×

মুক্তচিন্তা

জবাবদিহিতার অভাব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০১৯, ০৯:০৭ পিএম

অনেক ভালো ভালো কাজ এবং পরিকল্পনা আমাদের দেশে অসমাপ্ত হয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের বিবেচনায়। সরকার একটি চলমান পদ্ধতির নাম- পৃথিবীর অন্য দেশ বুঝলেও আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা এ মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারছে না। আর তাদের এ ভুল পথ আমাদের কত ভালো ভালো প্রকল্পকে মাঝপথে হত্যা করছে গলা টিপে। সবক্ষেত্রে কি জবাবদিহিতার জায়গাটা নিশ্চিত করা যায় না?

ভিন্ন সময়ের দুটি খবর। দুটি খবরই সেতু নিয়ে। একটি সেতু বালু নদ এবং অন্যটি পাগলা নদীর ওপর। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের বালুর পাড়, ইন্দারকান্দি, ফকিরখালিসহ পাঁচটি গ্রাম এবং রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের যোগাযোগ সহজ করার জন্য ১৬ বছর আগে রামপুরা-কায়েতপাড়া সংযোগ সড়কে ইন্দারকান্দি গ্রামের বালু নদের ওপর নির্মিত স্বপ্নের সেতুর স্প্যান গত ১৬ বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এর অনুমোদন হয় ২০০১ সালে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের (নারায়ণগঞ্জ এলজিইডি) অধীনে এ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। পরপর দুটি স্প্যানও নির্মাণ করা হয়। তারপর অজ্ঞাত কারণে সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ থাকে। আজো বন্ধ আছে সেতুটির কাজ। অন্য ১৮০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি ১৪ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে নির্মিত হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের কৃষ্ণনগরে পাগলা নদীর ওপর। কিন্তু সেতুটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ইতোমধ্যে সরকার কৃষ্ণনগর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট পর্যন্ত পিচঢালা সড়ক নির্মাণ করে। শুধু দুই পাড়ের সংযোগ সড়কের অভাবে ওই সেতুতে জনচলাচল শুরু হতে পারছে না। সড়ক-সেতু যোগাযোগ দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় দুটি মাধ্যম। বালু নদীতে সেতু শুরু হয়েছিল, কিন্তু শেষ হয়নি। ১৬ বছর ধরে দুটি স্প্যান ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এলজিইডি এর জবাবে কী বলবে জানি না। তবে পত্রিকার খবরে দেখলাম- নারায়ণগঞ্জ এলজিইডি বলেছে, এ সেতু আর আমাদের অধীনে নয়; এটি ঢাকা এলজিইডির অধীনে। আবার ঢাকা এলজিইডি বলছে, যেহেতু নারায়ণগঞ্জ এলজিইডি এটা শুরু করেছে, তাই এটি পরিপূর্ণ করার দায়িত্বও নারায়ণগঞ্জ এলজিইডির। বড় অদ্ভুত লাগছে, না? এলজিইডির স্থানীয় দুই অফিসের ঠেলাঠেলিতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে নদীর দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষ। এলজিইডির প্রধান অফিস অথবা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কি বিষয়টি দেখছে না? ঢাকা, না নারায়ণগঞ্জ- এই সিদ্ধান্ত প্রদানের কি কোনো সুরাহা তাদের হাতে নেই? ২০০১ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে ওই স্প্যানগুলো বসানো হয়েছিল। অসমাপ্ত সেই সেতুটির কী দোষ সেখানে! এলজিইডি তো স্থায়ী একটি প্রতিষ্ঠান। যে সরকার আসবে, তাদের সঙ্গেই তাদের কাজ করতে হবে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। তাই সেতুটির কাজ তাদের সময়েই শুরু হয়েছিল। সেতুটি শেষ কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলেই। কিন্তু দুটি স্প্যান বসানো ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং বিগত দেড় দশক ধরে তারা ক্ষমতায় আছে। সেই এলজিইডিই আছে। হয়তো সেখানে ইঞ্জিনিয়ার বদল হয়েছে, কর্তাব্যক্তি বদল হয়েছে। কিন্তু যিনি এলজিইডি নারায়ণগঞ্জের