×

জাতীয়

বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধারে কেউই দায়িত্ব পালন করেনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০১৯, ১২:২১ পিএম

বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধারে কেউই দায়িত্ব পালন করেনি
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোরে শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা স্তম্ভিত হলাম। আমার বাবা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি শুনে বিস্মিত হয়েছেন। সেই অবস্থায় আমার সামনেই তিনি ৩২ নম্বরে ফোন দিয়েছিলেন। রিং হচ্ছিল। কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করেনি। তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, সেই অবস্থায় তিনি সেনাবাহিনী প্রধান কে এম সফিউল্লাহসহ এ কে খন্দকারকে লাল টেলিফোনে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন যে তোমরা এখনই বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার কর। তিনি এয়ার ফোর্সের এ কে খন্দকারকে বলেছিলেন যে প্রয়োজন হলে তোমরা রেডিও স্টেশনে বোম্বিং কর, বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার কর। কিন্তু তারা সেই দায়িত্ব পালন করেনি। গতকাল শুক্রবার দুপুরে ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে ভোরের কাগজের কাছে ’৭৫-এর আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব তথ্য জানান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম। নাসিম জানান, অনেকের ধারণা, নির্দেশ ছিল না, কোথায় নির্দেশ ছিল না? আমার বাবা রক্ষীবাহিনী এমনকি আইজিপিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে তোমরা ফোর্স পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার কর, খুনিদের গ্রেপ্তার কর। কিন্তু তারা সেই নির্দেশ পালন করেনি। বরং দেখলাম কয়েক ঘণ্টা পরই মোশতাকের মতো বেইমানের কাছে অনেকেই সারেন্ডার করেছে। নইলে আমার বাবা যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, তিনি সেটা পারেননি। কারণ একজন রাজনৈতিক নেতা নির্দেশ দিতে পারেন, রাস্তায় নেমে যুদ্ধ করতে পারেন না। ১৫ আগস্টের এই মুহূর্তটা আমার সব সময় মনে পড়ে, আমি শিহরিত হয়ে উঠি! সেই কালরাতের পরের দিনটি ছিল কাপুরুষদের আত্মসমর্পণের একটি মহড়ার দিন। যারা বঙ্গবন্ধুর লালিত-পালিত ছিল, তারাই এ ধরনের ঘটনা ঘটায়। কয়েকজন মন্ত্রিসভার সদস্যও হয়েছিলেন। এরপর বাসা থেকে আমার বাবাকে সরানো হয়। এর পরপরই আমাদের বাসাতেও হামলা করে তারা। আমি নিজেও আত্মগোপনে চলে যাই। আমাদের পেলে তারা হত্যা করে ফেলত। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে হলেও বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্নেহ ও ভালোবাসার কারণেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি আছে। সব স্মৃতি বলে শেষ করা যাবে না। সে সব কথা মনে পড়লে হৃদয়টা হু হু করে কেঁদে ওঠে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৬৬ অথবা ৬৭ সাল। আমি তখন পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে পড়তাম। পাবনা টাউন হলে বিশাল জনসভা হলো। বঙ্গবন্ধু সে জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। জনসভা শেষে সন্ধ্যার পর আমাদের পাবনার বাসায় এলেন। বুঝে অথবা না বুঝে যে কারণেই হোক আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতাম। বঙ্গবন্ধু খাওয়া-দাওয়ার এক পর্যায়ে আমাকে খুঁজলেন, বললেন-নাসিম কোথায়? আমি ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তখন তিনি অত্যন্ত স্নেহ করে আমার কান ধরে বললেন, তুই মনসুর আলীর ছেলে হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করিস; আমি ভয়ে ভয়ে বললাম- চাচা, আমি এখন থেকেই ছাত্রলীগ করব। এরপর আমি ছাত্রলীগ করি। যুবলীগ করেছি। এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ’৬৯ সালে ছাত্রলীগ করা অবস্থায় অ্যাডওয়ার্ড কলেজে নকশালরা (চরমপন্থি) আমার ওপর হামলা করে। প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি ছিলাম। বঙ্গবন্ধু খবর পেয়ে বাবাকে বলেছিলেন আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে। ঢাকায় আসার পর ৫/৭ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুও চলে আসেন আমাকে দেখতে। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তোর কোনো অসুবিধা নাই, তোর চিকিৎসা করাচ্ছি। শেখ কামালও ফলমূল নিয়ে আমাকে দেখতে আসতেন। শুধু মনসুর আলীর ছেলে হিসেবে নয়, আমি ছাত্রলীগ করতাম, তাই একজন কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাকে স্নেহ করতেন। নাসিম বলেন, শুধু আমাকেই নয়, ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের যে কোনো কর্মী বিপদে পড়লে বঙ্গবন্ধু তাদের পাশে দাঁড়াতেন, সহায়তা করতেন। আদর-স্নেহ ভালোবাসা দিতেন। পাবনায় আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীর নাম আহমেদ রফিক। তিনি আমাদের সিনিয়র। রফিক ভাই ছিলেন খুবই সংগ্রামী ও লড়াকু। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে সবাই তাকে চিনতেন। যদিও তিনি একেবারেই মফস্বলের একজন কর্মী। ছোটবেলা থেকেই আমি তার ভক্ত ছিলাম। ’৭০ এর নির্বাচনে রফিক ভাই সাঁথিয়ার আসন থেকে নমিনেশন চেয়েছিলেন। আব্বা তাকে বলেছিলেন, সাঁথিয়ায় তুমি কিভাবে নির্বাচন করবে, সেখানে তো তোমার নিজের বাড়ি নাই, সেটা তোমার নানার বাড়ি। তখন তিনি আমাকে এসে বলেন যে নাসিম, তুমি চাচাকে (আব্বা) বলিও সাঁথিয়ায় যদি আমাকে নমিনেশন দেয়া না হয়, তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। বঙ্গবন্ধু তোমাকে চেনেন, স্নেহ করেন, তুমি বঙ্গবন্ধুকে বলবে আমার নমিনেশনের কথা। তখন আমি সাহস করে পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়িতে টেলিফোন করলাম। বঙ্গবন্ধু ফোন ধরলে আমি বললাম চাচা, রফিক ভাই তো সাঁথিয়া থেকে নির্বাচন করতে চায়। বঙ্গবন্ধু বললেন, তার তো বাড়ি শহরে, সে ওখানে নির্বাচন করতে চায় কেন? তাকে নমিনেশন না দিলে সে আত্মহত্যা করবে। বঙ্গবন্ধু তখন বলেন, কি বলিস? আমি বললাম জি চাচা। তখন বললেন মনসুর কি বলে, আমি বললাম চাচা আব্বা এ বিষয়ে কিছু বলবেন না। যা করার, আপনাকেই করতে হবে। তখন তিনি বললেন ঠিক আছে, আমি দেখতেছি। আল্লাহর রহমতে রফিক ভাই নমিনেশন পেয়ে বিজয়ীও হয়েছেন। জেতার এক দিন পর ট্রেনে করে ঢাকায় আসেন সবাই। ওইদিন রাতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর খবর আসে, রফিক ভাইকে চরমপন্থিরা মেরে ফেলেছে। নির্বাচনে জেতার সমস্ত আনন্দ-উল্লাস থেমে গেল। বঙ্গবন্ধু পরদিন ফেরি হয়ে পাবনায় রফিক ভাইয়ের বাসায় গিয়ে তার মাসহ পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না দিলেন। বিশাল জনসমুদ্রে বক্তব্য দিলেন। ক্ষুব্ধ চেহারা নিয়ে ৩ থেকে ৪ মিনিটের ভাষণে তিনি বললেন, এই খুনিরা আমার আহমেদ রফিককে হত্যা করল। এর আগে মনসুর আলীর ছেলে নাসিমকে আঘাত করেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে। কোনো বিশৃঙ্খলা হোক, আমি তা চাই না। না হলে আমি যদি হুকুম দেই, এই খুনিদের গুষ্টিসহ উচ্ছেদ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি তোমাদের ধৈর্য ধরতে বলছি, তোমরা ধৈর্য ধর। এর বিচার হবে। জেলা পর্যায়ের একজন নেতার জন্য একজন ভাবী প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার বাসায় যাওয়া, সান্ত¡না দিয়েছেন, পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এটা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হওয়ায় তিনি তা পেরেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App