×

সাময়িকী

মহাদেব সাহার কবিতায় চরিতচর্চা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০১৯, ০৬:৩৮ পিএম

মহাদেব সাহার কবিতায় চরিতচর্চা

মহাদেব সাহা প্রকৃতিনির্ভর কবি। কিন্তু সে প্রকৃতির দিকে তাকালেও তিনি রবীন্দ্রনাথকেই দেখতে পান।

কবিতায় চরিতচর্চা নতুন কোনো বিষয় নয়। মধ্যযুগের বেশির ভাগ আখ্যান যেমন ‘ইউসুফ-জুলেখা’, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’ বা বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য বিভিন্ন চরিত্রকে নিয়েই রচিত হয়েছে। তবে এইসব কাব্যের মূল চরিত্র দেবতা বা উচ্চবংশীয় সম্মানিত ব্যক্তি। আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্যায়ে সমাজের শ্রেণিভেদ উপেক্ষা করে বিশিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাহিত্যিক ব্যক্তিকে নিয়ে কবিতা লেখার প্রচলন হয়। মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চরিতচর্চামূলক কবিতা রচনা থেকে পিছিয়ে থাকেননি। মহাদেব সাহার কবিতায় বিষয়বৈচিত্র্যের অনুক্রমে চরিতচর্চা একটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। অসংখ্য কবিতায় নানান চরিত্রের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত অনুরাগ, শ্রদ্ধা বা তাদের মহত্ত্ব প্রকাশিত। বিভিন্ন সাহিত্যিকসহ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চরিত্র তাঁর লেখায় বিশেষ আবেদনের সৃষ্টি করেছে। দেশ-কাল-সমাজ-প্রতিবেশ পর্যালোচনায় চরিত্রগুলোর প্রতি কবির কাব্যামোদী সাহিত্য সৃষ্টি তাঁর লেখনীকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করা হয়। জনগণের দাবির মুখে তা পুনরায় প্রচার করতে বাধ্য হয় সরকার। ১৯৬৭ সালে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন ‘জাতীয় ভাবধারা ও আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে’ বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার হবে না বলে বক্তব্য প্রদান করেন। বুদ্ধিজীবীদের সরাসরি অংশগ্রহণে ‘এভাবেই বিভাগোত্তর সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী রবীন্দ্রনাথ পরিণত হয়েছিলেন একটি আন্দোলনের উৎসভূমিতে, বাঙালি জাতিসত্তার পুনরুজ্জীবনের ধারাবাহিকতায় তিনি সংলগ্ন ছিলেন অখণ্ড চৈতন্যের বিশালতায় ও ঐশ্বর্যে।’ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া দুটি স্বতন্ত্র দেশের সৃষ্টি হলে পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, আন্দোলন ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের কবিদের কাব্যে সেই রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ, বঞ্চনার রোষ, সংক্ষোভ, অধিকার আদায়ের দৃঢ় মনোভাব এবং প্রতিবাদের সংরাগ সংস্থাপিত হয়েছে। মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় শান্তিনিকেতনকে প্রার্থনার স্থান বলে তাকে বাঙালির তীর্থস্থানে পরিণত করেছেন। মহাদেবের মতো তরুণ যুবকদের কাছে রবীন্দ্রনাথ একটি অনুপ্রেরণার নাম, একটি অন্তঃসলীল স্বপ্নের উৎস। যুগের, সময়ের, যান্ত্রিকতার তীক্ষè নখরে রক্তাক্ত বাঙালি যুবকের ক্ষতস্থান সারিয়ে দেয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁদের কাছে ‘নিজস্ব বর্ণমালা’। যান্ত্রিক পেষণে জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত এসব যুবক ‘সঙ্গীতের উদার নিসর্গে’ নিঃশ্বাস নেয় এবং ‘ধীরে ধীরে বেঁচে’ ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কল্যাণে- আমরা কবিতায় যুবা তাই আর সব পরিচয় যখন ভুলে যাই এমনকি ভুলে যাই নিজেদের নাম, তখনো মনে রাখি রবীন্দ্রনাথ আমাদের আবহমান বাংলাদেশ আমাদের প্রদীপ্ত বিপ্লব, রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জীবনের পথ-প্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ। অন্যায়ভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনে তাঁকে বাঙালির প্রাণের সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। চিরঅম্লান রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির অঘোষিত পতাকা, সবুজ দীপ্তিময় সতেজ কণ্ঠস্বর। বাঙালির কাছে তার অস্তিত্ব উপেক্ষিত হতে পারে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নন। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের আরেকটি নাম, আরেকটি বিপ্লব। