×

মুক্তচিন্তা

রিফাত হত্যাকাণ্ড: বরগুনার ঘটনার আয়নায় আওয়ামী লীগের মুখ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০১৯, ০৮:৫২ পিএম

আমাদের দেশে রাজনীতিতে চলছে ল্যাং মারার খেলা। নেতৃত্ব নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় কে কাকে কোন কৌশলে হটিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করবে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। সরকারি দল, বিরোধী দল এক্ষেত্রে সমানে সমান। এক দলে এখন বহু দল। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। লাভালাভ, ভাগবাটোয়ারার সুযোগ বেশি। তাই আওয়ামী লীগে কোন্দলও বেশি। পাওয়ার দল এবং না পাওয়ার দলে দ্বন্দ্ব প্রবল। নিজেদের নিন্দা-সমালোচনায় নিজেরা মুখর।

গত ২৬ জুন বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে। এ বিষয়ে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওইদিনই ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন দুর্বৃত্ত একজনকে কোপাচ্ছে, একজন নারী আক্রমণকারীদের আটকানোর চেষ্টা করছেন। অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটি দেখছেন, কেউ আক্রান্তকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসেননি। যে নারী প্রতিরোধের চেষ্টা করেছেন, তার নাম আয়শা সিদ্দিকী মিন্নি, তিনি রিফাত শরীফের স্ত্রী। গুরুতর আহত রিফাতকে বরিশাল মেডিকেলে নিয়েও বাঁচানো যায়নি। এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি গণমাধ্যমেও ব্যাপক প্রচার পায় এবং বিভিন্ন মহল থেকেই ঘাতকদের গ্রেপ্তার এবং দ্রুত বিচারের দাবি উঠতে থাকে।

হত্যাকাণ্ডটি প্রকাশ্যে ঘটেছে। কারা এটা করেছেন, অনেকেই তা দেখেছেন। তাদের নাম-পরিচয়ও গণমাধ্যমে এসেছে। এদের পরিচয়, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, মদদদাতা- কোনো কিছুই গোপন নয়। আশা করা হচ্ছিল, অপরাধীরা যেহেতু চেনা সেহেতু তারা কেউ ছাড় পাবে না। রিফাত হত্যার বিচার যথাযথভাবে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক কিছুই আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয় না। সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি ঢুকে যায়। আর আমাদের দেশে রাজনীতি মানেই নোংরামি, রাজনীতি মানেই পক্ষ-বিপক্ষ এবং প্রতিপক্ষ ঘায়েল।

আমি রিফাত হত্যার ঘটনাটি শুরু থেকেই আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি। হত্যাকাণ্ডটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার একটি অপচেষ্টাও লক্ষ করছি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এই হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বাস্য-অবিশ্বাস্য নানা বিষয় সামনে এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার আয়োজন পেছন থেকে করা হচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা কিংবা তাদের অপরাধকে লঘু করার জন্য বিশেষ প্রভাবশালী মহল প্লট তৈরি করছে, গল্প বানাচ্ছে এবং গণমাধ্যমের কেউ বুঝে এবং কেউ না বুঝে পরিস্থিতি ঘোলা করছে।

