×

মুক্তচিন্তা

সুনামের পরিণতি কেন দুর্নামে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০১৯, ০৯:০৫ পিএম

সুনামের পরিণতি কেন দুর্নামে?
সুনামের পরিণতি কেন দুর্নামে?

মোস্তফা কামাল

সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে পুলিশের সবাই কি পাঠান, মিজান, মোয়াজ্জেম? না। মোটেই না। সাহসিকতা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনকারী শবনম-পারভেজের তালিকা বেশ দীর্ঘ। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার বাসের যাত্রীদের প্রাণরক্ষায় পুলিশ কনস্টেবল পারভেজের নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত পথচারীর পায়ের শুশ্রƒষায় সাব-ইন্সপেক্টর শবনমের দায়িত্ব পালনের খবরও মানুষ দেখেছে।

ধর্ষণের ঘটনায় আবারো শিরোনামে পুলিশ। এবার নাম লেখালেন খুলনার রেলওয়ে থানা পুলিশের ওসি ওসমান গনি পাঠানসহ বাহিনীটির পাঁচ সদস্য। তাদের লালসার শিকার নারী ঘটনার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন আদালতে। সিলেটে শ্বশুরবাড়ি থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে খুলনায় এসেছিলেন তিনি। এরপর নিজের চিকিৎসার জন্য যান যশোরে। সেখান থেকে শুক্রবার রাতে ফিরে আসার সময় ফুলতলা এলাকায় পড়েন জিআরপি পুলিশের টার্গেটে। মোবাইল চুরির অপরাধে তারা তাকে নিয়ে যান থানায়। রাতে ওসি ওসমান গনি পাঠান পাঁচ সহকর্মীকে নিয়ে মিলেমিশে মেটান তাদের লালসা। পরদিন ঠুকে দেয় মাদকের মামলা। ধর্ষিতার স্বজনদের অভিযোগ, ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওসি পাঠান কিছু টাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। সমঝোতায় রাজি না হওয়ায় যা করার তিনি তা করে দিয়েছেন। যথারীতি ধর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত ওসি পাঠান। তিনি বলেন, ফেনসিডিলের মামলা থেকে রক্ষা পেতে ওই নারী মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। থানায় রাতে আটজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তিনজনকে বাদ রেখে পাঁচজনে কি ধর্ষণ করা সম্ভব? বাকি তিনজন কি তা দেখেননি?- এমন কড়া যুক্তি তার। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া রেলওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ফিরোজ আহমেদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কমিটিকে। কমিটি কী রিপোর্ট দেয় সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। হয়তো এ ধরনের আরো অনেক ঘটনার মতো গণধর্ষণের এই অভিযোগ তদন্তেও পুলিশ নির্দোষ প্রমাণ হবে। ডিআইজি মিজান, ওসি মোয়াজ্জেমদেরও শুরুতে সহি-শুদ্ধ, বেগুনাহগার প্রমাণের চেষ্টা চলেছে। পুলিশের সঙ্গে ঘুষ অনেকটা একাকার। ছন্দ মেলাতে গিয়েও এসে যায় ঘুষ আর পুলিশ অথবা পুলিশ আর ঘুষের কথা। এর বাইরে দুর্নীতি, অনিয়ম, দাপট, ক্ষমতাবাজিতে পুলিশের হিম্মত কে না জানে? সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের সঙ্গেও প্রায়ই আসছে পুলিশের নাম। প্রতিটি ঘটনাই মর্মপীড়াদায়ক। এ ধরনের কটা অপকর্মের বিচার হয়েছে সেই ফলোআপ সংবাদ নেই বললেই চলে। দেশ যখন মশার রাজা এডিসের হানায় আক্রান্ত, কেউ মরছে, কেউ মরার পথে। সামনে ঈদ। এমন সময়ে পুলিশের কয়েক সদস্য নামলেন ধর্ষণকর্মে। তাও আবার গণধর্ষণ। ওসি পাঠান, মোয়াজ্জেম, ডিআইজির মতো কিছু সদস্যদের কাণ্ড-কীর্তিতে গোটা পুলিশ বাহিনীর ইমেজই প্রশ্নবিদ্ধ। এই ধাঁচের সদস্যদের কারণে ইয়ার্কি-মশকরাও হচ্ছে পুলিশ নিয়ে। