×

জাতীয়

ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০১৯, ১১:৪৫ এএম

ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা
মহামারির রূপ নিতে যাচ্ছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যু। গতকাল রবিবারই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৭১২ জন। আরো ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ৬৪ জেলায়। ঈদুল আজহায় রাজধানী ছাড়বেন লাখো মানুষ। বেশিরভাগই যাবেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অনেকেই নিজের শরীরে বহন করবেন ডেঙ্গুর ভাইরাস। তাদের মাধ্যমে ডেঙ্গু পৌঁছে যাবে দেশের আনাচে-কানাছে। এ ছাড়া এখন আগস্ট মাস; ডেঙ্গু প্রজননের ভরা মৌসুম। চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অনেকের আশঙ্কা, অতিদ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে ঘটে যাবে ভয়াবহ বিপর্যয়। কিন্তু মশা নিধনের কার্যকর ওষুধ নেই দেশে। যে টুকু আছে, তাতে মশা মরে না। ওষুধ আনতে হবে বিদেশ থেকে। দেরিতে হলেও সেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কিন্তু তাও সময় লাগবে। কবে নাগাদ ওষুধ আসবে, এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারেননি কেউ। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ আগস্টজুড়ে রাজধানী থাকবে এডিসের দখলে। এতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তাই ভেবে আতঙ্ক বাড়ছে নগরবাসীর। এদিকে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ৬৪ জেলাতেই। গতকাল নেত্রকোনায় ৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দাবি করেন, সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘সুন্দরভাবে সব ম্যানেজ’ করা হচ্ছে। তবে তিনিও স্বীকার করেন, দেশে ডেঙ্গুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে সেপ্টেম্বর মাসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায়ও আগস্ট মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের গত আট বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগস্টে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি থাকে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সব্রিনার মতে, সহসা ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার সম্ভাবনা কম। কারণ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ রোগের ভাইরাসবাহী এডিস মশার প্রজনন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর বর্ষা শুরুর আগে (৩ থেকে ১২ মার্চ) যে জরিপ পরিচালিত হয় তাতে প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশার সংখ্যা যা ছিল, বর্ষাকালীন (১৭ থেকে ২৮ জুলাই) জরিপে তা বেড়েছে ছয়গুণ। কয়েকগুণ বেড়েছে মশার লার্ভাও। আর এ কারণেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। দুই সিটি করপোরেশন এলাকার এক হাজার বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বর্ষা শুরুর আগে জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মশার ঘনত্ব ছিল ২৬টি, উত্তরে ২১টি। বর্ষাকালীন জরিপে এর ঘনত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯টি এবং উত্তরে ৫৭টি। গবেষণায় অধিকাংশ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে নির্মাণাধীন ভবনে, পরিত্যক্ত টায়ারে, প্লাস্টিকের ড্রামে, বালতি, খোলা ট্যাঙ্ক ও ফুলের টবে জমে থাকা পানিতে। এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, যেভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। তবে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব বলে আমার বিশ্বাস। একইসঙ্গে তিনি জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী ইতোমধ্যে দক্ষিণের ১১ ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এক অনুষ্ঠানে গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক এবং এটা মোকাবেলা করা কঠিন। তবে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু যে কোনো সিজনাল রোগ নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই ৩৬৫ দিনই এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এবং বিশেষ বিমানে করে মশা নিধনের নতুন ওষুধের নমুনা আনা হচ্ছে জানিয়ে মেয়র বলেন, ওই নমুনা ওষুধের কার্যকারিতার ওপর মহাখালীর একটি ল্যাবরেটরিতে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা চালানো হবে। আরো ৩ জনের মৃত্যু : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার আবদুল মালেক (৩০), বুধবার ঢাকার ইসলামিয়া হাসপাতালে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ফারুক খানের (২২) মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া নওগাঁর আত্রাইয়ের আবদুল ওয়াহাব (৭৫) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় হাসপাতালে যাওয়ার পথে মারা যান বলে খবর পাওয় গেছে। ডেঙ্গু রোগীর জন্য ঢাকার ৩ হাসপাতাল প্রস্তুত হচ্ছে : গতকাল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) ডেঙ্গু বিষয়ক এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে চিকিৎসাধীন থেকেও প্রতিদিন খোঁজ নিচ্ছেন ও নির্দেশনা দিচ্ছেন। ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেলে যাতে সামাল দেয়া যায় সে জন্য ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এই তিনটি সরকারি হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্যাথলজি পরীক্ষার কিট ও রিএজেন্ট আমদানি করা হচ্ছে। কুরবানির ঈদে ঢাকার মানুষ গ্রামে গেলে ডেঙ্গু আরো ছড়িয়ে পড়ার যে শঙ্কা রয়েছে, তা মোকাবেলার পরিকল্পনাও আগে থেকে করার ওপর জোর দেন তিনি। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য হাসপাতালে ১০০ বেডের আলাদা ওয়ার্ডের উদ্বোধন করেন মন্ত্রী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার এন্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১৯ হাজার ৫১৩ জন। মৃতের সংখ্যা ১৪ জন। গতকাল বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৭১২ জন। ঢাকার বাইরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৪৬৪ জন। বিভাগ অনুযায়ী ঢাকা বিভাগের (ঢাকা শহর ছাড়া) জেলাগুলোতেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। ঢাকা বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় ১৪৫ জন, চট্টগ্রামে ৯৪, খুলনায় ৭৬, বরিশালে ৬৩, ময়মনসিংহে ৬২, রাজশাহীতে ৫৮, রংপুরে ৩৩ এবং সিলেটে ৩১ জন আক্রান্ত হয়েছে। এদিকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট আনার প্রথম দিন গতকাল ১৬৮ জন শিক্ষার্থীর রক্ত পরীক্ষা করে ১৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত করা হয়েছে বলে কেন্দ্রের চিকিৎসক জানিয়েছেন। ঢাকা ও আশপাশকে ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণার দাবি জাসদের : গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে রাজধানীসহ সংলগ্ন অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল গঠনের দাবিও জানায় দলটি। অভিযান ও জরিমানা অব্যাহত : ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে পাঁচটি নির্মাণাধীন ভবন, হাসপাতাল ও দপ্তরকে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী তিন লাখ ২২ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। গুলশান-২ এ ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিদ আনোয়ার এই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। এদিকে রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল এবং তোপখানা রোডের মোস্তফা সার্জিক্যালকে মোট দেড় লাখ টাকা জরিমানা করে। এরা ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট ও সরকার নির্ধারিত পরীক্ষার ফির চেয়ে বেশি দাম রাখায় এই জরিমানা করা হয়। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের নেতৃত্বে এই অভিযান চালানো হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App