×

মুক্তচিন্তা

এখন দরকার ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে  সর্বাত্মক অভিযান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০১৯, ০৯:১৫ পিএম

একদিকে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও উদাসীনতা নিয়ে সমালোচনা, অন্যপক্ষে সেসব সমালোচনার বাস্তবতা অস্বীকার করে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টায় সময় নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবকাশে ডেঙ্গুবাহী মশার অবাধ ও নির্বিবাদ বংশ বিস্তার, ডেঙ্গুর মহামারি রূপ ধারণ, হাসপাতালগুলোর অসহায় বেসামাল অবস্থা এবং আরো অপ্রত্যাশিত মৃত্যু- এটাই এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতির বাস্তব চালচিত্র। এই গাফিলতি ও দুর্নীতির দায়ে মশককুলের শ্রীবৃদ্ধি, তাদের মুক্তডানা বিচরণ, নিরীহ নাগরিকদের আক্রমণ এবং পরিণামে শতাধিক মানুষের মৃত্যু।

আমাদের সমাজে সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রবণতা হলো আমরা সত্য স্বীকার করতে ভয় পাই। তাতে দায়িত্বহীনতার প্রকাশ ঘটুক বা না-ই ঘটুক। আর দায়িত্ব পালনে সমাজের দায়িত্বশীল বড় একটি অংশে রয়েছে আলস্য, উদাসীনতা ইত্যাদি। সেইসঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে অসততা, অনৈতিকতার মতো আচরণ। তাই সত্যকে কোনো না কোনো অজুহাতে অস্বীকার করে অন্যকে জড়িয়ে দায় এড়িয়ে আমরা স্বকৃতকর্মের ভুলভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে চাই। সাহস করে অপ্রিয় সত্যের মোকাবেলা করতে চাই না। তাই ছোটখাটো ভুল বা ত্রুটি বা অন্যায় সহজেই বড় হয়ে ওঠে, যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। কখনো সর্বনাশের কারণ। এটাই হলো বর্তমানে ব্যাপক হারে ডেঙ্গু জ্বরে প্রকোপের প্রেক্ষাপট। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণে ডেঙ্গু জ্বর, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ টাইপ, কখনো মারাত্মক হেমোরেজিক টাইপ, যে ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। যেহেতু ডেঙ্গু মশাবাহিত রোগ, কাজেই মশা নিধন ডেঙ্গু দমনের প্রতিকার হিসেবে বিবেচিত। যেমন ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে অ্যানোফিলিস মশা মূল কারণ। মশা নিধন খুব কষ্টকর বা অসম্ভব প্রক্রিয়া নয়। বদ্ধ জলে, ড্রেনে বা অনুরূপ স্থানে মশা নিধনের ওষুধ প্রয়োগ কি সত্যই কষ্টকর কিছু কাজ। এ কাজের দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে সিটি করপোরেশনের, মাঠপর্যায়ে মশা নিধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের। সমাজে প্রত্যেকের নিজস্ব দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সেগুলো যথাযথভাবে পালন করা হলে অনেক কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়। তখন অভিযোগের কোনো সুযোগ থাকে না। আরো একটি প্রবণতা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের মধ্যে লক্ষ করা যায় তাহলো অভিযোগ মাত্রই অস্বীকার করা, কখনো তা উদ্দেশ্যমূলক বলে বাতিল করা, নিজের ভুলত্রুটি ঢাকার জন্যই এ প্রবণতার প্রকাশ। অথচ ভুলত্রুটি মানুষ মাত্রেরই হতে পারে। তা স্বীকার-সংশোধন করাই তো সৎ মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত।

দুই. ডেঙ্গু রোগ যে ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে, তাতে অনেক আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেছে, অনেকে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছে- এ সত্য কি অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে। হাসপাতালের পরিসংখ্যান কি মুছে ফেলা বা অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে। অনর্থক অনৈতিক চেষ্টা। ঢাকায় প্রতি বছর বর্ষার সময় ডেঙ্গু রোগ দেখা দেয়, এবার তার মাত্রাধিক্য। সঠিক তৎপরতা হলো সেটা স্বীকার করে নিয়ে এর কারণ খুঁজে বের করা এবং সে কারণ নিরসনের চেষ্টা করা। যুক্তিসঙ্গতভাবে লক্ষ করা যায়, সে কারণ একাধিক স্তরে নিহিত। যেমন ডেঙ্গু দমনে সময়ক্ষণের আগেই মশক নিধনের পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেয়া- অর্থাৎ সঠিক মানের ওষুধ সংগ্রহ এবং সে ওষুধ যথাযথভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা করা। কাজ দুটো কি খুব কঠিন? না মোটেই না। কঠিন হয়ে ওঠে তখনই যখন তাতে দুর্নীতির ভূত বাসা বাঁধে। দুর্নীতি জড়িত হতে পারে যথাযথ পরিমাণে, যথাযথ মানের ওষুধ কেনা এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা অর্থাৎ ছিটানোর মধ্যে। এটা প্রতিহত করা কি খুুব কঠিন- যদি নিয়ন্ত্রক স্তরে, উচ্চ স্তরে সদিচ্ছা থাকে। সেখানে গাফিলতি মানেই সেখানে ত্রুটি অর্থাৎ ছিদ্র এবং সেই ছিদ্রপথে ডেঙ্গুর মতো শনির প্রবেশ। মানে ভোগান্তি এবং কখনো মৃত্যু। একাধিক ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবে প্রবল গাফিলতি তৎপরতার নিশ্ছিদ্র পথে ছিদ্র তৈরি করেছে। সেই ছিদ্রপথে ডেঙ্গুর প্রবেশ। তাই সঙ্গত কারণে একটি দৈনিকে বড় অক্ষরে শিরোনাম- ‘গাফিলতিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ’। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবরটি হলো- দেড় যুগ ধরেই মানহীন মশক নিধন ওষুধ ব্যবহার চলছে। এ দুটি খবরের ভিত্তিতেই বলা চলে- এ বছর এই ব্যাপক হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়ার পেছনে রয়েছে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বের ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতা, সেইসঙ্গে মানহীন মশক নিধন ওষুধ ক্রয়ের দুর্নীতি বা অনৈতিকতা। দায়টা তাহলে চিহ্নিত করা গেল। সে ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন ও দাবি দুই-ই উঠে আসে, এদের শাস্তির কী ব্যবস্থা? কোনো ব্যবস্থা কি নিচ্ছে সিটি করপোরেশন? যদি না নেয়, তাহলে সেই সর্বোচ্চ পদাধিকারীকে নিয়ে আমরা কী করব? সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের শরণাপন্ন হব, নাকি উচ্চ আদালতের? এই গাফিলতি ও দুর্নীতির দায়ে মশককুলের শ্রীবৃদ্ধি, তাদের মুক্তডানা বিচরণ, নিরীহ নাগরিকদের আক্রমণ এবং পরিণামে শতাধিক মানুষের মৃত্যু। এ মৃত্যুর দায় কে বহন করবে? ওই সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষ অপরাধীরা, নাকি সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী, যিনি জনসেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই পদে আসীন হয়েছেন?

তিন. এসব অভিযোগের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ দায়িত্বের ব্যক্তিরা প্রায়ই বলে থাকেন, এসব খবর বানোয়াট, সরকারকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য, হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগী ভর্তি, চিকিৎসা, মৃত্যু এবং সুস্থতার পরিসংখ্যান তো আর মিথ্যা হতে পারে না। এমন একটি পরিসংখ্যান পরিবেশিত হয়েছে একটি দৈনিকে। তাতে লেখা হয়েছে, গত জুলাই মাসে প্রায় ১৫ হাজার ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এ জাতীয় ডেঙ্গু সংক্রান্ত বিস্তারিত পরিসংখ্যান একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। আমরা এত বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না। গত কয়েক দিন ধরে প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় প্রথম পাতা থেকে ভেতর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রান্ত খবর পাচ্ছি। সব পত্রিকাতেই কি বানোয়াট খবর? বিশেষ করে সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলোতে। এসব প্রশ্নের কী জবাব দেবেন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা? কী জবাবদিহি করবেন জনপ্রতিনিধিরা? এর অর্থ জনস্বার্থে জীবন রক্ষার দায়ে করপোরেশন প্রশাসনের কোনো নৈতিক দায়দায়িত্ব নেই। থাকলে সাত বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গুর সম্ভাব্য প্রকোপ সম্পর্কে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল, সে সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সতর্ক করেনি করপোরেশন দুটিকে এ বিষয়ে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। করপোরেশন প্রধানেরও বোধ হয় এসব ভয়ানক সতর্কবাণীর দিকে কোনো নজর ছিল না। আসলে সরকারি প্রশাসনই হোক কিংবা করপোরেশন প্রশাসনই হোক, কারোর জনস্বার্থ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকলে এক মাসেরও আগে যখন একটি দৈনিক পত্রিকায় শিরোনাম ছাপা হলো- ‘১৮ বছরের রেকর্ড ভাঙল/ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা’- তখনই কি খবরটির যথার্থতা যাচাই-বাছাই করে প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ব্যবস্থাপনায় নেমে পড়া উচিত ছিল না? প্রয়োজনে সাময়িক স্বাস্থ্য খাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সর্বাত্মক ডেঙ্গুবিরোধী লড়াই চালানো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে? না তেমন কিছু করার কথা ভাবা হয়নি, ভাবেননি কেউ। সময় বয়ে গেছে যথারীতি। একদিকে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও উদাসীনতা নিয়ে সমালোচনা, অন্যপক্ষে সেসব সমালোচনার বাস্তবতা অস্বীকার করে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টায় সময় নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবকাশে ডেঙ্গুবাহী মশার অবাধ ও নির্বিবাদ বংশ বিস্তার, ডেঙ্গুর মহামারি রূপ ধারণ, হাসপাতালগুলোর অসহায় বেসামাল অবস্থা এবং আরো অপ্রত্যাশিত মৃত্যু- এটাই এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতির বাস্তব চালচিত্র। এ অবস্থায় একটু আগে যা বলা হয়েছে সেটাই কর্তব্য- অর্থাৎ জরুরি ভিত্তিতে সর্বাত্মক অভিযান চালানো এবং তা রাজধানীসহ দেশজুড়ে যাতে ডেঙ্গুর আক্রমণে আর একটিও মৃত্যু সংঘটিত না হয়। কারণ জীবন বড় মূল্যবান। একবার গেলে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App