রিফাত হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নয়ন বন্ড এবং অন্য দুজন হলো রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজি দুই ভাই। এই দুই ভাই আবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার পুত্র। এরা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। এদের কাজকর্মে মানুষ অতিষ্ঠ। কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে পারে না। বরগুনার ‘ডন’ বলে পরিচিত নয়ন বন্ডকে সবাই দেলোয়ার হোসেনের নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসী-মাস্তান বাহিনীর প্রধান বলে জানেন। তার মানে রিফাত হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই দেলোয়ার হোসেনের ‘লোক’। তাদের সাত খুন মাফ। আগেও এরা অনেক অপরাধ করেছে। কিন্তু তাদের প্রভাব বলয় এত বড় যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা পরোয়া করে না। তাদের আসলে জেলে থাকার কথা। কিন্তু তারা মুক্ত মানুষ হিসেবে বাইরে থাকেন এবং একের পর অপরাধ করেও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারেন। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন এবং তার সমর্থকরাই যে এদের শক্তির উৎস সেটাও সবার জানা। আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সভাপতি, সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভুর বিরুদ্ধ গ্রুপের নেতা দেলোয়ার হোসেন। সেজন্য দেলোয়ারের অনুসারীরা কোনো অপরাধ করলে তার দায় দেলোয়ার হোসেনের ওপর আসা উচিত। শুরুতে আসছিলও তাই। কিন্তু এখন বিষয়টির ওপর নানা রং ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে। বরগুনার পাঁচবারের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভুর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত আছেন কেউ কেউ। তাকে রাজনীতি থেকে হটিয়ে দিয়ে জায়গা দখলের স্বপ্নও আছে কারো কারো। ধীরে ধীরে তার বিপক্ষে একটি বলয় গড়ে উঠছে। তবে তাদের চেহারা-চরিত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকায় ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়েও তারা সুবিধা করতে পারছেন না। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হয়তো সব খবরই আছে। তাই তিনি আওয়ামী রাজনীতির দুঃসময়ের কা-ারি ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভুর কাছ থেকে নৌকা কেড়ে নেননি। তার ওপর আস্থা হারাননি।

সম্ভুবিরোধীরা হাল ছাড়তে চান না। বরং সারাক্ষণ সুযোগের জন্য ওঁৎ পেতে থাকেন। সম্ভুকে বড় কোনো ঝামেলায় জড়াতে পারলে নৌকা তাদের। সম্ভু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তার হাতে রাজনৈতিক ‘ক্ষমতা’- এটা দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মোশতাক-প্রেতাত্মারা সহ্য করতে পারছে না। তারা এবার রিফাত হত্যার পর আবার নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকায় এসেছেন মশিউর রহমান শিহাব নামের এক নব্য আওয়ামী লীগার। তারেক রহমানের স্নেহধন্য হয়ে রাজনীতির পথশিশু বিপুল বিত্তের অধিকারী হয়েছেন। তারপর এক সময় নানাজনকে কৌশলে হাত করে আওয়ামী নৌকায় চড়ে বসেছেন। তিনি নাকি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ‘সহসম্পাদক’। এখন তার লক্ষ্য সংসদ সদস্য হওয়া। সম্ভু থাকতে তিনি সুবিধা করতে পারবেন না। তাই তাকে ঘায়েল করার উদ্যোগ-পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে আছেন শিহাব। বরগুনায় এসব কথা অনেকেরই জানা। তবে তার ‘টাকা’ এবং ‘কেন্দ্রের’ জোর সবাইকে চুপ করিয়ে রাখছে। অবশ্য শিহাব সঙ্গে পেয়েছেন ঢাকার একটি দৈনিকের বরগুনা প্রতিনিধিকে। এই সাংবাদিক তার পত্রিকায় ‘আজগুবি’ খবর পরিবেশন করেন। তারপর শিহাবের টাকায় আট-দশ হাজার পত্রিকা কিনে নিয়ে বিনা পয়সায় বরগুনায় বিলি করেন। মানুষ বিভ্রান্ত হয়। তাদের জানা তথ্যের সঙ্গে ‘ঢাকার পত্রিকা’য় প্রকাশিত খবরে তথ্যগত ভুলভ্রান্তি দেখে। ছাত্রলীগের একটি অংশকেও শিহাব তার পক্ষে পেয়েছেন, তাদের পকেট খরচ জুগিয়ে। বরগুনা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এখন এমন কেউ কেউ আছেন যারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী নন, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। এমনকি শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার এক আসামির আপন মামাতো ভাই এখন তালতলী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি পদে আছেন।

ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভুর জন্য রাজনীতির পরিবেশকে ‘ডিফিকাল্ট’ করার সব ব্যবস্থা করছেন তার বিরোধীরা। সম্ভুর বড় ব্যর্থতা বা দুর্বলতা হলো তিনি সাধারণ মানুষের সমর্থন পেলেও দলের মধ্যে বিরুদ্ধ পক্ষের বেড়ে ওঠা দুর্বল করতে পারেননি। ফলে বিরোধীরা এখন বেশি সক্রিয়।

আমাদের দেশে রাজনীতিতে চলছে ল্যাং মারার খেলা। নেতৃত্ব নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় কে কাকে কোন কৌশলে হটিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করবে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। সরকারি দল, বিরোধী দল এক্ষেত্রে সমানে সমান। এক দলে এখন বহু দল। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। লাভালাভ, ভাগবাটোয়ারার সুযোগ বেশি। তাই আওয়ামী লীগে কোন্দলও বেশি। পাওয়ার দল এবং না পাওয়ার দলে দ্বন্দ্ব প্রবল। নিজেদের নিন্দা-সমালোচনায় নিজেরা মুখর। সারাদেশ থেকেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের খবর পাওয়া যায়। নির্বাচন এলে মনোনয়ন পাওয়ার প্রতিযোগিতা দৃষ্টিকটুভাবেই সামনে আসে। দলীয় সিদ্ধান্ত না মানার প্রবণতাও কম নয়। দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়টি আওয়ামী লীগ সম্ভবত গুরুত্ব দেয়নি। তার কুফল দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। আওয়ামী লীগ কেমন চলছে তার একটি প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে বরগুনা আওয়ামী লীগকে আয়নার সামনে ধরলে। বরগুনায় আওয়ামী লীগে এমপি গ্রুপ বনাম এমপিবিরোধী গ্রুপের দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়ায় তার প্রভাব পড়ছে সমাজের নানা ক্ষেত্রে। আজকাল ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বলয়ে বা আশ্রয়ে না থাকলে অপরাধ সংঘটিত করা যায় না। তাই অপরাধীরা এখন নেতা খোঁজে, দল খোঁজে। যতটুকু খবর জেনেছি, বরগুনায় বেশির ভাগ অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সম্ভুবিরোধী নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে।

রিফাত হত্যার ঘটনায় কোনোভাবে এমপি কিংবা তার ছেলের সংশ্লিষ্টা প্রমাণ করতে পারলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা সহজ হয়। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে সম্ভুবিরোধীরা। আমরা দোষীর শাস্তি চাই। একজন নির্দোষও অহেতুক হয়রানির শিকার হোক- সেটা চাই না। ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভু ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। জিয়া ও এরশাদের আমলে কারানির্যাতন ভোগ করেছেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে অবিচল বিশ্বাসের কারণেই তিনি বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন। তার নির্বাচনী এলাকায় শতকরা ৯০ ভাগ ভোটার মুসলিম। তিনি উপমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। বর্তমানে একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার মতো একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র সফল হলে অপরাজনীতিরই জয় হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো একজন ঝানু রাজীতিবিদ, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানকে জীবন সায়াহ্নে এসে ‘৭০ লাখ টাকা ঘুষ’ গ্রহণের অভিযোগ মাথায় নিয়ে গ্লানির জীবনযাপন করতে হয়েছিল। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়, যোগাযোগ থাকায় তার কষ্টের কথা আমি জানতাম। ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভুর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। তার সম্পর্কে জানি সাংবাদিকতা পেশায় দীর্ঘদিন জড়িত থাকার কারণে। তিনি ভালো মানুষ, না খারাপ মানুষ সেটা জানেন তার এলাকার লোকজন। রাজনীতির একজন সার্বক্ষণিক মানুষ হিসেবে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আছে। রিফাত হত্যার বিচার সবারই দাবি। প্রকৃত অপরাধীরা যাতে রেহাই না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে।

বিভুরঞ্জন সরকার: যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App