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, রবীন্দ্রনাথ ততদিন বাংলার প্রাণে জাগরূক থাকবেন। তিনি বাংলার ঐতিহ্য, তিনি বাংলার অহংকার। মহাদেব সাহা প্রকৃতিনির্ভর কবি। কিন্তু সে প্রকৃতির দিকে তাকালেও তিনি রবীন্দ্রনাথকেই দেখতে পান। রবীন্দ্রনাথকে উপেক্ষা করে কেউ ফুল-পাখি-নিসর্গকে অনুভব করতে পারে না, কারণ বাংলার চিরন্তন প্রকৃতি মানেই রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি : আমি যখন এই প্রকৃতির দিকে তাকাই দেখি রবীন্দ্রনাথ দেখছেন প্রকৃতির নীলাম্বরী সেই ব্যাকুল বসন্তে আমারও দুচোখ জলে ভরে যায়- এই মেঘ, এই গোলাপ আমারও অলিখিত কবিতা। তুমি একবার প্রতিবাদ করো চেতনার মধ্যে দংশন করুক তোমার সঙ্গীত। মহাদেব সাহা মনে করেন, ‘চণ্ডীদাস-মাইকেলের মহৎ উত্তরাধিকার বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের হাতে সম্পূর্ণতা পায়, প্রথম আধুনিক ও বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে’। ‘রবীন্দ্রনাথের কাছে বাংলা কবিতার ঋণের শেষ নেই ... আধুনিক বাংলা কবিতা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যের শিকড় সামান্য নয়’। ‘সমগ্র জীবনব্যাপী এক অতিমানবীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে, প্রায় নিঃসঙ্গ ও একা’। ‘উন্নত সংস্কৃতির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বড় হয়েছিলেন। সেখানে ক্ষুদ্রতা ও মিথ্যার অবকাশ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ যেমন মহৎ কবি তেমনি পরিপূর্ণ মানুষও।... এই মহৎ কবি ও মহৎ মানুষ রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই’। রবীন্দ্রনাথ যেমন বাঙালির হৃৎস্পন্দনে অনুভূত হন ঠিক তেমনি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ, ফুল-পাখি-বৃক্ষের রক্তের ভেতরে ধ্বনিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। বাংলাদেশের কবিতায় যে অসীম সাহসী মানুষটির নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে তিনি হলেন স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শেখ মুজিব চলমান একটি স্বপ্ন, অবিনাশী এক গান। বাংলাদেশের প্রতিশব্দ শেখ মুজিব, শেখ মুজিবের প্রতিশব্দ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও শেখ মুজিব বাঙালির হৃদয়ে প্রোথিত অভিন্ন অস্তিত্ব, দীপ্তিতে দীপ্যমান; স্বাধীনতা আন্দোলন তাঁর প্রায় একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর প্রতি উৎসারিত আবেগদীপ্ত বাণী ধ্বনিত হয়েছে মহাদেবের কণ্ঠে। কারণ তাঁর মননে এবং বাংলার প্রকৃতি জুড়ে ফুটে ওঠে শেখ মুজিবের অমল মুখখানি : কিন্তু এই যে প্রতিদিন বাংলার প্রকৃতিতে ফুটছে নতুন ফুল শাপলা-পদ্ম-গোলাপ-সেই গোলাপের বুক জুড়ে ফুটে আছে মুজিবের মুখ ... ... ... আমার না-লেখা প্রতিটি নতুন কবিতা জুড়ে গাঁথা আছে তার নাম, তার মুখচ্ছবি লিখি বা না লিখি শেখ মুজিব বাংলাভাষার প্রতিটি নতুন কবিতা। জীবনানন্দ দাশের মতো মগ্ন চৈতন্যের কবি, যিনি স্বভাবমনস্কতার ফলে ট্রামের নিচে চাপা পড়েছিলেন তার মতো ‘ট্র্যামের নিচে পড়ে হাড়গোড় বেরিয়ে গেলেই কখনো চাঁদ উঠবে না ট্র্যাম রাস্তায়/সেই ভাঙা পাঁজরে ফুটে উঠবে না কবিতা’, তার জন্য রীতিমতো সাধনা করা প্রয়োজন। এছাড়াও তিনি বিদ্রোহী সত্তা, ‘ঝড়’ কাজী নজরুল ইসলাম, ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব’-এর মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ‘তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি’র জসীমউদ্দীন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কবি বিনয় মজুমদার, ‘মেঘদূতে’র কালিদাস, কীটস, ব্লেক, রিলকে, দান্তে, বোদলেয়ার, বিপ্লবী মায়াকোভস্কি, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, পাবলো নেরুদা প্রমুখ কবির কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। এছাড়াও তাঁর কবিতায় আছে বেগম রোকেয়া ও চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, আচার্য জয়নুল আবেদীন, পটুয়া কামরুল হাসান, জগদীশ বসু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিখ্যাত শিকারি জিম করবেট প্রমুখ প্রসঙ্গ। গৌতম বুদ্ধের উপমায় বারবার তাঁর অনিকেত মনোবৃত্তির পরিচয় রেখেছেন। আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে তিনি গ্রেনাডার দুঃখী মানুষের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদের শান্ত, নীরব, মুগ্ধ প্রকৃতির দ্বীপটির নির্জনতা নষ্ট করার জন্য দায়ী করেছেন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানকে : গ্রেনাডার প্রিয় ভাইবোন, রেগান তোমাদের শান্তি কেড়ে নিয়েছে উপহার দিয়েছে তোমাদের ক্রন্দন ও সন্ত্রাস, তোমাদের শস্যক্ষেতগুলোকে পরিণত করেছে যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের শিশুদের চোখের মদির স্বপ্ন ও ঘুম অপহরণ করেছে। পৃথিবীর বর্তমান উন্মত্ততার জন্য কবি বুশকে অভিযুক্ত করেছেন। সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবীর নেপথ্যে নিরাপদ আমেরিকার জন্য তিনি ‘প্রাচীন সভ্যতার বুক’ ‘মিসাইল বোমা ও ট্যাঙ্কে’ বিদীর্ণ করতেও পিছপা হননি। কবি তাকে বলেছেন প্রেমের সীমাহীন শক্তির কথা, মানবিকতার সহজাত সংক্রমণের কথা : জগদ্বিখ্যাত বসরাই গোলাপের চেয়ে দোজখের আগুন যদি তোমার বেশি পছন্দ হয়, তাহলেও আমার কোনো কথা নেই, কিন্তু শ্রী চৈতন্যের দেশে আমার জন্ম আমি তোমাকে প্রভু যীশুর নামে শপথ করে বলতে পারি প্রেমেই মুক্তি।