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে সরকারও। তা মোকাবেলায় নানা বুঝ দিতে হচ্ছে গণমাধ্যমসহ মানুষকে। কিন্তু মানুষ কি এসব বুঝ মানছে? পাঠান, মিজান-মোয়াজ্জেমদের দায় কেন নিচ্ছে সরকার? পুলিশের সৎ-পেশাদার সাবেক-বর্তমানদের কাছেও বিষয়টি বিব্রতকর। দুর্নীতি-ক্ষমতার অপব্যবহারসহ পুলিশের নানা অপকর্মের খবর তাদের বেদনাহত করে। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে পুলিশের সবাই কি পাঠান, মিজান, মোয়াজ্জেম? না। মোটেই না। সাহসিকতা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনকারী শবনম-পারভেজের তালিকা বেশ দীর্ঘ। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার বাসের যাত্রীদের প্রাণরক্ষায় পুলিশ কনস্টেবল পারভেজের নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত পথচারীর পায়ের শুশ্রƒষায় সাব-ইন্সপেক্টর শবনমের দায়িত্ব পালনের খবরও মানুষ দেখেছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে বাচ্চার জন্য দুধ চুরি করা বাবাকে জেলে না নিয়ে চাকরি দিয়ে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী জাহিদও একজন পুলিশ সদস্য। পদে এএসপি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে আমাদের পুলিশ বাহিনী। ইন্টারপোল, সার্কপোল ইত্যাদি সংস্থাতেও বেশ সুনাম। সেই সুনামের পরিণতি কেন দুর্নামে? পুলিশের সুনামটা-দুর্নামে, অর্জনটা বিসর্জনে পর্যবসিত হচ্ছে মিজান, মোয়াজ্জেম, পাঠানদের মতো সদস্যদের কারণে। বাহিনীটির জন্য এরা ডেঙ্গুর চেয়েও ভয়ানক। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা মারার নামে তামাশা চললে এই পুলিশদের দাপটও চলতেই থাকবে। সেই ক্ষেত্রে লোক দেখানোর তামাশা নয়, দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। তার আগে জরুরি সদিচ্ছা। নইলে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে ভাঁড়দের রাস্তায় ঝাড়ু বিনোদনের মতো তামাশার ফলনই অনিবার্য। ঢাকার দুই মেয়র এডিস মশা বা এদের প্রজনন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ কেন নিতে পারেননি? আইসিডিডিআরবি মার্চ মাসে এডিসের প্রজননস্থল দেখিয়ে পদক্ষেপ নিতে বললেও কেন সেটা নেয়া হয়নি? হাইকোর্টের তিরস্কারের পরও ভেজাল ওষুধ মারার নাটক কেন হলো? কার পকেটে গেছে দুই সিটির মশা মারার ৫০ কোটি টাকার ভাগ? এসব প্রশ্নের কিনারা করা হয়নি। উপরন্তু বিরতিহীনভাবে সাপ্লাই করা হয়েছে যত কুকথা ও অপকাণ্ড। সংখ্যায় তা অগুনতি। বলা হলো ছেলেধরার মতো ডেঙ্গুও একটি গুজব। স্বাস্থ্য কর্মীদের ছুটি বাতিল করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পারিবারিক ছুটিতে মালয়েশিয়া যাওয়া। সমালোচনার মুখে তার ফিরে আসা। এ সময়ে বিদেশ যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সাংবাদিককে ধমক দেয়া। সেজেগুজে মশা মারতে ঝাড়ু হাতে নায়ক নায়িকা ও অন্যদের রাস্তা পরিষ্কারের ফটোসেশন, ডেঙ্গুর কারণে বিএনপির জরুরি অবস্থা জারির দাবি। এগুলোর একটিও কি সুস্থতা-স্বাভাবিকতার নমুনা? এদিকে ঈদ উপলক্ষে রাজধানী থেকে অনেকেই ডেঙ্গু রোগ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন। সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেই। যেখানে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসায় মানুষ মরছে সেখানে জেলা-উপজেলায় কী হবে? আরো কত মানুষ মারা পড়বে সেই আতঙ্ক ভর করেছে নানা মহলে। ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের এ অপরাজনীতি, অপকথা, অনৈতিকতাকে একটা আঁচড় দিলেন কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতিন ঘোষ। তার মতে, যেসব দেশে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে সেসব দেশে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। স্প্রে করে এডিস মশা নিধন সম্ভব নয়। তাদের উৎস ধ্বংস করতে হবে। অতিন ঘোষের কথাটি শুধু দশ কথার এক কথা নয়। কথার ফাঁকে বহু বার্তাও দিলেন তিনি। মূলে আঘাত না করে ঝাড়-ফুঁকে কী হয় বা হতে পারে?- সেই প্রশ্নও রয়েছে তার মন্তব্যে। বাকিটা আমাদের বুঝ, বোধ-বুদ্ধির বিষয়। এক সময় পুরান ঢাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় দুয়েকজন জাঁদরেল পুরুষ বা নারী ছিলেন। কোনো অনাচার, অবিচার বা অরাজকতা দেখলেই তেড়ে যেতেন। আঙুল তুলে চেঁচিয়ে বলতেন- ‘মুইড়া ঝাড়ু তর কপালে মারি...।’ বলেই থেমে থাকতেন না। ঝাড়ু নিয়ে মারার জন্য এগিয়ে যেতেন, তাড়া করতেন। যেখানে যার কপালে ঝাড়ু মারা দরকার, অ্যাকশন নেয়া দরকার সেটা না হওয়াতে এখন উল্টো ঝাড়ু পড়ছে সবার কপালে। সরকারকে দোষারোপ করা বেশ সহজ। সেটা আচ্ছা মতো করছিও আমরা। আমাদের আক্রান্তদের কপালে এখন যে ঝাঁটা পড়ছে তারাও কি সতর্ক ছিলাম বা আছি দুর্বিপাক নিয়ে। এ বছর যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে আগাম হুঁশিয়ারি ছিল। জাতিসংঘ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা সেই কবে থেকে বলে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলে আক্রান্ত হবে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চল। এতে ছড়িয়ে পড়বে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ নানা ধরনের ভাইরাসজনিত রোগবালাই। এ দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে রক্ষায় কী করতে হবে? কীভাবে চলতে হবে? খাওয়া-দাওয়াই বা কেমন হওয়া উচিত? সেই সংক্রান্ত পর্যাপ্ত পরামর্শও দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেনি। এডিস মশা নিধনে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু হাস্যকর কথামালায় মানুষের মনে বিরূপতা বাড়িয়েছেন। এডিস মশা যে কত বড় বিপদ হয়ে তেড়ে আসছে- সেটা হয়তো মন্ত্রী-মেয়র কারো বুঝেও আসেনি। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে আমরা কী করেছি? সতর্ক হয়েছি? অপকথায় কমবেশি শরিক তো হয়েছি। বর্তমান অবস্থা থেকে ভবিষ্যতের জন্য কোনো শিক্ষাও কি নিচ্ছি? অভিজ্ঞতার আলোকে গবেষণালব্ধ কোনো প্রতিবেদন বা পরামর্শ কেউ নীতিনির্ধারকদের কাছে দিয়েছেন- এমন তথ্যও এখন পর্যন্ত জানা নেই।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App