×

সাময়িকী

স্বপ্ন ও কবিতাযাপন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০১৯, ০৬:৩০ পিএম

স্বপ্নের প্রাচীন ইতিহাস থেকে মানুষের অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিশ্বাসের কথা জেনেছি সবাই। আত্মা, ভালো আত্মা, মন্দ আত্মা, মানুষের শরীর ছেড়ে তাদের বাইরে আসার কথা, শুনেছি। গ্রিকের স্বপ্ন-দেবতা মরফিয়াসের কথাও শুনেছি। বিভিন্ন যুগের, ধর্মের, জাতি-প্রজাতির বিশ্বাস ও সাধনার কথা আমাদের অজানা নয়।

স্বপ্নেই বেঁচে থাকে মানুষ। দৈনন্দিনতার বাইরে কল্পনাময় এক জীবনেই তার বেঁচে থাকা। চেতন মনের কল্পনা আর অবচেতন মনের স্বপ্নরা কখন যে হাত ধরাধরি করে চলতে শুরু করেছে তা ঠিকঠাক বোঝার আগেই কেটে গেল জীবন। স্বপ্ন কি, স্বপ্ন কেন এসব নিয়ে জ্ঞানী মানুষদের তর্কাতর্কির কথা আমরা জানি। অনেকেই এ সম্পর্কে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে বিশ্বাস ও করেন। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতো তাঁরাও মানেন- ‘স্বপ্ন মূলত মানুষের গোপন আকাক্সক্ষা এবং আবেগগুলোর বহিঃপ্রকাশ’। কিশোরবেলা থেকে এই দীর্ঘ পরিক্রমায় বুঝেছি পৃথিবীর এই বিশাল জ্ঞানসাগর থেকে নিজের পছন্দমতো কিছু মনি-মুক্তো আহরণ করার চেষ্টা করা ছাড়া, কিছুই করার থাকে না, আমার মতো সাধারণ মানুষদের। যাঁরা অন্য কিছু পারেন তাঁরা মহান। স্বপ্নের প্রাচীন ইতিহাস থেকে মানুষের অদ্ভুত অদ্ভুত সব বিশ্বাসের কথা জেনেছি সবাই। আত্মা, ভালো আত্মা, মন্দ আত্মা, মানুষের শরীর ছেড়ে তাদের বাইরে আসার কথা, শুনেছি। গ্রিকের স্বপ্ন-দেবতা মরফিয়াসের কথাও শুনেছি। বিভিন্ন যুগের, ধর্মের, জাতি-প্রজাতির বিশ্বাস ও সাধনার কথা আমাদের অজানা নয়। মনিষীরা অনেকেই নিজের মতো করে তাত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন স্বপ্নের স্বরূপ এবং কার্যকারণ নিয়ে। এসবের মধ্যে একটি বিষয় আমার খুব পছন্দ। প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করতেন স্বপ্ন-দ্যাখাই ছিল ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাবার একমাত্র উপায়। দেবতাদের কাছ থেকে পরামর্শ, সান্ত্বনা বা নিরাময় পাওয়ার আশায় তারা নাকি এক বিশেষ ধরনের ‘স্বপ্নের বিছানা’য় ঘুমাতেন। এ রকম আরো অনেক ঘটনা জানা যায়, বিভিন্ন সময়ের। সে সব নয়, এই স্বপ্নের বিছানাই আমায় মুগ্ধতা দেয় বেশি। এই শব্দ যুগলের ব্যবহারটিকে সীমিত অর্থের মধ্যে রাখা বাঞ্ছনীয় হবে না যদিও। এমনই এক ‘স্বপ্নের বিছানা’ বোধহয় আমরা সবাই চাই। যে বিছানা সমাজ সংস্কারককে স্বপ্ন দেখাবে নতুন সমাজ, আদর্শ সমাজ গড়ার। পৃথিবীর সমস্ত ক্ষেত্রের প্রতিযোগীদের স্বপ্ন দেখাবে সাফল্যের, জয়ের। দরিদ্র, নিরন্ন মানুষের চোখ জুড়ে খেলা করবে সুসময়ের স্বপ্ন, জ্বলে উঠবে আশার আলো। সৃষ্টিশীল মানুষেরা তাঁদের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেন প্রতিদিন। শুধুমাত্র কল্পনার রাজ্যে বসবাস নয়, যারা নতুন, ব্যতিক্রমী জীবন নিয়ে প্রত্যয়ী স্বপ্ন দ্যাখেন তাঁদের সবার জন্যই এই ‘স্বপ্নের বিছানা’। শিশুকাল থেকেই আমাদের প্রত্যেকের এক কল্পরাজ্য থাকে। সেখানে বসবাস করতে করতে নিজের অজান্তেই জন্ম নেয় কিছু স্বপ্ন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বাঁচে, কিছু বাঁচে না। কখনো বা নতুনেরা আসে। পুরনোরা সরে দাঁড়ায়। আমার স্বপ্নযাপনের উপকথার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার নতমুখ শৈশব। কৈশোরের নিঃসঙ্গ দিনলিপি। একজন মানুষের ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবার ইতিহাস। যা কখনো বিবর্ণ, কখনো উজ্জ্বল। কখনো ধুলোমাখা, কখনো বা সোনালি মোড়কে ঢাকা আমার জীবন। কিছু কিছু জেদি উইপোকার তীব্র আক্রমণেও যা ছিন্নভিন্ন হয়নি আজ পর্যন্ত। হয়তো সাময়িকভাবে রক্তাক্ত হয়েছে কিছুটা, কিন্তু নতুন স্বপ্নের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে অচিরেই। না, সেই অর্থে স্মৃতিচারণ নয় এই লেখা। দেখার ভঙ্গি পাল্টালেও, ফেলে আসা জীবন তো পাল্টায় না। স্মৃতি ফেরে। ফিরে ফিরে আসে। একই কথা ঘুরেফিরে আসে। নানান লেখায়। সেটাই স্বাভাবিক। আর পাঁচজন কিশোরের মতো আমারও কল্পরাজ্য জুড়ে ছিল রাজা রাজড়া, মন্ত্রী সেপাই, রাক্ষস-খোক্ষস, এমনকি ভূত পেত্নী সব। রাজকুমার-রাজকুমারীরা তো ছিলই। কবিগুরুর ‘একটি নাটকে ‘ইন্দ্রকুমার’-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম, মনে আছে। তারপর থেকে নাকি আমার হাঁটাচলা পাল্টে গিয়েছিল অনেকদিন। একা একা ভর দুপুরে না-দেখা ভিন রাজ্যের সেপাইদের সঙ্গে মনে মনে হাওয়ায় লড়াই করতাম সব সময়। আমার এই রাজত্ব থেকে আমায় ফিরিয়ে আনা সহজ ছিল না খুব। শৈশবের দিকে মুখ ফেরালে যে দুজন দুঃখিনী নারীর চোখ আমার সামনে দাঁড়ায় তাঁরা আমার মা ও ঠাকুমা। কল্পনা ও বাস্তবের সীমারেখা শিখিয়েছিলেন তাঁরাই। বাস্তবের নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও কীভাবে মনের মধ্যে স্বপ্ন-প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে হয় তাও তাঁদের কাছেই শেখা। স্বপ্ন শব্দটির যে অন্যতর অর্থ আছে জীবনে, ধীরে ধীরে সব কিছু শিখিয়েছিলেন এঁরাই। ঘুমের ভেতরে যে সব ঘটনাবলি স্বপ্ন হয়ে খেলা করে অবচেতন মনে সেসব দৈনন্দিনতার বাইরেও কিছু স্বপ্ন থাকে যার সঙ্গে ঘুমের খুব একটা সম্পর্ক নেই। যা জীবনের, পথ চলার। হয়তোবা বেঁচে থাকার, অস্তিত্বের। একটু একটু করে বড় হয়েছি আর শিখেছি কীভাবে বুকের মধ্যে পুষে রাখতে হয় উন্মাদ আগুন। ‘মানুষের উপেক্ষা, অবহেলা সব পেরিয়ে কীভাবে পৌঁছতে হয় আলোর ভেতরে। এ আলো কিন্তু সাফল্যের, সচ্ছলতার বা যশের নয়... এ এক পবিত্র নীলিমার আলো যা বিষাদে অম্লান, যা মায়াময়ী এক নিশিকন্যার চোখের মতো অধরা ও লোভহীন। পরশ্রীকাতর সাপেদের ছোবল এড়িয়ে কীভাবে চলাফেরা করতে হয় কঠিন বাস্তবে।’ দুপুরবেলা মা নয়, ঠাকুরমার কাছেই থাকতাম বেশি। গল্প শোনার লোভে। সেই সব গল্প আর মনে নেই, থাকার কথাও নয়। যে সরল সত্যটি মনে আছে তা হলো কোনোদিন, কোনোরকম বিষাদে আমায় আক্রান্ত হতে দেননি আমার ঠাকুমা। তাঁর কিছু কথাবার্তা আমার চরিত্রগঠনে সাহায্য করেছে। ঠাকুমা প্রায়ই বলতেন, ‘সোজা রাস্তায় হাঁটলে পথ হারায় না মানুষ’। তখন ঠিক বুঝিনি। পরে যখন বুঝলাম, তখন নানা প্রশ্ন এসেছিল মনে। পথ কি ডাকে আমাদের, ডাকে অন্তর্লীন টানে? পথ কি পথের মধ্যে হঠাৎ লুকোয়? তা না হলে সোজা পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কেন হারিয়ে যায় মানুষ? কেন চতুর্দিকের দলবদ্ধ ক্ষুদ্রতা সোজা রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয় মানুষকে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর অধরা থেকে যায় বলেই, আর কিছু ভাবি না। ঠাকুমার বলে দেয়া পথ না হারানোর উপায় মেনে চলি সারাজীবন। আরও একটি কথা ঠাকুমাকে বলতে শুনেছিলাম। কোনো একটা ব্যাপারে কষ্ট পেয়ে কাকে যেন বলেছিলেন ‘কুঁজো হতে শেখেনি যে মানুষ তার কোনো সামাজিক অবস্থান নেই...’। অনেক পরে বুঝেছি এই শ্লেষাত্মক কথার পেছনের যন্ত্রণা। ক্ষমতাবানরা কোনোদিনই চান না তাঁদের সামনে কেউ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াক। ঝুঁকতে ঝুঁকতে কুঁজো হয়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত তাকে ক্রমাগত তুচ্ছ করে তোলাই ক্ষমতাবানদের প্রিয়তম খেলা। এ সব খেলা আমি জেনেছি আস্তে আস্তে। বুঝেছি, এখনকার দিনে, প্রতিষ্ঠিত হবার বাসনা থাকলে, ক্ষমতার সামনে কুঁজো হয়ে দাঁড়ানো শিখতে হয়, ঝুঁকতে হয়, বশংবদ হতে হয়। যদি না পারো এদের কাছে তোমার কোনো অবস্থান থাকবে না। তোমার দিকে এরা তাকাবে না কেউ। পাশাপাশি এটাও ঠিক, কিছু মানুষ এ জন্যই পছন্দ করবে, শ্রদ্ধা করবে তোমায়। যে খেলা কখনো খেলবো না সে খেলা থেকে দূরে সরে আসি। বারোয়ারি মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসে বসে থাকি জীবনের খুব কাছাকাছি। আশৈশব অনেক না-পাওয়া, অনেক অপমান, অবহেলাগুলোকে মুঠোয় ধরে শুরু হয় অন্য পথ চলা। নিজের সঙ্গে নিজের বাজি ধরা। অধরা স্বপ্নগুলোর দিকে হাঁটতে থাকা। এই চলার পথে কোনো উদ্দামতা নয়, নয় কোনো প্রতিহিংসার আগুন, এক স্নিগ্ধ সুশীতল ছায়ায় মেশানো ভালোবাসাই আমায় নিয়ে যায় বাস্তবতার কাছে, কখনো বা পরাবাস্তবতার আলতো ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে অলস জীবন। শুরু হয় স্বপ্ন-পরিক্রমা, হয়তোবা স্বপ্নযাপন। এই যাপনমালায় শিখেছি অনেক পরিদের কাছে শুধু উড়াল নয়, শিখেছি এক জীবনের মধ্যে কীভাবে আরো অনেক জীবন বাঁচতে হয়। মৃতদের যাপিতজীবন থেকে শিখেছি কিছু আর্তনাদ, অজ্ঞাতবাসের