×

জাতীয়

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘তোরা সাবধানে থাক আমার কিছু হবে না’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০১৯, ১২:২৯ পিএম

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘তোরা সাবধানে থাক আমার কিছু হবে না’
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সর্বশেষ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী সাংসদ আমির হোসেন আমু বলেছেন, ১৩ আগস্ট রাতে ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা ও কথা হয়। সাধারণত পার্লামেন্ট চলাকালে আমি ঢাকায় থাকতাম। ওই সময় প্রতিদিন রাত ৮টার পরে ৩২ নম্বরে যেতাম। কোনো সময় আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে অথবা কখনো একা যেতাম। সেখানে কাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মনিসহ কয়েকজন থাকতেন। কিছু সময় থাকার পর মনি বাংলার বাণীতে চলে যেতেন। ৩২ নম্বরে বিভিন্ন আলোচনা হতো। হত্যাকাণ্ডের আভাস নিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ আলোচনার মধ্যে মাঝেমধ্যে হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গ উঠত। যে এ ধরনের একটা রিউমার সব সময় আছে। তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের বলতেন, ‘তোরা সাবধানে থাক, আমার কিছু হবে না’। ‘তোরা যখন এত ঘাবড়াচ্ছিস, তোরাই সাবধানে থাক’। ভোরের কাগজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কারা জড়িত, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সর্বশেষ স্মৃতি ও হত্যাকাণ্ড পরবর্তী নানা ভূমিকার কথা তুলে ধরেন তিনি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরে যাওয়া হয়নি- এমন বেদনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমার সবচেয়ে বড় আফসোস, ১৪ তারিখ ৩২ নম্বরের বাড়িতে আমার যাওয়া হয়নি- এটা আমার দুর্ভাগ্য! কারণ ওই সময় আমি গভর্নর নির্বাচিত হয়েছিলাম। গভর্নরদের মুক্ত ধারা নামে একটা প্রকাশনী ছিল। তারা আমাদের সংবর্ধনা দেয়। সেই সংবর্ধনায় গেস্ট ছিলেন কোরবান আলী ও ইউসুফ আলী। তারা অনেক দেরিতে আসেন। অনুষ্ঠান শেষ হয় রাত ১১টায়। এরপর তো আর ৩২ নম্বরে যাওয়া যায় না। তাই আমি সেদিন সেখানে যাইনি। ভেবেছিলাম পরদিন যাব। কিন্তু সে যাওয়া আর হলো না, শেষ দেখা আর হলো না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর কখন পেয়েছিলেন, সে সময় কোথায় ছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওইদিন আমি আমার খালার বাসায় ছিলাম। ভোর ৫টার দিকে হঠাৎ আমার রুমের দরজায় ধাক্কানো হলো। খালা ডাকলেন যে ‘ওঠো ওঠো জলদি ওঠো’। আমি ভাবলাম হয়তো ফজরের নামাজ পড়ার জন্য তিনি আমাকে ডাকছেন। আমি ওঠে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই খালা আমাকে বললেন, ‘রেডিও শোনো’। তখনো আমার পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি। ওই অবস্থায় ধীরে ধীরে রেডিওর কাছে গেলাম। খুনি ডালিমের কণ্ঠ শুনলাম ‘আমি ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’। আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। বললাম ধুর! স্বাধীনতার পর থেকেই শুনতেছি যে, ফ্রি-হিলটেক্সে রেডিও স্টেশন করবে। অমুক জায়গা থেকে ঘোষণা হবে। এইসব আজগুবি! আমি ফ্রেস হতে বাথরুমে চলে গেলাম। কিন্তু আমি আর স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। রেডিওতে বারবার শুনতে শুনতে আমার মনে ধীরে ধীরে একটা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। ক্রমান্বয়ে মেন্টালি আমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি! ওজু করে তাড়াহুড়ো করে আমি ফজরের নামাজ পড়লাম। নামাজের পর সমানে আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে, সেরনিয়াবাত ও শেখ মনির বাড়িতে ফোন করা শুরু করলাম। কিন্তু কারো বাড়ি থেকেই কোনো রেসপন্স পাচ্ছিলাম না। তখন আমার সন্দেহ গাঢ় হতে শুরু করল! আমি অবশ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায়। এ কি হলো, কি হলো? এই পরিস্থিতি। এর কয়েকদিন পর আমি গ্রেপ্তার হলাম। তিন বছর পর ১৯৭৮ সালে আদালতে রিট করে আমি জেল থেকে মুক্তি পাই। ততদিনে সব শেষ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় অবস্থা থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়েছিল উল্লেখ করে আমির হোসেন আমু বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন থেকেই ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাদের নাম জড়িত ফারুক, রশীদকে বলা হয় মুক্তিযোদ্ধা। হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধে তাদের অন্তর্ভুক্তি ছিল ষড়যন্ত্রের একটা অংশ। জিয়াউর রহমানকে সেক্টর কমান্ডার বলা হয়, আসলে তিনি কিন্তু কোনো সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না, তিনি ছিলেন জেড ফোর্সের কমান্ডার। এটা আমাদের দেশের অনেক লোকই জানেন না। জিয়াউর রহমান কোথাও কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি, তার ওখানে খালেদ মোশাররফ আহত হয়েছিল। তার চৌদ্দগুষ্টি উর্দুতে কথা বলত, সে নিজেও উর্দুতে কথা বলত। ফারুক-রশীদের যে স্টেটমেন্ট তাতেও তারা বলেছে যে, জিয়ার কাছে যখন যাওয়া হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন যে, তোমরা পারলে কর, আমার কোনো আপত্তি নাই, আমি আছি তোমাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর অপরাধ ছিল, তিনি এ দেশের স্বাধীনতা এনেছেন। ’৭১ এর পরাজিত শক্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মধ্য দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডে সংঘটিত হয়। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম, তখনো বলা হতো যে, পাকিস্তানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর লুস কনফেডারেশন হয়ে যেতে পারে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তখন সবচেয়ে বেশি। তখন যাতে মানুষ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য মুক্তি আন্দোলন থেকে সরে আসে, তার জন্য একটা প্রচার চালানো হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুকে চাও, না স্বাধীনতা চাও? তখন আমরা পাল্টা প্রচার চালিয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা এক এবং অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুকে পেলে স্বাধীনতা পাব, স্বাধীনতা পেলে বঙ্গবন্ধুকে পাব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কোনো হত্যাকাণ্ড ছিল না, এই হত্যাকাণ্ড ছিল সম্পূর্ণ একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। এই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব পণ্ড করে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে একটা কোনো রকম কনফেডারেশন করার পরিকল্পনার অংশ। এই যে হত্যাকাণ্ড, আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, বঙ্গবন্ধু হত্যার আড়াই মাসের মধ্যে যাদের হত্যা করা হলো, জাতীয় চার নেতাকে, তারা কারা? বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারা এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে। সুতরাং তাদের অপরাধ ওই একই, কাজেই তাদের কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করা হলো। এভাবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন জেলায় জেলায় আমাদের নেতাদের হত্যা, নির্যাতন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা সবই করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App