×

মুক্তচিন্তা

পচা শামুকেও পা কাটে!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৩১ পিএম

কূপমণ্ডূকেরা পচা শামুকের মতো। ওরা যে কোনো সময় আপনার ক্ষতি করতে পারে। সুতরাং সত্যান্বেষীদের জানা প্রয়োজন কূপমণ্ডূকদের সম্পর্কে। তাদের কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তারা শিক্ষা থেকে ‘সত্য’ এবং ‘অগ্নি’ কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি, চেষ্টাও করেনি। প্রিয়া সাহা নামের কূপমণ্ডূকটিকে আমরা কোন কৌশলে মেরামত করব সেটা কি ভাবনার বিষয় নয়? আর যারা গুজব ছড়াচ্ছে, অস্থিরতা বাড়াচ্ছে, সেসব তাদেরইবা প্রতিহত করবে কে?

‘কূপমণ্ডূক’ শব্দের অর্থ ‘কুয়োর ব্যাঙ’, এ কথা বলাটা ঔদ্ধত্বই মনে করি; আমি জানি, কূপমণ্ডূক শব্দের অর্থ সবাই জানেন। কিন্তু কথা হলো ‘কূপমণ্ডূক’ কি কখনো আলোচনার বিষয় হতে পারে? এ প্রশ্নটি আমার মনেও জেগেছে বারবার। সত্যি তো কূপমণ্ডূকের কাছে জানার কী আছে, শেখারই বা কী আছে? কেউ হয়তো এ প্রশ্নও তুলতে পারেন, তুমি নিজেও কী কূপমণ্ডূকের দলভুক্ত, তাই কি কূপমণ্ডূক নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত? এর উত্তর আমার জানা নেই। একটা গল্প মনে পড়লো- একবার এক সমুদ্রের ব্যাঙ কোনোক্রমে এক কূপে এসে ঠাঁই পেল। দুদিন যাওয়ার পর সঙ্গত কারণেই সে হাঁপিয়ে উঠল। সে তার দুঃখের কথা বলল কুয়োর ব্যাঙের কাছে। কুয়োর ব্যাঙ বলল, ‘মন খারাপ করছ কেন ভাই! বেশ তো আছ নিরিবিলি-চুপচাপ?’ সমুদ্রের ব্যাঙ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘এখানে তো মনের সুখে সাঁতার কাটতে পারি না।’ কুয়োর ব্যাঙ অবাক হয়ে বলল, ‘সমস্যা কোথায়? সাঁতার কাটলেই তো পারো। সারাদিন সাঁতার কাটো। সারাদিন গা ভাসিয়ে রাখো জলে।’ সমুদ্রের ব্যাঙ ম্লান হেসে বলল, ‘এত ছোট পরিসরে কি সাঁতার কাটা যায়? আমি যেখানে ছিলাম, সমুদ্রে, সেখানে কত বিস্তীর্ণ জায়গা! সাঁতার কি শেষ হতে চায় সেখানে?’ ‘বল কী! কতবড় তোমার সমুদ্র?’ কুয়োর ব্যাঙ প্রশ্ন করল। সমুদ্রের ব্যাঙ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘এখানে এই কুয়োয় বসে কীভাবে বলব, সমুদ্র কত বড়?’ কুয়োর ব্যাঙ কুয়োর এপাশ থেকে ওপাশে তিন লাফ দিয়ে বলল, ‘সমুদ্র এর চেয়েও বড়?’ সমুদ্রের ব্যাঙ চুপ করে রইল। কী বলবে বুঝতে পারল না। আসলেই তো কুয়োর ব্যাঙকে কী দিয়ে বোঝানো যায় সমুদ্র কত বড়? সত্যি কথা, কুয়োর ব্যাঙকে আপনি কোনো কিছুতেই বোঝাতে পারবেন না তার সীমাবদ্ধতার কথা; তার পৃথিবীটা তো কুয়োতেই সীমাবদ্ধ। সুতরাং ‘কূপমণ্ডূক’ বিষয়ক এ লেখা কোনো কূপমণ্ডূকের জন্য নয়; বরং এ লেখা তাদের জন্য, যারা চোখ-কান খোলা রেখে পরিপার্শ্বকে দেখতে চান; যারা কিছু সত্য আবিষ্কার করতে চান। সত্যের সন্ধানে জ্ঞানের শরণাপন্ন হন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বাণীর মধ্যে আবিষ্কারের সেই সত্যটির ইঙ্গিত আছে; যার রহস্য উন্মোচন কূপমণ্ডূকের সাধ্যের অতীত। এরপর প্রশ্ন হলো, এ লেখা যদি কূপমণ্ডূকের জন্য না হয়, তাহলে সত্যান্বেষীদের জন্য কূপমণ্ডূকদের বিষয়ে জানার প্রয়োজন কেন? সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমাদের লোকবাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘পচা শামুকেও পা কাটে!’ কূপমণ্ডূকেরা পচা শামুকের মতো। ওরা যে কোনো সময় আপনার ক্ষতি করতে পারে। সুতরাং সত্যান্বেষীদের জানা প্রয়োজন কূপমণ্ডূকদের সম্পর্কে। তাদের কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তারা শিক্ষা থেকে ‘সত্য’ এবং ‘অগ্নি’ কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি, চেষ্টাও করেনি। প্রিয়া সাহা নামের কূপমণ্ডূকটিকে আমরা কোন কৌশলে মেরামত করব সেটা কি ভাবনার বিষয় নয়? আর যারা গুজব ছড়াচ্ছে, অস্থিরতা বাড়াচ্ছে, সেসব তাদেরইবা প্রতিহত করবে কে? কে আসবে শান্তির সপক্ষে এগিয়ে? ফেসবুক বন্ধুদের জন্য কূপমণ্ডূকদের সম্পর্কে জানাটা আরো বেশি জরুরি। কারণ ফেসবুকে দেখতে পাই, কিছু পণ্ডিত (যার সবকিছু পণ্ড হয়েছে) নানান বিষয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছে; সেসব স্ট্যাটাসে মনগড়া মিথ্যাও পরিবেশন করে যাচ্ছে। সেসব ‘পণ্ডিত’ নানান ‘তকমা’ও পাচ্ছে বিভিন্ন তথাকথিত সংগঠন থেকে। পুরস্কার আর সংবর্ধনার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে তারা। লক্ষ করলেই দেখবেন, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বিভিন্ন নামের সংগঠন। আর ‘আম’ সংগঠন কেন, আজকাল তো শুনতে পই নানান অপকৌশল আর অনাচারে সরকারি ‘পদক-পুরস্কার’র বগলদাবা করে নেয়া যাচ্ছে; নামের আগে ‘ড.’ ডিগ্রিও জুড়ে নেয়া যাচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। স্বাধীনতা মানে যেমন স্বেচ্ছাচারিতা নয়, তেমনি মুক্তবুদ্ধি চর্চা মানেও যা খুশি তা বলার স্বাধীনতা নয়। ফেসবুকের মতো উদার মিডিয়া ব্যবহারের আগে আমাদের শিষ্টাচার শিখে নেয়ার পাশাপাশি ইথিক্সটাও জেনে নেয়া প্রয়োজন। আমি জানি, কূপমণ্ডূকেরা ‘ইথিক্স’ শব্দের অর্থই জানে না; সুতরাং তাদের কাছ থেকে তেমনটি প্রত্যাশা করা যায় না। ওরা ওরকম অশ্লীলতা করবেই। সত্যান্বেষীদের সতর্কতাই একমাত্র রক্ষাকবচ। আমি শুধু বলতে চাই, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার স্বার্থেই আমাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন ওইসব কূপমণ্ডূকদের। দেশ ও সমাজকে কূপমণ্ডূকদের হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। ভ্রান্তির জালে পড়ে সত্যান্বেষীদের মধ্যেও যেন নতুন প্রজন্মের কূপমণ্ডূক জন্ম না নেয় সেদিকেও লক্ষ রাখা প্রয়োজন। যারা সমাজপ্রগতিতে বিশ্বাস করেন, যারা সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাকে এগিয়ে নিতে চান, তাদের নিবেদন করব দেখে-পড়ে-বুঝে স্ট্যাটাসে মন্তব্য করুন, লাইক দিন এবং শেয়ার করুন; কূপমণ্ডূকতার বিষ ‘ভাইরাল’ করবেন না। আমার ধারণা কূপমণ্ডূকতা একটা ব্যাধির মতো। যার মধ্যে জ্ঞানের আলো নেই, তার কূপমণ্ডূক হওয়া সহজ; অশিক্ষা-কুশিক্ষাও একজনকে কূপমণ্ডূক করে তুলতে পারে। আমাদের সমাজে তথাকথিত শিক্ষিতের সংখ্যা একেবারে কম নয়, যে কারণে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও আপনি কূপমণ্ডূকের দেখা পেয়ে যাবেন সহজেই। রিপুর তাড়নায় মানুষ যখন অন্ধ হয়ে যায়, তখন তার কূপমণ্ডূক হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। স্বার্থান্ধতা-ধর্মান্ধতাও মানুষকে কূপমণ্ডূক করে তোলে। কূপমণ্ডূকের ঔদার্য থাকে না, সহিষ্ণুতার ব্যাকরণও জানে না সে; অন্ধতা তাকে এতটাই গ্রাস করে, সে বুঝতেই পারে না, তার জানার বাইরেও পৃথিবী আছে। প্রায়শ সে ধর্মকে পুঁজি করে চলে, কিন্তু সে জানতেও পারে না, ধর্ম বলে, ‘নফসের বিরুদ্ধে জেহাদই সর্বশ্রেষ্ঠ জেহাদ- জেহাদে আকবর।’ দেশপ্রেমের মন্ত্রটি সে তার ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করতে চায় এবং যা সমাজের দশজনের জন্য অকল্যাণের কারণ হয়ে যায়। কূপমণ্ডূকতা যেহেতু একটা ব্যাধি, তার চিকিৎসা থাকাও প্রয়োজন। যে কোনো মনস্তত্ত্ববিদের কাছেই কূপমণ্ডূকের চিকিৎসা পাওয়া যেতে পারে, যদি সেই মনস্তত্ত্ববিদ নিজে কূপমণ্ডূক না হন। এর কার্যকর চিকিৎসার নাম প্রেম। ভালোবাসা আর যত্ন দিয়েই কূপমণ্ডূকের চিকিৎসা হতে পারে। দেশের অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করতে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে তারাও ষড়যন্ত্রের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে। ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তঋণ মাথায় নিয়ে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যে যাত্রা শুরু করেছিল, সে যাত্রা সহজেই মুক্তির দিশা খুঁজে পাবে। কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্তি পেলে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার যেমন বিকাশ ঘটবে, তেমনি দেশ ও জাতি উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার মহাসড়কে বেগবান হয়ে উঠবে।

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও লেখক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App