শর্ত, বৃক্ষরোপণের আগে জল ও মাতির বিন্যাস। কৈশোর থেকেই আমার কবিতা ও স্বপ্ন আষ্টেপৃষ্ঠে পরস্পরকে জড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। তাদের মিলিত পথচলায় জন্ম মুহূর্ত থেকে আজ পর্যন্ত যা শিখেছি, তা শিখিয়েছে জীবনই। বেঁচে থাকার আসল কৌশল। বিশেষ কোনো দর্শন নয়, জীবনই এগিয়ে নিয়ে যায় আমার কবিতাময় স্বপ্নকে। ওই জীবন নিয়ে তাই আর কিছু ভাবি না। আলোর পেছনে ছায়া কিংবা প্রতিচ্ছায়া, জলের ভেতরে মাটি ও শ্যাওলা কারুকাজ থেকে শুরু করে, সমস্ত জীবন ধরে যে বঞ্চনার ইতিহাস বা ধারাবাহিক অবহেলা মলিন করে তোলে চরাচর, তা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করি না। জীবন যেভাবে চায় সেভাবে আসুক, কখনো জটিল, কখনোবা সহজ সরল। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নার উত্তাপ আর বহুগুণ ভালোবাসা দিয়ে ভেঙে ভেঙে তাকে ক্রমশ সুন্দর করে তোলার মধ্যে লুকিয়ে থাকে আনন্দ, জিতেন্দ্রিয় মানুষের স্বর্গীয় বেঁচে থাকার আবেগ আয়ত্ত করার আশ্চর্য প্রয়াস। এই বিশ্বাসই আমাকে দিয়ে লেখায়; ‘দর্শন শেখায় কিছু বাকিটা জীবন।’ ধারালো অস্ত্রের ঈর্ষা কিংবা জাগতিক লোভ নিয়ে কেউ যদি ভাষাহীন মুখোমুখি হয়, অফুরান আত্মীয়তা দিয়ে আমি তাকে সম্ভ্রম জানিয়ে শুদ্ধতার পাঠ পড়াতে চাই। শৈশবে মা শিখিয়েছিলেন কীভাবে ঋণ স্বীকার করতে হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করতে শিখেছি- কার কাছে ঋণ, যিনি চোখ দিলেন তাঁর কাছে না যিনি চোখের ব্যবহার শেখালেন, তার কাছে? যিনি কলম ধরতে শেখালেন তার কাছে ঋণ তো না হয় স্বীকার করলাম- কিন্তু অদৃশ্য যিনি সেই কলমে স্বপ্ন ভরে দিলেন তাকে পাই কোথায়? এমন অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে যাই, শুধু বুঝি, জন্ম জন্মান্তরের ঋণ রয়েছে আমার এই পৃথিবীর কাছে, প্রকৃতির কাছে, চেনা-অচেনা মানুষজনের কাছে। আমার কবিতার মধ্য দিয়েই আমি ঋণ স্বীকারের চেষ্টা করি। পরিশ্রুত শব্দরাশি দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মতো কবিতার শরীর সাজাই। কখনো পারি, কখনো পারি না। পিছন দিকে তাকালেই দেখি- ‘নির্মাণ কম বেশি হলো ভাঙচুর’। তা সে কবিতারই হোক বা সম্পর্কের। আমি ধ্বংসস্তূপ থেকে ভাঙা টুকরোগুলো কুড়িয়ে এনে, মেতে উঠি নতুন নির্মাণে। মানুষের দিকে, কলমের দিকে হাত বাড়াই, কেননা জীবন আমায় শিখিয়েছে ‘মুক্তির উপায় আর স্বাধীনতা নিয়ে যত খুশি গবেষণা হোক, মানুষের পাশে এসে শেষ অবধি মানুষই দাঁড়ায়’- এই বিশ্বাসই আমার কবিতা। আমার মায়াজগত। অন্তর্জগতে দিনরাত যে ভাঙাগড়া, জটিল আবহের টানাপড়েন তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমার কবিতার বীজ। দিনযাপনের সমস্ত অভিজ্ঞতা জায়গা করে নেয় অন্তর্জগতে। তারপর সেই সব অভিজ্ঞতা অনন্ত মন্থনে পরিশুদ্ধ হয়ে অনিবার্যভাবে বেরিয়ে আসে