছি তা ভাবতে হবে। আমরা মনের গভীর থেকে বাঙালির স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জীবনসংগ্রামের কথা ভাবি না, ভাবি না বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের কথাও। তাই তৃণমূল স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত বিভিন্ন পেশাজীবী নেতাকর্মীদের মধ্যেই খাঁটি আওয়ামী লীগ কিংবা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক সাজার রুগ্ন প্রতিযোগিতা দেখছি, যা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একেবারেই বিপরীত। ১৫ আগস্টের বেদনাবিধুর শোক ও গাম্ভীর্য নিজেদের চরিত্রে ধারণ করে মনের গভীর থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক হোক আমাদের। মনের গভীর থেকে খানিকটা নীরবে-নিভৃতে বসে যেন বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের কথা ভাবি। আমরা যেন ভাবতে পারি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এ দেশ আজ কোথায় থাকত? আমাদেরই বা কী পরিণতি বহন করতে হতো? এই নীরব ভাবনাটুকু প্রত্যেকের জন্য জরুরি।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App