×

মুক্তচিন্তা

এ নহে কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তার অপকর্ম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০১৯, ০৯:০৮ পিএম

১৫ আগস্ট যে মোটেও সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তার ঘটানো কোনো ঘটনা নয়, সেই সত্য আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের অনেক প্রণেতাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না। ঐতিহাসিক সত্য না জেনে না বুঝে আমরা যদি শিশু ভোলানো, পাড়া জুড়ানো গল্প দিয়ে ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ড, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রাষ্ট্রচিন্তাকে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল সেই গভীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কীয় ধারণা না রেখে কথা বলি, লেখালেখি করি এবং চিন্তা করি তাহলে আমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে।

আমাদের দেশে স্কুল এবং কলেজের পাঠ্যপুস্তকে একসময় ভৌগোলিক আবিষ্কার সম্পর্কে লেখা হতো, ‘অজানাকে জানার জন্য, অচেনাকে চেনার জন্য, কলম্বাস এবং বেশ কিছু নাবিক সমুদ্র যাত্রা করেন। আকস্মিকভাবেই তারা আমেরিকাসহ অনেক ভূখণ্ড আবিষ্কার করেন’। ছেলেমেয়েদের বুঝ দেয়ার জন্য এটি হয়তো কাজে লাগতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে সত্য হচ্ছে কলম্বাসসহ ভৌগোলিক আবিষ্কারে যারা ১৫-১৬ শতকে বের হয়েছিলেন তারা কোনো না কোনো রাজশক্তির সম্পদ আহরণের ইচ্ছাপূরণ করতে এমন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র যাত্রা করেছিলেন। সবাই আমরা জানি যে, এসব ভূখণ্ড আবিষ্কারের পেছনে ইউরোপের তৎকালীন শক্তিশালী রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিদেশি সম্পদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে কারণেই তারা ভৌগোলিক আবিষ্কারের পেছনে অর্থ ব্যয় করেন। দ্বিতীয় আরেকটি ঐতিহাসিক বিকৃত তথ্য আমাদের দেশের স্কুলপর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে দীর্ঘদিন লেখা হয়ে এসেছে। ১৫ আগস্ট সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তা সেই রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে...’। ১৫ আগস্ট যে মোটেও সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তার ঘটানো কোনো ঘটনা নয় বা সেভাবে এটাকে সীমাবদ্ধ করা যে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা, সেই সত্য আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের অনেক প্রণেতাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না। ১৫ আগস্ট উপলক্ষে বেশকিছু রাজনৈতিক নেতাও আলোচনায় এ বক্তব্যই দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। এটি সম্ভবত পাঠ্যপুস্তকে পড়ে আসা তাদের অর্জিত জ্ঞান! না হলে তারাও ১৫ আগস্টকে উচ্ছৃঙ্খল কিছু সেনা কর্মকর্তার সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখাতে যাবেন কেন? এটি যে অনেক বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা সেই ধারণা যারা রাখেন না, কিংবা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেন না তাদের ১৫ আগস্ট সম্পর্কীয় জ্ঞান কতটা সীমিত সেটি ভাবতেই অবাক হতে হয়। এই দীর্ঘ সময়ে ১৫ আগস্ট আমাদের জীবনে অনেকবার ঘুরে এসেছে। আমরা দিনটি শুধু শোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে স্মরণ করছি না, দিবসটি থেকে নতুনভাবে শিক্ষা নিতেও পালন করে থাকি। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো আমরা কী শিক্ষা নিলাম। বারবারই তো সেই একই কথা শুনি এবং বলিও। বিএনপির শাসন আমলে ১৫ আগস্টকে না হয় উচ্ছৃঙ্খল কিছু সেনা কর্মকর্তার আচরণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর শাসন আমল, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে এমন সব বানোয়াট তথ্য পাঠ্যপুস্তকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল যা পড়ে শিক্ষার্থীরা ধরেই নিবে ওই ধরনের হত্যাকাণ্ড একটি ‘স্বাভাবিক’ ঘটনার পরিণতি হিসেবেই ঘটেছিল। সেই সময়ের পাঠ্যপুস্তকের কথা বাদ দিলাম। এখনকার কিছু কিছু বইতেও ‘উচ্ছৃঙ্খল কিছু সেনা কর্মকর্তার...’ লেখা হয়। একটু ভাবতে হবে যে, এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তা সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি, জাতির জনক, বাকশাল প্রধান, আন্তর্জাতিকভাবে তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবের বাসায় গিয়ে তাকে হত্যা করবেন এটি ভাবলে আমাদের জ্ঞানবুদ্ধিরও তো সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নিতে হবে। এ ছাড়া উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তারা না হয় ২/১টা বন্দুক জোগাড় করতে পারেন। কিন্তু ট্যাংক তারা পেল কোথায়। আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর এতগুলো ট্যাংক সেনানিবাস থেকে বের হলো উচ্ছৃঙ্খল কিছু সেনা কর্মকর্তার ইশরায়- এটিও কি মেনে নিতে হবে? বস্তুত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কোনো এক বা একাধিক উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তার কাজ নয়। যারা সেই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল তারা শুধু তাদের ওপর ‘অর্পিত দায়িত্ব’ পালন করেছিল মাত্র। তাদের পেছনে অনেক বড় বড় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং শক্তি জড়িত ছিল যাদের দীর্ঘ এবং সূক্ষ্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এরা একটি পর্বের অনুঘটক মাত্র। পদে পদে এদের চাইতেও অনেক বড় বড় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পাহারায় রত ছিল। ট্যাংকে কারা ছিল? ট্যাংকগুলো বের করার অনুমতি কারা দিল? তাদের পেছনে কারা দায়িত্ব নিয়েছিল? তারা আরো কত শক্তিশালী ছিল? এদের উপরে আরো কারা ছিল? তারপরেও দেশীয় যারা ছিলেন তাদের খুঁটির জোর সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই শক্তিতে তারা বলীয়ান হয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় নেতাকে হত্যা করার সাহস বা পরিকল্পনা কোনোটাই নিত না। নিশ্চয়ই তাদের পেছনে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক মুরব্বিশক্তি ছিল যাদের সঙ্গে তাদের ভালো বুঝাপড়া ছিল। এ ধরনের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে তাদের আশ্রয়ের জন্য হয়তো তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে যাওয়ার সব আয়োজন গোপনে তখন হয়তো রাখা ছিল। আবার তাদের পরিকল্পনা সফল হলে তারা ধীরে ধীরে মঞ্চে আসীন হওয়া, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সব আয়োজন রেখেই এ রকম একটি হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল। তবে আমরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যারা বঙ্গবন্ধুর বুকে বুলেট ছুড়েছিল কিংবা তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যার জন্য নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল শুধু তাদের কথাই শুনেছি, জানার চেষ্টা করেছি, বিচারের কাঠগড়ায়ও তাদের দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু অনুরূপভাবে শেখ মনির বাসায় কিংবা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় যারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল তাদের সবার নাম আমরা এখনো জানি না। আমরা জানি না ওইসব বাড়ির আশপাশে আর কারা কারা নজরদারিতে যুক্ত ছিল। তাহলে বিষয়টি দাঁড়ালো কেমন? এক কথায় বলা যায় আমরা এই মহাষড়যন্ত্রের সামান্য ক্ষুদ্র অংশের কিছু ব্যক্তির নাম জানি মাত্র। আর সেইসব ব্যক্তি যেহেতু সামরিক বাহিনীর