আমার কবিতায়। চেতন ও অবচেতনের জটিল খেলায় তৈরি হয় মায়াময় আপন পৃথিবী। এই কবিতার জগত থেকেও স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলাম প্রায় বারো বছর। বিদেশে চলে যাওয়ায় আমার ‘শব্দ-সাধনা’ ব্যাহত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু নিঃসঙ্গ নির্জন অভিমানে কবিতার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করেনি খুব। পরম যত্নে আমি তাকে তুলে রাখি মনের মণিকোঠায়। কাগজে কলমে লিখলাম কিনা, কোথাও ছাপা হলো কিনা, কবিতার বই বেরোলো কিনা এ সব নিয়ে এক অদ্ভুত উদাসীনতায় মোড়কে ঢেকে রেখেছিলাম নিজেকে। কিন্তু এখন মনে হয় সত্যি কি দূরে ছিলাম কবিতার সংসার থেকে? কবিতা হয়তো লিখিনি তখন...। কিন্তু শারজার সমুদ্রতীরে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটির আনন্দ কি ভরিয়ে দেয়নি মন? উটেদের দৌড়ে তাদের গতি আরো দ্রুত করার জন্য, যখন তাদের পেটের কাছে বেঁধে দেয়া হতো একটি শিশুকে, তার ছটফটানি, তার ভয় কি ছুঁয়ে যেতো না আমায়? নিউইয়র্কের একটি অফিসের ৪৭তলা থেকে প্রথম যে বার পেঁজা তুলোর মতো বরফ পড়তে দেখেছিলাম সেদিন কি আমার নিঃসঙ্গতা ধরতে চায়নি কবিতার হাত? এইসব বর্ণময় অভিজ্ঞতাই বোধহয় একদিন অন্তর্জগতের অন্ধকার থেকে নেমে এসেছিল কবিতার পাতায়, শব্দে, অক্ষরে। কখন কীভাবে যে কবিতার জন্ম হয়, কখন যে কোন উজ্জ্বল আভাস এসে দিয়ে যায় মোহময়ী শব্দের সন্ধান, তা বুঝতে বুঝতেই পেরিয়ে গেল বয়স। এ সবের মধ্যেই একদিন আবার ফিরে আসা। নিজের সঙ্গে, কবিতার সঙ্গে স্নিগ্ধ মান-অভিমান শেষে তুমুল ভাবে কবিতার কাছাকাছি আসা। নতুন বই, নতুন লেখার ভিড়ে হারিয়ে যায় অনেক কিছু। নতুন ভালোলাগা সরিয়ে দেয় পুরনো অনেক কিছু। বাস্তব জীবনের সুখ দুঃখ সাফল্য পেরিয়ে যে স্বপ্ন সারাক্ষণ রক্তের ভেতরে খেলা করে, সেই তো জন্ম দেয় কবিতার। মাঝে মাঝে চলার পথের নির্জনতা যখন ক্লান্ত করে, আমি এক মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খুব জোরে হাততালি দিই। তারপর নির্জন বৃক্ষের গায়ে মাথা রেখে অপেক্ষা করি সারারাত। অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমে ভারি হয় চোখ। ঘুমের মধ্যেই আমি এক কুয়াশার মুখোমুখি হই। যেখানে মানুষ শুধু হেঁটে যায় মানুষের দিকে। এই কুয়াশার মধ্যেই বেজে ওঠে অদৃশ্য ঘুঙুর। শব্দের, ছন্দের। আমি তাদের কাছে শিখি বেঁচে থাকার কৌশল। ২০০০ খিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে প্রাচীন মিসরে মিসরীয়রা তাদের স্বপ্নগুলোকে প্যাপিরাসে লিখে রাখতেন। তারও আগে মেসোপটেমিয়ায় সুমেরীয়রা রেখে গিয়েছিলেন তাঁদের স্বপ্নের নিদর্শন। অদৃশ্য নূপুরধ্বনির শব্দে আমার স্বপ্নেরাও কবিতার হাত ধরে নেমে আসে চোখের পাতায়। থেকে যায় অক্ষরমালায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App