×

মুক্তচিন্তা

সঠিক মানব ব্যবস্থাপনা অতি জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০১৯, ০৮:৫২ পিএম

সরকারের চিন্তাচেতনা ও কর্মপরিকল্পনায় মানব ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্মসূচি আছে কিনা জানি না, না থাকলে তা থাকা প্রয়োজন। সমস্যা হলো আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ক্রমেই কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা সদরে। কর্মসংস্থান এর প্রধান কারণ। এ ছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসার মতো জনহিতকর সব প্রতিষ্ঠানের অবস্থান শহরে হওয়ায় মানুষ বেশিমাত্রায় শহরমুখী হচ্ছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বভাবগত কারণেই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে বর্তমান সময়ে সামাজিক অস্থিরতার এক চরম রূপ দৃশ্যমান। পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার মতো উদ্ভট গুজব, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিরীহ মানুষের মৃত্যু, প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মানুষ হত্যা ইত্যাদি ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ বিরাজমান। এ ছাড়া সড়কের বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, মাদকের বিস্তার, ঘুষ-দুর্নীতি, অনাচার-ব্যভিচারের মতো অনাহূত ঘটনার উপর্যুপরি সংঘটনে মানুষের মন বিষাদপূর্ণ। অনাকাক্সিক্ষত এই পরিস্থিতি উত্তরণে করণীয় কী হবে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ কম। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপালন, রাজনীতি থেকে পেশিশক্তির বিযুক্তি, বিত্তের জোর হ্রাস, গুণগতমানসম্পন্ন শিক্ষা, সংস্কৃতির বিস্তার, সর্বস্তরে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রতিকার হিসেবে বিদগ্ধজনদের আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। মতামতসমূহ নিঃসন্দেহে যথার্থ। এর অতিরিক্ত যে বিষয়টিকে অতি গুরুত্ব সহকারে সামনে আনা উচিত সেটি হলো মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যাগত সমস্যা। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা পূর্বোক্ত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাবলির প্রধান উৎস। বিষয়টি নিয়ে অতীতে কোনো কোনো লেখায় দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা আমি নিজেও করেছি, অন্য দুচারজনও করছেন; কিন্তু ফলোদয় হচ্ছে না। নীতিনির্ধারক মহল এদিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন না। যার দরুন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরো গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা আছে।

সবাই জানেন যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে। জনসংখ্যার বর্তমান প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১.০৩ যা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নয়। প্রবৃদ্ধি আরো হ্রাস পাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তৎপরতা কম থাকায় সেটি হচ্ছে না। আমাদের দেশের আয়তন খুব ক্ষুদ্র, মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব বর্তমানে ১১শ জনের অধিক। সিঙ্গাপুর, হংকং, ম্যাকাও, মনাকো এ রকম কয়েকটি নগর ও দ্বীপরাষ্ট্রের কথা বাদ দিলে সারা পৃথিবীতে এত অধিক জনঘনত্বের দেশ আর নেই। ১৪৩ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে লোক বাস করে ১৪৮ জন। ভারতের জনসংখ্যা ১৩৬ কোটি, বর্গকিলোমিটার প্রতি জনঘনত্ব সেখানে ৪১৬ জন।

একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, দেশের জনসংখ্যার গড় প্রবৃদ্ধি ১.০৩ হলেও ঢাকার প্রবৃদ্ধি ৩.৬০। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উৎস থেকে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটি ২ লাখ ৮৩ হাজার। বিগত বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭৮ হাজার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এই শহরে লোক বাস করে আনুমানিক প্রায় ৪৬ হাজার। এত অধিক জনঘনত্বের শহর পৃথিবীতে বোধকরি দ্বিতীয়টি নেই। ঢাকার অরাজক পরিস্থিতির উৎস আসলে এই অস্বাভাবিক জনসংখ্যা। দিন দিন এ সংখ্যা কেবল বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে, কমার লক্ষণ তো নেই-ই, নেই স্থিতিশীল থাকার লক্ষণও। এর সঙ্গে পাল্টা দিয়ে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা। প্রাকৃতিক দুর্যোগও এখানে গভীর হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। অর্থনীতিবিদ মালথাস জ্যামিতিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিণতিস্বরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বলেছিলেন। তার এই ভবিষ্যদ্বাণী বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, বিশেষত ঢাকায় সত্য হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক ডেঙ্গু জ্বরের কথা ধরা যায়। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। ঢাকার ঘনবসতির প্রভাব এখানে আছে অনুমান করি। নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা নগর অধিকর্তাদের নেই। একই কথা প্রযোজ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণপরিবহনসহ অন্য ক্ষেত্রেও। দায়িত্বপ্রাপ্তরা সফল না হওয়ার পেছনে অন্য অনেক কারণের ভেতর বড় কারণ অস্বাভাবিক জনবসতি। ঢাকামুখী মানুষের লাগাতার স্রোত বন্ধ ও বর্তমান সংখ্যা থেকে তা কমানোর প্রচেষ্টা ছাড়া কেবল ফ্লাইওভার, মেট্রো ইত্যাদি দ্বারা নগরকে সচল ও বাসোপযোগী রাখা যাবে না। সেজন্যই প্রয়োজন সঠিক মানব ব্যবস্থাপনা।

গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো নতুন সমস্যা রোহিঙ্গাদের নিয়ে। আমাদের উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সুযোগ নিয়ে চতুর মিয়ানমার সরকার ওদের ব্যাপকহারে আমাদের দেশে ঠেলে দিয়েছে। এ সংখ্যা এখন ১১ লাখ। এদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে চলছে নতুন ছলচাতুরি। কাজকর্মহীন মানবেতর শিবির জীবন অনির্দিষ্টকালের জন্য ভাবা যায় না, এর অন্যথা হবেই। হচ্ছেও তা-ই। এদের একাংশ মাদক ব্যবসাসহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে সামাজিক সমস্যা তীব্র করছে। আমাদের স্থানীয়রা সংখ্যায়লঘু হয়ে পড়ায় ভবিষ্যতে ওদের সঙ্গে পেরে ওঠে কিনা সন্দেহ আছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে প্রায় ১ কোটি লোক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কেবল পাকিস্তান ভাঙার জন্য না, শরণার্থীর চাপে তাদের সমাজজীবন যাতে সংকটগ্রস্ত না হয় এবং শরণার্থীরা যেন শিগগিরই নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সেজন্যও। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ না হোক, অন্তত কূটনৈতিক যুদ্ধে জয়ী হয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে, নতুবা আমাদের সমাজে এর কুপ্রভাব পড়বে।

দুই. সরকারের চিন্তাচেতনা ও কর্মপরিকল্পনায় মানব ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্মসূচি আছে কিনা জানি না, না থাকলে তা থাকা প্রয়োজন। সমস্যা হলো আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী ক্রমেই কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা সদরে। কর্মসংস্থান এর প্রধান কারণ। এ ছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসার মতো জনহিতকর সব প্রতিষ্ঠানের অবস্থান শহরে হওয়ায় মানুষ বেশিমাত্রায় শহরমুখী হচ্ছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বভাবগত কারণেই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। চাহিদারও পরিবর্তন ঘটছে। সন্তানদের জন্য শিক্ষা, পরিবারের সদস্যদের জন্য চিকিৎসা, উন্নত জীবনযাপন এখন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠছে নতুন সঙ্গতিপ্রাপ্ত গ্রামীণ অনেক পরিবারের। তারা শহরমুখী হচ্ছেন। শহরের ওপর চাপ বাড়ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে সুযোগসন্ধানীরা, ফাঁদ পাতছে শিক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসার। সেবার প্রশ্ন তো গৌণই, মান বলতে কিছু নেই তাদের গড়া প্রতিষ্ঠানে; আছে কেবল পকেট ভারী করার কৌশল। সমস্যা এখানে তদারকির, সক্ষমতা নেই সরকারের এদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠার। ডেঙ্গু জ্বরের সাম্প্রতিক প্রকোপ অনেক দুর্বলতার প্রকাশ ঘটালো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর হিসাব দিতে গিয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়ে, সন্দেহের উদ্রেক হয় ঢাকায় গড়ে ওঠা কয়েকশ বেসরকারি হাসপাতালের খবরাখবর তারা ঠিকমতো রাখে কিনা! এদিকে মশার ওষুধ ক্রয় এবং তার কার্যকারিতা ও ছিটানো নিয়ে সিটি করপোরেশনের লেজেগোবরে অবস্থা প্রমাণ করে তাদের সক্ষমতা কতটুকু! এই প্রসঙ্গে আবার তুলতে হয় ঢাকায় জনাধিক্যের কথা। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। সেটিও কারণ।

শহরমুখী মানুষের স্রোতের বড় কারণ কর্মসংস্থান। গার্মেন্টস ছাড়াও গরিব মানুষের কর্মসংস্থানের উল্লেখযোগ্য খাত হলো পরিবহন, নির্মাণ, ফুটপাতে হকারকর্ম ইত্যাদি। বলা বাহুল্য সবক’টি খাতই শহরনির্ভর। কৃষি খাতে শ্রমিক সংকটের কথা বহুল আলোচিত। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো সেখানে সারা বছর কাজ জুটে না, মৌসুমভিত্তিক কয়েক মাস কাজের সুযোগ হয়, বাকি সময় বেকার কাটাতে হয়। ফলে তারাও শহরমুখী। নিরক্ষরদের জন্য রিকশা ও কিছুটা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্নদের জন্য অটোরিকশা কোনো কোনো শহরে এখন কর্মসংস্থানের বড় অবলম্বন। এসব যানের চাপে পথচারীদের রাস্তা পারাপারও কঠিন হয়ে পড়ছে। ঢাকার মতো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে সেসব শহরের পরিস্থিতিও। ঘন জনবসতির কারণে পুলিশ চাইলেও অপরাধপ্রবণতা দূর কিংবা শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হতে চলেছে সেখানেও।

অতএব সঠিক মানব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রথমত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান গতি রোধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান এবং শিক্ষা, চিকিৎসার মতো অপরিহার্য অনুষঙ্গের সুযোগ বিকেন্দ্রীকরণ করে ঢাকাসহ প্রধান জনবসতির শহরসমূহের ওপর চাপ হ্রাস করতে হবে। নতুবা এগুলো অপরাধ ও নানান উপসর্গের ঘাঁটি হবে যার দমন সাধ্যাতীত হয়ে উঠতে পারে অদূর ভবিষ্যতে।

মজিবর রহমান: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App