সরকারি-বেসরকারি তথ্যে কেন এত গরমিল
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০১৯, ১০:২২ এএম
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যের মধ্যে বেশ ফারাক দেখা যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যের বিস্তর তফাত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে সরকার সবসময়ই সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। আর সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, এখানে লুকোচুরি করার কিছু নেই। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যারা আসছেন এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে কিনা- সেটি নিশ্চিত না হয়ে তারা কোনো তথ্য দিচ্ছেন না। এ ছাড়া সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ১০টি ও বেসরকারি ৩০টি মিলিয়ে মোট ৪০টি হাসপাতালের পাঠানো রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকারি তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু ঢাকাতেই প্রায় চারশর মতো হাসপাতাল রয়েছে। সেগুলোর রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট বিভাগে যাচ্ছে না। ফলে তথ্যের গরমিল থেকেই যাচ্ছে।
বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে কয়েক লাখ। মৃতের সংখ্যা একশর বেশি। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার এন্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৬৬৬ জন। ঢাকার বাইরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ৩০ জন। গতকাল মৃতের তালিকায় যোগ হয়েছে আরো ৬ জন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৯ জনে। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৩২৬ জন।
মৃতের সংখ্যা এত কম করে দেখানো হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের জবাবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সাব্রিনা ফ্লোরা ভোরের কাগজকে বলেন, আট জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ডেথ রিভিউ কমিটি। এই বিশেষজ্ঞ কমিটি তিন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে। প্রথমেই মৃত রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাগজপত্র সংগ্রহ করে ওই কমিটি। এরপর ওই ব্যক্তির রক্তের নমুনা হাসপাতালে থাকলে তা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া রোগীর বিস্তারিত তথ্য না থাকলে ওই ব্যক্তির একাধিক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে সেই তথ্য নেয়া হয়। কমিটি এ পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত ৫২ জনের তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই করার পর ডেঙ্গুতে ২৯ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে।
এ পর্যন্ত কতটি নমুনা তাদের সংগ্রহে রয়েছে এবং পরীক্ষা সম্পন্ন হতে কত দিন লাগে? এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সাব্রিনা বলেন, গণমাধ্যম, ফেসবুক এবং
হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর যেসব খবর আসে, এর সব তথ্যই আমাদের কাছে আছে। হাসপাতালে রক্তের নমুনা থাকলে সেই ক্ষেত্রে আমাদের কাজটি অনেক সহজেই হয়। এ ক্ষেত্রে সময়ও কম লাগে। তবে যখন রোগীর বিস্তারিত কোনো তথ্য থাকে না এবং এ জন্য রোগীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করতে হয় সে ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ থেকে এক মাসও সময় লাগে। এ বিষয়টি আসলে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে জনগণ এবং সরকারের মধ্যে এক ধরনের ‘মিসট্রাস্ট’ (অবিশ্বাস) তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, পরিস্থিতি এখন জটিল হয়ে গেছে। সব হাসপাতাল থেকে সরকারের কাছে তথ্য যাচ্ছে না। এ ছাড়া কমিটির মাধ্যমে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করার ব্যাপারটিও জটিল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে একটা অবিশ্বাসের অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে যে সব রোগীর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তাদের মৃত্যুর বিষয়টি ডেথ রিভিউ কমিটির মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে এমনটি আমি মনে করি না। যা একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডেথ রিভিও কমিটির এক সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, গতকাল (বুধবার) ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক ব্যক্তির মৃত্যুর সনদে ডেঙ্গুর কথা লেখার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ভুল করে সনদে ডেঙ্গুর কথা লিখেছেন। এমন ভুল যে আরো হবে না তার নিশ্চয়তা কী? তাই নিশ্চিত হয়েই আমরা মৃতের তালিকা প্রকাশ করছি। এখানে লুকোচুরির কিছু নেই।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে প্রথম থেকেই একটা ‘ধোঁয়াশা’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জনগণের মনে ধারণা হয়েছে সরকার সত্যটা চেপে যেতে চাইছে। সরকারি-বেসরকারি তথ্যে যখন অনেক গ্যাপ দেখা যাচ্ছে, তখন সরকারি হিসাব নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। তবে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের জন্য ডেথ রিভিউ কমিটিতে রেকর্ড থাকা দরকার বলে আমি মনে করি।
এ প্রসঙ্গে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেনিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি সূত্রের তথ্যে গরমিল এবং বিভিন্ন সময় সরকারের দায়িত্বশীল সদস্যদের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য জনমনে সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। সব সময়ই সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য লুকিয়ে রাখার প্রবণতা আমরা দেখছি। তারা হয়তো মনে করেন, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেশি দেখালে মানুষ আতঙ্কিত হবে। এ ভাবনা থেকেই হয়তো সত্য তথ্য উঠে আসছে না। তবে আমি মনে করি সরকারের উচিত ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃতুর সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা।