×

মুক্তচিন্তা

প্লিজ! মানুষের জীবন নিয়ে খেলবেন না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০১৯, ০৯:১১ পিএম

একটি রাষ্ট্রের সরকারের ভেতরটায় যদি এমন সমন্বয়হীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে প্রায় প্রতিনিয়ত, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়। সমস্যা দূর করার উপায় কী থাকে আর! প্লিজ! মানুষের জীবন নিয়ে খেলবেন না আপনারা! দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করুন! মশা নিরস্ত্র প্রাণী। ওটাকে প্রাণে মারতে সততার আশ্রয় নিন। আন্তরিকতা আর সুষ্ঠু দায়িত্ব পালন হোক মশা নিধনের মূল অস্ত্র।

চলতি বছরে রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। যার মধ্যে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা বেশি বিপাকে। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গত বছর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১০ হাজার ১৪৮ রোগী। এ বছরে এই সময়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় সাতগুণ বেশি। এত আয়োজন, এত কর্মতৎপরতা এডিসের বিরুদ্ধে দেখে আসছি যে, তারপর কী করে এতটা ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়, ভেবে অবাক হই। একটা সময় পর্যন্ত ঢাকা শহরের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা, শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা, মশা মারা, ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা ইত্যাদি কাজগুলো তো ছিল সিটি করপোরেশনের একটা মাথায়। পরবর্তী এই কাজগুলোকে সুষ্ঠু, সহজ ও পরিপূর্ণভাবে করার জন্য একটা মাথাকে অস্ত্রোপচার করে দুটি মাথা অর্থাৎ দুটি সিটি করপোরেশনের জন্ম দেয়া হয়েছে। একটি মাথা উত্তর, আরেকটি মাথা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। জন্মের পর থেকেই দুই মেয়রকে দুই মাথা নিয়ে বেশ সক্রিয় হতে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিষয়ে মাথা ঘামাতে দেখা গেছে। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে শপথের সঙ্গে নিজেরা হাতে ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এডিস মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছেন। মনে পড়ে একবার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘোষণা দিয়ে বসলেন, কোনো বাসা-বাড়িতে যদি এডিস মশার ডিম পাওয়া যায়, তাহলে সেই বাসা-বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদিও পরবর্তী সময় জানার সৌভাগ্য হয়নি যে, এডিস মশার ডিম ও প্রজনন ক্ষেত্র শনাক্ত হওয়ার পর দায়ী করে ক’জন বাসা-বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সেই সময়ে ভীত হয়ে একটি লেখাও লিখেছিলাম। কারণ আইনের ঝামেলায় পড়ে হয়রানির শিকার বা জেলজুলুম সহ্য করার মতো সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক শক্তি কোনোটাই তখন ছিল না। এখনো নেই। আর তা ছাড়া পথেঘাটে জমা পানি, ডোবা, ডাস্টবিন থেকে যে মশা বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করে, তা রোধ করার ক্ষমতা তো আমাদের মতো অতি সাধারণ নাগরিকের নেই। এ ছাড়া এমনিতেই নিত্যদিন পুলিশি হয়রানির কত ঘটনা চারপাশ। জঙ্গি, মাদক ব্যবসায়ীদের চোখ দিয়ে দেখা যায়, মশার ডিম স্পষ্টভাবে দেখার উপায় কী! যাই হোক রেকর্ডসংখ্যক রোগী নিয়ে ঢাকার হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে রোগী। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে অভিভাবকদের ভয় যাচ্ছে না। প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় আসছে সেসব সংবাদ। এমন একটা অবস্থায় হাডুডু খেলা খেলছে দুই সিটি করপোরেশন ও কতিপয় মন্ত্রীর মাঝে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দৌড় দেয়া, না ধরতে দেয়া, না ধরা পড়া। শৈশবে কিন্তু হাডুডু খেলা বেশ লাগত। শারীরিক শক্তি আর বুদ্ধিমত্তা তথা চালাকির খেলা এটা। ধরা না দিয়ে প্রতিপক্ষকে ছুঁয়ে নিজের ঘরে ফেরার ভেতর জয়ী হওয়ার খেলা। মেয়র, মন্ত্রীদের কে জয়ী হবেন, তা খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘোষণা দেয়া যাবে না। একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায় যে, গত বছর সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখেন যে, ওষুধ অকার্যকর। ওই বছরের ২২ মে এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ওষুধ পরিবর্তনের উদ্যোগ না নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা আবার পরীক্ষা করা হয়। এখানেও একই ফলাফল আসে। উত্তর সিটি করপোরেশনে এই ওষুধ অকার্যকর হিসেবে বাতিল করা হলেও দক্ষিণে এই ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কী দুই করপোরেশনে দুধরনের এডিস বসবাস করছে? যেটা তারাই জানেন, বাকি সব নাগরিক জানেন না। এমন অভিজ্ঞতা কিন্তু নতুন নয় যে, সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের ভেতরও হাডুডু খেলা চলে। ব্যর্থতার দায়ভার কেউ নিতে চান না। বরং দোষারোপের সংস্কৃতি বেশ সক্রিয়। একটি দৈনিক পত্রিকায় দেখলাম, গত ২৫ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ মিলনায়তনে চিকিৎসকদের এক সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকা এখন ডেঙ্গুর শহর। আগের চেয়ে মশার ঘনত্ব ১০ গুণ বেড়েছে। মশা বেড়েছে বলে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি, তিনি ঢাকা শহরে এডিস মশার বৃদ্ধিকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তার মশকরা করা শোভন মনে না হলেও, কষ্টটা অন্যত্র। একই দিনে ‘মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন দক্ষিণের মেয়র। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবের ভিত্তিতে তৈরি করা আক্রান্ত মানুষের অনুমিত সংখ্যাকে (সাড়ে তিন লাখ) মেয়র বলেছেন গুজব। এই অনুমিত সংখ্যার প্রয়োজন হতো না যদি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হতো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ১০ গুণ মশা বেড়েছে বলে আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়েছে। দক্ষিণের মেয়র তাহলে কাকে গুজব রটনাকারী বলছেন, প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা কি ধরে নেব তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাকেই গুজব বলছেন? মেয়র কিন্তু নিজে আক্রান্তদের সংখ্যা বলতে পারেননি। বললে হয়তো ‘গুজব’-এর অস্তিত্ব থাকত না। এখন তো গুজবের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনি, পদ্মা সেতুর জন্য শিশুদের মাথা কাটা ইত্যাদি গুজবে কত রকম লোমহর্ষক, নৃশংস ঘটনা ঘটছে। নিরীহ প্রাণ গেছে, যাচ্ছে। গুজবকারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ঘোষণাও উচ্চারিত হয়েছে। পুলিশ হুঁশিয়ার করছে। সরকার তার বিভিন্ন বিভাগ থেকে এ বিষয়ে সতর্কতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। ‘গুজব’ শব্দটা এখন ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছে পরিচিত শব্দ। সমাজে এক একটা সময়ে এক একটা শব্দের বেশ প্রচলন, ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা বাড়তে দেখা যায়। ব্যক্তি মনমানসিকতায় অনুন্নত, তার যৌক্তিকবোধ ক্ষীণ হওয়ায় এসব শব্দ সমাজে বিস্তারে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করে। সরকারের উচ্চপদস্থরা মাঝেসাঝে এবং প্রায়ই সেসব শব্দ ব্যবহারে পিছিয়ে থাকেন না। মশার বিষয় নিয়ে মেয়র যে উক্তিকে গুজব বললেন, যদি সেই বিষয় নিয়ে মশা হত্যা করা হতো তাহলে কত প্রাণ বেঁচে যেত। খুব ইচ্ছে হচ্ছে বলতে, মেয়র, এই গুজবকে আমলে নিয়ে, কানে নিয়ে ক্ষোভে, ক্রোধে মশা মারুন! আমার বিশ্বাস অন্তত মশকের প্রাণ নিধনে কেউ আপনার শাস্তি দাবি করবেন না। উপরন্তু পুরস্কৃত হবেন আপনি অনেক মানবপ্রাণ রক্ষার সুবাদে। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা, ঠেলাঠেলির খেলা নতুন নয়। এডিস মশার বিস্তার নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যতেই এই খেলা শেষ নয়। মশা মারার ওষুধ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, মশা মারার যে ওষুধ আছে, তা অনেকটা অকার্যকর। অপরদিকে মেয়রের সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন, মশার ওষুধ পরীক্ষার পর দেখা গেছে, ওষুধে কোনো সমস্যা নেই। কী সাংঘাতিক মতবিরোধ! সত্যি কথা কে বলছেন তাহলে? একটি রাষ্ট্রের সরকারের ভেতরটায় যদি এমন সমন্বয়হীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে প্রায় প্রতিনিয়ত, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়। সমস্যা দূর করার উপায় কী থাকে আর! পরীক্ষাগারে মশার ওষুধ ইতোপূর্বে পরীক্ষা করে ফলাফল পাওয়া গেছে, এটা অকার্যকর এবং যে হারে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে তো সহজেই অনুমেয় মন্ত্রী-মেয়র কে সত্য বলছেন, আর কে সত্য এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্লিজ! মানুষের জীবন নিয়ে খেলবেন না আপনারা! দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করুন! পরিশেষে সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলি, মশা নিরস্ত্র প্রাণী। ওটাকে প্রাণে মারতে সততার আশ্রয় নিন। আন্তরিকতা আর সুষ্ঠু দায়িত্ব পালন হোক মশা নিধনের মূল অস্ত্র।

স্বপ্না রেজা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App