সাবেক বা তৎকালীন অধস্তন কর্মকর্তা ছিল তাই তাদের ওইভাবে আমরা ব্র্যাকেট বন্দি করছি। ইদানীং বিএনপির নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে আওয়ামী লীগের খন্দকার মুশতাকরা জড়িত ছিল বলেই মুশতাক ‘রাষ্ট্রপতি’ পদ দখল করেছিল। এটাও আরেকটি চালাকি এবং খণ্ডিত যুক্তি। মানুষের দৃষ্টিকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখানোর এ এক বিস্ময়কর কল্পনাশক্তি! মুশতাক গংরা জড়িত ছিল এ কথা তো সবাই জানে। তারা ছিল সমগ্র ষড়যন্ত্রকারীর একটি অংশ যাদের ষড়যন্ত্রকারীরা কিছু সময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে রেখেছিল এবং ব্যবহারও করেছিল। তারা মুশতাককে সবদিক থেকেই তাদের জন্য উত্তম মনে করত কারণ মুশতাক এতটাই দুর্বল চিত্তের যে, তিন মাসও রাষ্ট্রপতির পদ ধরে রাখতে পারেনি। তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে আগামসি লেনে- যেখানে তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ‘বন্দি’ জীবন কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের পেছনের শক্তি এবং ব্যক্তিরা তো ১৫ আগস্ট সকাল থেকেই ‘ক্লিনশেইভ’ করে প্রস্তুতি নিতে থাকে, কখন মূল পদের নকল অভিনেতাদের সময় ফুরাবে! তাইতো একের পর এক ঘটনা ঘটার শুরু হয়েছিল। সেনাপ্রধান শফিউল্লার পত্রপাঠ বিদায়, সেনাপ্রধানের পদে উপপ্রধানের আসীন হওয়া এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যখন আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে তখনই খন্দকার মুশতাকের বিদায়ের ঘণ্টা বাজতে থাকে। বিদায়ের আগে তার হাত দিয়েই আরেকটি ইতিহাসের জঘন্য অপরাধ সমাপ্ত করার পরিকল্পনা ষড়যন্ত্রকারীরা বাস্তবায়ন করল- সেটি হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানায় রাতের আঁধারে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা- যেন এই ঘুরে দাঁড়ানোর রাজনৈতিক শক্তির কাণ্ডারি হিসেবে ওই চার জাতীয় নেতা মুক্ত হয়ে আসার সুযোগ না পায়। নানা ঘটনা দুর্ঘটনা তথা শক্তি পরীক্ষার ভেতর দিয়েই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহটি ষড়যন্ত্রকারীরা ছকমতো উতরিয়ে নিল। তারপর সেনাপ্রধানই আসনে আসীন হলেন। শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য নয়। তিনি এবং তার পরামর্শকরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটাকে আদর্শগতভাবে কীভাবে উল্টিয়ে দেয়া যায় সেই কাজটি প্রথম পাঁচ বছরে ভিত্তিপ্রস্তর এবং সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকতার সচলতা দিয়ে গড়ে তুলল। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রধান শক্তিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনকে ভেঙে তছনছ করে দিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে চার মূল আদর্শ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেগুলোকে নিয়ে বিকৃত ধারণার প্রচার করা হলো। গড়ে তোলা হলো পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা। তখন আন্তর্জাতিকভাবে নেপথ্যে শক্তিরা কীভাবে নতুন শক্তির সঙ্গে মিলেমিশে বাংলাদেশটাকে ১৯৭১-এর আগে অর্থাৎ ১৯৪৭-এর পরের ভাবাদর্শে নিয়ে গেল সেটি তো সবারই দেখার বিষয়। এখন এসব ঐতিহাসিক সত্য না জেনে না বুঝে আমরা যদি শিশু ভোলানো, পাড়া জুড়ানো গল্প দিয়ে ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ড, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রাষ্ট্রচিন্তাকে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল সেই গভীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কীয় ধারণা না রেখে কথা বলি, লেখালেখি করি এবং চিন্তা করি তাহলে আমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে- এটি বলতে হচ্ছে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App