×

সাময়িকী

কী করে কবিতা হয় কেউ জানে না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০১৯, ০৯:২৩ পিএম

কী করে কবিতা হয় কেউ জানে না
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহা। বাংলাদেশের মাটি, জল আর প্রকৃতি তাঁকে কবি হতে উৎসাহিত করেছে। রক্ত মাংস, শিরা উপশিরা, হৃদয় এবং হৃৎপিণ্ড থেকে উৎসারিত নানা সৌরভে ভরপুর মহাদেব সাহার সব কবিতা। তিনি প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, একাকিত্বের কবি। মহাদেব সাহা ফুল, বৃক্ষ, আকাশ, মেঘ, নদী, ঢেউ, ভালোবাসা, দুঃখ কষ্ট আর যাতনাকে সাবলীল ভাষায় পরম দরদ দিয়ে চমৎকার সব চিত্রকল্প ব্যবহার করে বিনির্মাণ করেছেন একেকটি কবিতা। কাব্য বিনির্মাণে তাঁর যে দরদ আর মমতা সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন পড়ি ‘কফিন কাহিনী’, ‘আবুল হাসানের জন্য এলিজি’, ‘মানব তোমার কাছে যেতে চাই’, ‘দেশপ্রেম, ‘ফিরে আসা গ্রাম’ কিংবা ‘চিঠি দিও’ বা ‘আজীবন একই চিঠি’, ইত্যাদি কবিতা। কবি মহাদেব সাহা সারা জীবনই একজন বন্ধু খুঁজেছেন! যে পিতৃশোক ভাগ করে নিতে পারে। কিন্তু পেয়েছেন কি সেই বন্ধু। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ৭৬তম জন্মদিন সামনে রেখে ভোরের কাগজের পক্ষ থেকে মহাদেব সাহার মুখোমুখি হয়েছিলেন কবি ও সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন

প্রশ্ন : দাদা আপনাকে জন্মদিনে অগ্রিম শুভেচ্ছা। মহাদেব সাহা : ধন্যবাদ তোমাকে। প্রশ্ন : কবিতা এই সমাজে কোনো কাজে লাগে না- এমন কথা কেউ বললে আপনি কী এর মীমাংসা দেবেন? মহাদেব সাহা : এক অর্থে লাগেই না তো! সে অর্থে কবিতা কিছু করে না। কিন্তু কবিতা যা করে তা চোখে দেখা যায় না। মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়, অন্য সবকিছু যা করতে পারে না, কবিতা তাই করে। কবিতা মানুষকে সভ্যতার দিকে নিয়ে যায়। মানুষের আত্মোপলব্ধি জাগাতে ভেতর থেকে কাজ করে। কবিতা মানুষের বোধের প্রসার ঘটায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কবিতা-গানই তো মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই যে মানুষের পরিবর্তন, কবিতা সরাসরি ঘটায় না কিন্তু সে অনুঘটক। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা দিয়ে আমরা বিশ্ব জয় করি। কবিতা কাজ করে যায় ভেতরে ভেতরে- দেখা যায় না। মানুষকে মানুষ করে তোলে কবিতা। মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, জাগতে হতে শেখায়, নিজের দিকে ফিরে তাকাতে শেখায়, আর কী চাই কবিতা থেকে। কবিতা সরাসরি কিছু করে না- আড়াল থেকে করে। প্রশ্ন : একটি কবিতা কীভাবে আপনার ভেতরে জন্ম নেয়? মহাদেব