দায়িত্বে এসেছেন, তার কাছে বিষয়টির গুরুত্ব পেল না কেন? ওই অঞ্চলের জনগণের দাবির মূল্য কি দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই? নাকি নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা এলজিইডি নিজেদের মধ্যে এক্কা-দোক্কার ঘুঁটি চালাচালি করতে করতেই ১৬ বছর পার করে দিল? কে এর জবাব দেবে? কে এর জবাব নেবে? অন্য সেতুটির অবস্থা তো আরো করুণ। সরকারি অর্থ খরচ হয়েছে, সেতুও নির্মিত হয়েছে। শুধু সংযোগ সড়কটি করে সেতুটির দুপাশের যোগাযোগ স্থাপন করার লোক নেই। কী জবাব দেবেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা? কী জবাব দেবেন ওই এলাকার এমপি এবং এলজিইডি (এলজিইডিই এ সেতুটি নির্মাণ করেছে)? বিশেষ করে এ দুটি স্প্যান বসানোর খরচ মূল্যায়ন কীভাবে হলো? কে তা পাস করল কিংবা কীভাবেই বা পাস করল? এ দুটি সেতুর শেষ ভরসাটি কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? তিনি বলবেন, তারপর কি এ সেতু দুটি ওই অঞ্চলের গণমানুষের উপকারে আসবে? তাতে কি লজ্জা পাবে না স্থানীয় এলজিইডি কর্তৃপক্ষ? লজ্জা কি পাবে না এলজিইডি মন্ত্রণালয়? লজ্জাহীন, দায়িত্বহীন পরিবেশের বাংলাদেশে এমন সেতু, সড়ক এবং অর্ধস¤পন্ন কাজ আরো অনেক আছে। স্থানীয় জনগণ শুধু তার হিসাব রাখেন। কেউ হয়তো তা তুলে ধরছেন না জাতির সামনে। আমি বিষয়টি মিডিয়ায় তুলে ধরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি শুধু এ দুটি সেতুর জন্য নয়, বরং অবহেলায় পড়ে আছে যতগুলো তার প্রতি সুদৃষ্টি দিতে। আমাদের ইতিহাস বলে- অনেক ভালো ভালো কাজ এবং পরিকল্পনা আমাদের দেশে অসমাপ্ত হয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের বিবেচনায়। এরশাদের সরকার শুরু করেছে, তা খালেদা জিয়ার সরকার টেনে নিয়ে যেতে পারে না। শেখ হাসিনার সরকার যা শুরু করেছিল তা খালেদা জিয়ার সরকার টেনে নিয়ে যেতে পারে না। আবার খালেদা জিয়ার সরকার যেটুকু শুরু করেছিল, তা পরবর্তী সময় টেনে নিয়ে যেতে পারে না শেখ হাসিনার সরকার। এমন একটি অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ উপহার দিয়েছে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা। যেন সহ্যই করতে পারে না অপরের কোনো কাজ। যত ভালো কাজই হোক, আগের সরকারের অসমাপ্ত কাজ বন্ধ করে দিতেই হবে। এমনই একটি উদাহরণ ছিল বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা। শেখ হাসিনা তার প্রথম সরকারের সময় চালু করেছিলেন এই কমিউনিটি ক্লিনিক পদ্ধতি। ইউনিয়নে ইউনিয়নে তিনি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন সেই ব্যবস্থা। এতে জনগণের কত ক্ষতি হলো, সরকারের কত অর্থ নষ্ট হলো- এসব ভাবনার যেন কোনো আবশ্যকতাই নেই। যে প্রশাসন তা শুরু করেছিল অনেক আবেগে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সেই প্রশাসনই আবার তা বন্ধ করে দিয়েছে দ্বিগুণ আবেগে। উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে এভাবেই আমাদের অনেক ভালো প্রকল্প আলোর মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু তাতে সরকারের কত অর্থ ক্ষতি হয়ে গেল তা বিবেচনায় নিতে সম্মত নন কোনো রাজনীতিবিদরাই। এরশাদের উপজেলা পদ্ধতি এবং বিকেন্দ্রীকরণের চিন্তা যত ভালোই হোক- যেহেতু তা হয়েছিল এরশাদের হাত ধরে, তাতো খালেদা জিয়া গ্রহণ করতে পারেন না। তাই তো বিকেন্দ্রীকরণের সব প্রচেষ্টা বাতিল করা হয়েছিল বিএনপি সরকারের শাসনামলে। একটি বড় ধরনের ব্রেক এসেছে গত দশকে। কেননা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরপর তিনবার ক্ষমতায় আছেন। ফলে তার সরকার যেসব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন, তা তারা অনেকটাই শেষ করতে পেরেছেন; মাঝপথে কোনো প্রকল্পই মুখ থুবড়ে পড়েনি। এর ফল হিসেবে জাতি উন্নয়নের গতিধারা প্রত্যক্ষ করেছে। পাঁচ বছরে কিছু