সাম্যবাদের শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় কমরেড লেনিন (১৮৭০-১৯২৪) স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে মার্কসীয় তত্ত্বের আলোকে পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয় অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে। তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ এবং সচেষ্ট সংগ্রামের ফলে মেহনতি মানুষের অধিকারে এসেছে শস্য, খামার এমনকি শিল্পকারখানা পর্যন্ত। ফলে : লেনিন নামের অর্থ আমি তাই করি শোষণহীন একটি গোলাপ লেনিন নামের অর্থ আমি তাই করি শোষণমুক্ত একঝাঁক পাখি, লেনিন নামের অর্থ আমি তাই করি শোষণহীন একটি সমাজ। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার হঠাও আন্দোলনে নূর হোসেন তার বুকেপিঠে লিখেছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। গণতন্ত্র বাংলার বুকে এসেছিল বটে তবে তা নূর হোসেনের বুকের রক্ত ঝরানোর পর। কবির দৃঢ় প্রত্যয় বলে ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ : আমি যদি আজ তোমাদের কোনো প্রিয় কবিতার কথা বলি, তাহলে সেই কবিতার নাম নূর হোসেন আহা নূর হোসেন আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা; এই কবিতাটি লেখা হয়েছে ঢাকার উন্মুক্ত রাজপথে .... .... .... আহা নূর হোসেন এই ইতিহাসের অমর অধ্যায়, নিজের বুকেই সে ঝুলিয়েছিলো সবচেয়ে সাহসী ব্যানার করেছিলো খোদাই নিজের বুকে রাত জেগে বিদ্রোহী কবিতা। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কবির কণ্ঠস্বর পরিণত হয়েছিল গণকণ্ঠস্বরে। স্বৈরাচারবিরোধী জাতীয় কবিতা উৎসবে আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ডা. মিলনের হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে মা সেলিনা বেগম ও স্ত্রী কবিতার উপস্থিতিতে তিনি আবৃত্তি করেন ‘বাংলাদেশ চায় না তোমাকে’ : বাংলাদেশ চায় না তোমাকে, তুমি চলে যাও, যাও কতো যে মায়ের খালি বুক ফেলে দীর্ঘশ্বাস- রক্তমাখা হাত, তুমি ক্ষমা চাও, ক্ষমা ভিক্ষা চাও। তোমাকে চায় না এই সোনালি ধানের ক্ষেত, কচি দূর্বা, দীর্ঘ শালবন এরই ধারাবাহিকতায় কমরেড ফরহাদের মৃত্যু উপলক্ষে শোকগাথায় কবির আক্ষেপ প্রকাশিত হয়েছে। তার মৃত্যুতে গণআন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছে, অনাথ হয়েছে ডেমরা, পলাশবাড়ির অসংখ্য কিশোর শ্রমিক, বৃদ্ধ ক্ষেতমজুর। স্বৈরশাসকের রাজত্ব আরো শক্তিশালী হয়ে আমন্ত্রণ জানাল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চকচকে লোভনীয় গালিচাকে। পর্ণকুটিরের বাংলাদেশ তার অনুপস্থিতিতে মাটির সাথে সংযোগ স্থাপনে কুব্জ্য দেহে নত হলো : তোমার মৃত্যুতে তাই অকস্মাৎ ঝলসে যায় সবুজ অরণ্য তাই তো নদীর বুকে পালের নৌকায় ছলকে ওঠে জল, হঠাৎ ভীষণ ধস নামে এইখানে মানুষের মনে। কমরেড ফরহাদ, তোমার মৃত্যুর পর কেন যেন বাংলাদেশ উঠে দাঁড়ায় না আর মনে হয় হঠাৎ বসন্ত যেন চলে গেছে, কুয়াশার মাঠে বিচরণ করে শুধু বার্ধক্য, বিকৃতি আর বন্ধ্যা পুঁজিবাদ। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মাতৃসত্তার প্রোজ্জ্বল প্রতিমূর্তি। তার ভালোবাসার পুণ্যতোয়ায় আমরা ম্লান করে পবিত্র হয়ে উঠি। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনীয় তার মাতৃত্বের স্থৈর্য ও সহনশীলতা। শহীদজননী কেবল আর রুমির মা থাকেন না হয়ে যান মুক্তিযুদ্ধের মা। বাংলার হৃদয়, নদী, মাতৃস্নেহ হয়ে তিনি বারবার ফিরে আসেন। যুগে যুগে স্বাধীনতার অপশক্তি ও দুঃসময়ের প্রেতাত্মাকে দূর করতে শহীদজননীর প্রদীপ্ত ছবি আমাদের মনে সাহস জোগায় :