সাহা : এর উত্তর আমি জানি না। কীভাবে কবিতার জন্ম- সেটা একটা বর্ণনাতীত রহস্য, এই নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। এটা ব্যাখ্যাতীত, এর উত্তর দেয়া যায় না- উত্তর হয় না। কবিতা কীভাবে লেখা যায়- সেটা বুঝিয়ে বলা যায় না। প্রশ্ন : আপনার বেশির ভাগ কবিতাই আত্মজৈবনিক বলে মনে হয়। পাঠক হিসেবে আমি মনে করি- আমার কথাই বলছেন কবিতায়। মহাদেব সাহা : এটাই তো কবির কাজ। যে পড়বে তার যদি মনে হয় আমার জন্যই লিখেছে- তাহলেই তো কবিতা লেখাটা সার্থক। আমার জন্য যা লেখা হয় তা আসলে সবার জন্য লেখা হয়। সবার মধ্যে একটা আমি আছে। সেই আমিকে জাগিয়ে দেয়াই তো কবির কাজ। এত গূঢ় কথা এত ভারি ভারি কথা বলার তো দরকার নেই। কবিতা পড়ে কেউ আনন্দিত হলো- কারো মনকে নাড়া দিল, তাহলেই তো হলো। ভালো লাগাটাই সব- ভালো লাগাই সব। প্রশ্ন : আপনি জীবনের প্রায় পুরোটা অংশই একটা আবেগের মধ্যে ডুব দিয়ে কাটিয়ে দিলেন। কথায় আছে আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। কিন্তু আপনার তো চলে গেল! আপনার বেশিরভাগ লেখাই গভীর আবেগের। মহাদেব সাহা : ভালো বলেছো তো। আবেগই হচ্ছে জীবনের সব, আবেগ থেকে বিপ্লব হয়েছে, আবেগ থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, আবেগ থেকে প্রেম হয়। যা কিছু মহৎ অর্জন তার মূলে হলো এই আবেগ। আবেগ থেকেই কবিতা উৎসারিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, ‘সোনার তরী’, কিংবা ‘শেষ বসন্ত’ পড়ে দেখো- শুধু আবেগ আর আবেগ। আমার আর কি আবেগ আছে! আমি আবেগকে এভাবেই নিয়েছি। বাংলা কবিতায় আবেগ প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল। নিরস, দুর্বোধ্য এবং অর্থহীন পঙ্ক্তি জুড়ে দিয়ে বাংলা কবিতাকে একটা কাঠিন্যে পরিণত করা হয়েছিল। আমি সেখান থেকে কবিতাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। কবিতার প্রতি পাঠক বিমুখ হয়ে পড়েছিল, আমি সেই জায়গা থেকে পাঠককে কবিতায় ফিরিয়ে এনেছি। কথাটা আমি বাড়িয়ে বলিনি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার আমার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন- ‘আমি অবাক হয়ে যাই যে মহাদেবের কবিতা উপন্যাসের সমান জনপ্রিয়। বইমেলায় উপন্যাস যেমন একাধিক সংস্করণ বের হয় তেমনি মহাদেবের কবিতার বই একাধিক সংস্করণ বের হয়। আমি আবেগকে উপজীব্য করেছি এ কারণে বাংলা কবিতায় মানুষ ফিরে আসুক।’ প্রশ্ন : আপনি কবি না হলে কী হতেন বা অন্য কিছু হওয়ার স্বপ্ন ছিল কিনা? মহাদেব সাহা : আমি জন্মের আগে থেকেই কবি। কবি হয়েই আমি জন্মেছি। জন্মগ্রহণ করার পর আমি কবি হইনি। জীবন আমাকে কবি বানিয়েছে।