বড় বড় কাজ শুরু করা যায়, কিন্তু শেষ করা যায় না। কিন্তু পাঁচ বছর পর নতুন সরকার এসে যদি চলমান সব প্রকল্পই বন্ধ করে দেয়, তবে একটি দেশ উন্নয়নের পথে এগুবে কীভাবে? প্রতি পাঁচ বছর পরপর সরকার পরিবর্তিত হওয়ায় বাংলাদেশে তাই উন্নয়নের ধারা একইভাবে এগিয়ে যেতে পারেনি। বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক আবহাওয়া ক্রমশ বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিয়েছে। তবে পরপর দুবার ক্ষমতায় গেলেও খালেদা জিয়া দৃশ্যত কোনো উন্নয়ন দেখাতে পারেননি তার শাসনামলে। এটি সত্যি যে, তার দ্বিতীয় শাসনামলে তার ছেলে তারেক রহমান সরকারের কর্মকাণ্ডে অনধিকার হস্তক্ষেপ করেছেন এবং দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ফলে উন্নয়ন ঘটানোর পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ বেশি মাত্রায় দেখতে গিয়ে তারা বাংলাদেশের কোনো উন্নতিই ঘটাতে পারেননি। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরপর তিনবার ক্ষমতায় থেকে উন্নয়নকে বাংলাদেশে দৃশ্যত বাস্তবায়নের একটি স্বর্ণযুগে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। মাঝপথে যদি অন্য কোনো দল ক্ষমতায় আসত, বিশেষ করে যদি খালেদা জিয়ার বিএনপি ক্ষমতায় আসত, তবে নিশ্চিত করে বলা যায়- আজকের উন্নয়নের বাস্তবরূপ এমনটা হতে পারত না। কেননা, অসমাপ্ত কোনো প্রকল্পই আর তার সময়ে আলোর মুখ দেখত না। ভেবে দেখুন, পদ্মা সেতু কিংবা অন্য যে কোনো মেগা প্রকল্প যদি আগামীকাল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তা বাংলাদেশের উন্নয়নে কতখানি ক্ষতি করবে? বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণ উপলব্ধি করতে পারলেও আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা তা যেন বুঝতে পারে না। তাদের নাম এবং কাজটিই যেন তাদের কাছে বড়- জনগণের উপকারটি যেন গৌণ। এমন রাজনীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। ভুল পথে যাচ্ছে এ রাজনীতি। বরং উল্টোটা হওয়া উচিত। আগের সরকারের অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করলেই বরং তাদের সফল কাজকে জনগণের সামনে দ্রুত দেখানো যায়। নতুন প্রকল্পের কাজ হাতে নিতে তো সময়ের প্রয়োজন পড়ে। ততদিনে তারা চলমান প্রকল্প শেষ করে জনগণের ভালোবাসা কুড়ানোর সুযোগ নিতে পারে। অথচ এমন সরল-সোজা রাজনীতি রেখে তারা প্রতিহিংসার রাজনীতি বেশি পছন্দ করেন। ভালো, সুন্দর কিংবা জনগণের উপকার কোনো কিছু বুঝি না, যেহেতু এটি তাদের কাজ নয় তাই তারা এটি চালিয়ে নিয়ে যাবে না। এই যে একে অপরের প্রতি বৈরী রাজনৈতিক সম্পর্ক, এটিই ক্ষতি করছে আমাদের রাজনীতিকে, আমাদের উন্নয়নকে। সরকার একটি চলমান পদ্ধতির নাম- পৃথিবীর অন্য দেশ বুঝলেও আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা এ মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারছে না। আর তাদের এ ভুল পথ আমাদের কত ভালো ভালো প্রকল্পকে মাঝপথে হত্যা করছে গলা টিপে। বালু নদের ওপর সেতুটি এলজিইডি নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি না করে অচিরেই সুসম্পন্ন করবে এমনটাই আশা করছি। পাগলা নদীর ওপর সেতুটি তো শেষ; শুধু অল্প ব্যয়ে সংযোগ সড়কটি টেনে সেতুটি জনগণের সেবায় চালু করার সুযোগ করে দেয়া। আশা করব- কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে, দ্রুত হাত দিবে এ কাজে। এ কাজে একদিকে তারা জনগণকে বঞ্চিত করছে, আবার অন্যদিকে প্রচুর খরচও করেছে। জবাবদিহিতার চড়া দাম কি তাদের দেয়া উচিত নয়? সেতু দুটি অন্তত জনগণের কাজে লাগার মতো উপযোগী হতে পারে এমনটা কি আমরা আশা করতে পারি? সেতু দুটি প্রতীকী উদাহরণ। এসব ক্ষেত্র যত আছে, সবক্ষেত্রে কি জবাবদিহিতার জায়গাটা নিশ্চিত করা যায় না?

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App