×

জাতীয়

জাতি প্রতিবাদ করার ভাষাই হারিয়ে ফেলে : মুনতাসীর মামুন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০১৯, ১২:০২ পিএম

জাতি প্রতিবাদ করার ভাষাই হারিয়ে ফেলে : মুনতাসীর মামুন
আজকের সময়ের মানদণ্ড পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের থমকে যাওয়া বাস্তবতার বিচার করা সম্ভব নয়। ভীতু, সন্ত্রস্থ মানুষ সে দিন প্রতিবাদের শক্তি ও ভাষাই হারিয়ে ফেলেছিল। পুরো জাতি বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সে জন্য নির্মম হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিবাদ হয়নি। ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও প্রতিবাদ হয়েছে। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, প্রথম প্রতিবাদ করে ছাত্র ইউনিয়ন এবং বামপন্থিরা। প্রতিরোধ করার দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু আমার মনে হয়, তারাও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড ১৫ আগস্ট নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক ও বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। সম্প্রতি ভোরের কাগজকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে শোকাবহ আগস্ট, দেশি-বিদেশি ষড়ন্ত্র, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন এই গবেষক। জাতির পিতা হারানোর সেই দিনটির স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, সে দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধু আসবেন। আমাদের তাই অন্যরকম উৎসাহ। আমরা সবাই সমাবর্তনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। থাকতাম ধানমন্ডির পুরনো ১৮ নম্বরে। গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি। কিন্তু কিছুই জানতাম না। ট্রান্সজিস্টার খুলিনি। সকালে আমার শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম স্যারের বাসা কাঁটাবনের দিকে যাচ্ছিলাম। সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধু আসবেন সে রকম কোনো ব্যাপার দেখতে না পেয়ে অবাক হই। তখন আশপাশের কয়েকজনের কাছ থেকে ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা জানতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে যাই। বাসায় ফিরে আসি। বের হয়নি সারাদিন। শুধু মনে হয়েছে, এটা কি করে সম্ভব? যে মানুষটি জীবনটাই জাতির জন্য ত্যাগ করেছেন, সেই মানুষটিকে মেরে ফেরা হলো? যেমনটি ঘটেছিল মহাত্মা গান্ধীর ক্ষেত্রে। মুনতাসীর মামুন বলেন, আমরা না হয় ভীরু ছিলাম, ভীতু ছিলাম। তাই প্রতিবাদ করার সাহস হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তারা তো সাহসী ছিলেন। কিন্তু তাদের একটা বড় অংশ কেন ওই সময় জিয়ার সঙ্গে হাত মেলালেন? যা আরো বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই মোশতাক-জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন, এটিও রহস্য! বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সাবেক সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ দায় এড়াতে পারেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এই ইতিহাসবিদ বলেন, আগস্ট এলেই কিছু মানুষ কে এম সফিউল্লাহকে দোষারোপ করেন। হইচই শুরু করেন। কিন্তু এখানে কে এম সফিউল্লাহর কি করার ছিল? ‘বাংলাদেশি জেনারেলদের মন’ নামে আমার একটি বই রয়েছে। এখানে আমার কোনো মন্তব্য নেই। এই বইয়ে ২৪ জনের সাক্ষাৎকার রয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যায়, কে এম সফিউল্লাহ ছাড়া আগস্টের ষড়যন্ত্রের কথা সকল সেনা কর্মকর্তাই জানতেন। কে এম সফিউল্লাহ অন্ধকারে ছিলেন। কারণ তিনিই একমাত্র বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ছিলেন। এ জন্য তাকে কেউ জানাননি। এ ক্ষেত্রে তাকে দোষারোপ করা অন্যায়। তিনি কেন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলেন না এটা নিয়ে অনেকেই কথা বলেন কিন্তু বাকিরা কেন আসেননি। তারা তো সেনাপ্রধান পদ নিয়েই টানাটানি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অনেক মন্ত্রীই কেন পরদিন মোশতাকের সভায় যোগ দিলেন? সে সব তো আসতে হবে? আবদুল মালেক উকিল তো লন্ডনে বসে বলেছেন, ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, এনএসআই, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আগেই বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হচ্ছিল। কিন্তু তিনি গ্রাহ্য করেননি। কয়েকজন সৈনিক মিলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ফেলল বিষয়টি মোটেই এত সহজ নয়। এর ষড়যন্ত্র উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। বিচারের নথিপত্রও প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক বিষয় নিয়ে একটি কমিশন করা দরকার। তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডর মোটামুটি সামগ্রিক একটা চিত্র আমরা জানতে পারব। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সারা বছর চর্চা হওয়া প্রয়োজন মন্তব্য করে এই গবেষক বলেন, আগস্ট এলেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেমিনারের হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু বাকি দিনগুলো আমরা তাকে প্রায় ভুলেই থাকি। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাজারে চার-পাঁচশর মতো বই রয়েছে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখা যাবে অধিকাংশই পাঠযোগ্য নয়। বেশিরভাগই ‘কাট-কপি-পেস্ট’। নতুনত্ব নেই। এ নিয়ে অনেকেই আত্মতৃপ্তি পান। বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন দিক যেমন তার পররাষ্ট্রনীতি, ৭ মার্চ, অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে কিছু বই হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম ও দর্শন নিয়ে কোনো বই হয়নি। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীগুলোই অসাধারণ। সরকারের এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বায়োগ্রাফী হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। দুঃখ প্রকাশ করে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো এমফিল বা পিএইচডি হয়নি। একটা হচ্ছে তথ্যের অভাব ছিল; আরেকটা হচ্ছে অনেকেই সাহস করছেন না। একাডেমিশিয়ানদেরও বঙ্গবন্ধু নিয়ে চিন্তা নেই। শ্রদ্ধা-ভক্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা আছে কিনা এ নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। আমি নিজে একজন একাডেমিশিয়ান হয়েও বলছি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নের স্বপ্ন কতদূর এমন প্রশ্নের উত্তরে গবেষক মুনতাসীর মামুন বলেন, টাইম মেশিনে যদি আমি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দেখি, তাহলে আজকের জেনারেশন বুঝবে না কতটা এগিয়েছে বাংলাদেশ। এটি এক দশকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আমলে এগিয়েছে। আমি জীবদ্দশায় এতটা উন্নত বাংলাদেশ দেখব চিন্তা করতে পারিনি। যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রের দর্শনটাই বদলে গিয়েছিল। বিশ্বাস করি, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন। আগস্টে জাতির পিতার প্রতি এই হোক আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App