প্রশ্ন : সুদীর্ঘকাল ধরে কবিতা লিখছেন। নতুন করে আবার গান লেখাতেও হাত দিয়েছেন। মহাদেব সাহা : হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। ৫ শতাধিক গান নিয়ে আমার দুটি বই বেরিয়েছে। কবিতার চেয়েও বেশি সুখ পাচ্ছি গান লিখে। আমি এখন গানে ডুবে আছি। গান না লিখলে বোঝতেই পারতাম না- গান না লিখলে কবি হওয়া যায় না। গানের মধ্যে কী যে সৌন্দর্য। গানের মধ্যেই আমি আমার সমস্ত দুঃখ ভোলার চেষ্টা করছি। এই গানগুলোর মধ্যে আমার সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আমি আশ্রয় খুঁজেছি- আশ্রয় পেয়েছি। এই গান না লিখতে পারলে আমি বোধহয় পাগল হয়ে যেতাম। আমি লিখছি সেই পাঁচ কবির ধারাতেই। প্রশ্ন : গান লেখার শুরুটা কি একটু দেরিতে হয়ে গেল না? রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল তো সে প্রথম জীবন থেকেই গান লিখতে শুরু করেছিলেন। মহাদেব সাহা : দেরি হলেও শুরু করেছি তো! গানের মধ্যে আমার ব্যকুলতা, আমার বেদনা, আমার অন্তরদাহ, আমার নিঃসঙ্গতা- আমি গানের মধ্যে এখন প্রকাশ করছি। আমার কী মনে হয় জানো- মনে হয় রবীন্দ্রনাথ আমাকে বললেন- তুমি আমার না লেখা গানগুলো লিখ। গান আমাকে খুব আনন্দ দেয়, খুব সুখ দেয়। যদিও আমি গাইতে পারি না। কিন্তু নিঃশব্দ সুর আমার মধ্যে বেঁধে যায়। সেই গান আমি নিজে অনুভব করি। কিন্তু সেই নিঃশব্দ সুর আমি কাউকে গেয়ে শোনাতে পারি না। সে ভাগ্য রবীন্দ্রনাথের ছিল। হাজার পাখির গান ছিল তার কণ্ঠে। রবীন্দ্রনাথের গান পৃথিবীর মাতৃভাষা। প্রশ্ন : আপনি আসলে যেখানে পৌঁছতে চেয়েছিলেন সেখানে কি পৌঁছতে পেরেছেন বলে মনে হয়? মহাদেব সাহা : আমি যেখানে পৌঁছতে চেয়েছিলাম- সেখানে পৌঁছতে পারিনি। আমি যে কত মায়াজালে আবদ্ধ! কত লোভের কাছে হেরে গেছি। এই ব্যর্থতা নিয়েই চলে যেতে হবে। তবুও আমি যে ভালোবেসেছিলাম আকাশ, বৃষ্টির ধারা, নদীর কল্লোল ধ্বনি, পাখির গান, বাংলার মাটি। আমি যে নদীর তীরে বেড়ে উঠেছি সেটার নাম ‘ফুলজোড়’। এই ফুলজোড় নদীর ঢেউ এখনো কানে বাজে। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলার নদী, জল-আকাশের কথা ভেবে আমার দুচোখ জলে ভরে উঠে। প্রশ্ন : পিতৃশোক ভাগ করে নেয়ার মতো কোনো বন্ধু কি পেয়েছেন সারা জীবনে? মহাদেব সাহা : মানুষ কখনো মানুষের এত বন্ধু হয় না। রবীন্দ্রনাথের কোনো বন্ধু ছিল না। ঈশ্বরই মানুষের একমাত্র বন্ধু। তার কাছেই সব কিছু পাওয়া যায়। তিনিই কেবল সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার। আমার দুঃখে ঈশ্বর যত ব্যথিত হন- তত ব্যথিত আমি নিজেও হই না। কিন্তু সবই আমার কৃতকর্মের ফল। ঈশ্বর আমার জন্য কাঁদেন। মানুষের কাছে সহানুভূতি চাওয়া এক ধরনের অজ্ঞানতামাত্র। প্রশ্ন : আপনার কবিতায় এখন বেশ আধ্যাত্মিকতা লক্ষ করা যায়। কবিতার বাঁক পরিবর্তন হয়েছে মনে হয়। মহাদেব সাহা : কবিতায় এটাই আমার এখনকার সন্ধান। দর্শন- আধুনিকতা। কোথাও সমর্পণও কোনো এক মহাশক্তির কাছে। এটা যদি কেউ না বুঝে বলে বোঝানো যাবে না। এটা ব্যাখ্যাতীত উপলব্ধি। দেখো- কবিতা ঝরে যায়, সময়ের ঘুণপোকা কবিতাকে খেয়ে ফেলে। এর মধ্যে থাকে দর্শন সে অংশটা টিকে থাকে। আধ্যাত্মিকতা টিকে থাকে। আমাদের এই আধুনিক কবিতার ধারায় দার্শনিকতা কম, একমাত্র সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বাদে, তার কবিতা দর্শন চিন্তায় ভরপুর। রবীন্দ্রনাথে তো সবই আছি। আমি রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কবিতার কথা বলছি। ইউরোপিয়ান কবি টি এস এলিয়টের কবিতা দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক আবহ একেবারে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। আমরা কেউ কেউ না বুঝে তাকে মনারকিজমের সমার্থক বলেছি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে এলিয়টের কবিতা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ¦লতর হয়েছে উঠছে। তোমরা যদি আমার কবিতা মন দিয়ে পড়ো তাহলে কবিতায় যে পরিবর্তন সেটা লক্ষ করবে। কবিতায় আমি এখন মন্ত্রের সন্ধান করি। প্রশ্ন : নবীনদের নিয়ে আপনার কিছু বলার আছে? মহাদেব সাহা : যে কোনো সাহিত্যে নবীনরাই আশা, তারাই সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখে। তাদের হাতেই কবিতা-গদ্য নতুন হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের পরে কি কবিতা থেমে আছে? আমি নবীনদের দিকে তাকিয়ে আছি, তাদের সাফল্যের দিকে তাকিয়ে আছি, তাকিয়ে আছি তাদের পূর্ণতার দিকে। আমাদের সাহিত্যকে তারা আরো সমৃদ্ধ করে তুলুক। আমাদের লেখা দিয়ে যা হয়নি- নবীনদের লেখা দিয়ে তাই হবে। তারাই তৈরি করবে সাহিত্যের নতুন ভবিষ্যৎ, নতুন পথ। আমি সেই ভবিষ্যতের দিকেই তাকিয়ে আছি। নবীনদের মধ্যেই একটি সমাজের সাহিত্য বেঁচে থাকে। আমি সে জন্যই নবীনদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি, নবীনদের পানে তাকিয়ে থাকি। নবীনদের লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App