মানবিকতার এই ভীষণ খরায়, দাবদাহে যখন কেবল পিশাচের জয়োল্লাস শুনি, অট্টহাসি দেখি তখন আপনার অভয় প্রদীপ্ত ছবি ভেসে ওঠে; নত হয়ে আমি এই শহীদ মিনারের বেদীতে ঠেকাই মাথা, এই ধূলি স্পর্শ করি, মহাদেব সাহা তাঁর কাব্যে চরিতচর্চার যে ধারাবাহিক ক্রম বজায় রেখেছেন তাতে করে তাঁর কবিতা বৈচিত্র্য সম্ভারে যেমন ঋদ্ধ হয়েছে তেমনি পাঠককে নতুনত্বের আস্বাদন দানে, মনোমুগ্ধকর ও বিচিত্রময় উপস্থাপনে করে তুলেছেন হতচকিত। কবিতাগুলোর মাধ্যমে দেশি, বিদেশি নানা চরিত্রের পরিচয়দান করে উল্লেখযোগ্য চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য সংযোজনে কাব্যকে আকর্ষণীয় ও নতুনতর ব্যঞ্জনার জন্ম দিয়েছেন। বাংলা কবিতার ধারাবাহিক ক্রমানুসারে চরিতচর্চার প্রবাহটিকে বেগবান করেছেন স্বকীয় মননজাত আবেগ ও বুদ্ধির সাযুজ্যে। জাতীয় নেতা, বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক (দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক), ব্যক্তিগত সম্পর্কের চরিত্র, অসাম্প্রদায়িক লালন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উল্লেখযোগ্য বামপন্থি বৈপ্লবিক চরিত্র, শহীদ বিপ্লবী, সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতাধর ব্যক্তি ইত্যাদি ইতিবাচক ও নেতিবাচক চরিত্রগুলোর প্রোজ্জ্বল উপস্থিতি এবং তাদের জন্য নিবেদিত পঙক্তিমালা কবিহৃদয়ের মর্মমূল থেকে উৎসারিত। গভীর আবেগ এবং সংযত, সংহত, সুনিব্যস্ত প্রকাশে চিত্তাকর্ষক হয়ে কবিতাগুলো শিল্পকে ধারণ করেছে তার ইমেজের প্রতিটি স্তরে। কবিতায় চরিতচর্চার চিরন্তন রীতি চমৎকারভাবে স্বকীয়ধারায় ধরে রাখার জন্য মহাদেব সাহা অকুণ্ঠ প্রশংসার দাবি রাখেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App