×

মুক্তচিন্তা

পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ কি তবে অসম্ভব?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০১৯, ০৯:১১ পিএম

নাগরিক হিসেবে অপর নাগরিকের প্রতি আমরা কি কখনোই শ্রদ্ধাশীল হবো না? এটির জন্যও কি আমাদের সরকারের মুখের পানে তাকিয়ে থাকতে হবে? এ জন্যও কি প্রয়োজন হবে জননেত্রীর নির্দেশনা? ভবিষ্যতে আমরা যতই মেট্রোরেলে যাতায়াত করি না কেন, যতই আমরা পাতাল রেলের স্বপ্নে বিভোর হই না কেন আমাদের স্বভাব ও আচরণগত চেতনার গুণগত পরিবর্তন সবার আগে প্রয়োজন। রাজ্যের দুর্গন্ধ নাকে নিয়ে মেট্রো কিংবা পাতাল রেলে বসে কী শান্তি, কী স্বস্তি পাব কে জানে!

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সমমানের অর্থনৈতিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশকে রীতিমতো ঈর্ষার চোখে দেখে। আর উন্নত রাষ্ট্রগুলো অপরাপর দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে বাংলাদেশ থেকে ‘শিক্ষা’ গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করে ‘দাওয়াই’ দেয়। ইত্যকার নানা কথা আমরা শুনি। এসব উৎসাহব্যঞ্জক ও উদ্দীপনামূলক কথা আমাদের ভালো লাগে। আমরা যারপরনাই খুশি হই। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলেই, বাংলাদেশ উন্নয়নের রোলমডেল বলেই আমরা কি সেই আনন্দে আত্মহারা? এই আনন্দেই কি অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের উদাসীনতার পারদ চরমে পৌঁছে গেছে? এই খুশিতেই কি আমরা স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের কথা ভুলে গেছি- ভুলে যাই? ভুলে যাই সুস্থ পরিবেশে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের কথাও? আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুস্থ পরিবেশকে তাই যেভাবে পারি নষ্ট করি, অপরিচ্ছন্ন করি, অস্বাস্থ্যকর করি, দুর্গন্ধময় করি? সাধারণের বেঁচে থাকাকেও অসুস্থতায় আর কদর্যতায় ভরে তুলি? সাম্প্রতিককালে নানাভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, বাজার থেকে কিনে আমরা যেসব খাবার খাই তার সিংহভাগই ভেজাল। আবার যা প্রাকৃতিক, ঈশ্বরের অপার দান তাকেও আমরা আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভেজাল বা দূষিত করে চলেছি প্রতিনিয়ত। তাই হতাশার ছল করে অনেকেই বলে থাকেন ‘আমরা যা খাই তাও ভেজাল; আর যা না খাই তাও ভেজাল।’ অর্থাৎ সরাসরি না খেয়েও আমাদের চারপাশ থেকে গ্রহণ করা আলো আর হাওয়াকেও আমরা আমাদের দুর্ব্যবহারে উৎকট, অসহনীয়, দূষিত, দুর্গন্ধময় করে চলেছি। প্রকৃতির আলো-বাতাস আমরা খাই না ঠিকই কিন্তু আমাদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে দেহের ভেতর পরোক্ষভাবে তা প্রবেশ করে। আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। কিন্তু দূষিত ও চরম দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস আমাদের নাসারন্ধ্রের মাধ্যমে দেহাভ্যন্তরে প্রবেশের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে এবং তা নীরব ঘাতক হয়ে শরীরকে নানা প্রকার অসুস্থতায় আক্রান্ত করে। সামান্য সচেতন হলেই এ থেকে পরিত্রাণ সম্ভব। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য কোনো উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। আমাদের নাগরিক জীবনে সুবাতাসের বড় অভাব। কিন্তু এই অভাবের মধ্যে আবার পরিচ্ছন্নতার নামে ময়লা-আবর্জনার যে গাড়িগুলো শহরের ময়লাসমূহ নির্দিষ্ট ভাগাড় কিংবা পরিশোধনাগারে যখন বহন করে নিয়ে যায় তখন সমগ্র নগরবাসীর নাকের ডগায় দুর্গন্ধ লাগিয়ে, তাদের জানান দিয়েই নিয়ে যায়! কী অদ্ভুত মানসিকতা! আমরা দেখি ট্রাকের পর ট্রাকভর্তি ময়লা-আবর্জনা বহনের গাড়িগুলো খোলামেলাভাবে ময়লা পরিবহন করছে। যেখান থেকে আবর্জনা ট্রাক-ভ্যানে তোলা হয় সেখান থেকে ভাগাড় পর্যন্ত দেখা যাবে ট্রাক থেকে চুইয়ে চুইয়ে দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি অনবরত ঝরে ঝরে পড়ে সারাটা রাস্তা দুর্গন্ধ হচ্ছে। আবার কখনো কখনো আবর্জনার এই ট্রাক-ভ্যানগুলো উন্মুক্ত থাকার কারণে পলিথিন বা কাগজ জাতীয় আবর্জনা উড়ে উড়ে পড়তে পড়তে জনবহুল রাস্তাকে আরো নোংরা করে তুলছে। ট্রাফিক সিগন্যাল বা যানজটের মধ্যে গণপরিবহনের গাড়িগুলোর কাতারে এরূপ ময়লা ও আবর্জনাবাহী গাড়ি যখন থেমে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তখনকার পরিবেশের কথা তথা ভাবাও যায় না। ভুক্তভোগী ছাড়া সে অভিজ্ঞার তিক্ততা অনুভব করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা প্রায়শই এসব দেখি এবং এরূপ তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। কিন্তু অসহায়ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তিক্ত বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার এ কথা কাকে বলব? কেইবা বলবে? বললেই বা কি হবে? এতগুলো প্রশ্নের উত্তরে যখন দেখি শুধু শূন্যের পর শূন্য তখন নাকে রুমাল চেপেচুপ করে গণপরিবহনে মাথা নিচু বসে থাকার কোনো বিকল্প থাকে না। আবার সাধারণ মানুষের সমস্যা হলো যত কঠিনভাবেই নাকচাপা দিয়ে বসে থাকুক না কেন দুর্গন্ধের তীব্রতা নাকের ভেতর দিয়ে পেটে প্রবেশ করে সেখান থেকে নাড়িভুঁড়ি সব বের করে নিয়ে আসে যেন! ট্রাফিক সিগন্যালের দীর্ঘস্থায়িত্ব কিংবা যানজটের তীব্রতা আমাদের শরীরের শক্তিকে অনবরত ক্ষয় করে। ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া যে কী কষ্ট তা কল্পনা করাও কঠিন। তবু আমজনতা, নীরবে এসব অনিয়ম হজম করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে মাঝেমধ্যে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের বাতাসে দূষিত পদার্থ পরিমাপ করে সতর্কবার্তা দেয়া হয়। কিন্তু ময়লা-আবর্জনার এসব ট্রাক-ভ্যান থেকে ভেসে আসা অসহনীয় দুর্গন্ধ মানবস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর এ লেখার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের কাছে তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করে রাখলাম। নাগরিক জীবন থেকে যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা দূর করতে হবে। এসব ময়লা-আবর্জনা দূর করে নাগরিক জীবনে স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতা আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ময়লা-আবর্জনা স্থানান্তরের যে প্রচলিত ব্যবস্থাপনা সেই ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করতে সমস্যা কোথায়? এভাবে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে পীড়নের কোনো অধিকার কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আছে? এই পীড়ন একদিকে যেমন মানসিক তেমনি স্বাস্থ্যগতও বটে। কারণ পচা ময়লা-আবর্জনার অসহনীয় দুর্গন্ধ স্বাস্থ্যঝুঁকিই বাড়ায়, কেবলই পরিবেশের বিপর্যয় সৃষ্টি করে। ময়লার গাড়িতে ওষুধ ছিটিয়ে নিলেই রাস্তায় চলাচল করা নগরবাসী সময় সময় বয়ে যাওয়া ময়লা-আবর্জনার গাড়ি থেকে ভেসে আসা উৎকট গন্ধ থেকে রেহাই পায়। আবার ময়লার গাড়িগুলো ভালো করে রাখ-ঢাক করে নিলে সেসব গাড়ির ময়লা সহজেই আবার রাস্তার ওপর পড়ে নতুন ময়লা বাড়াবে না। সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা না ভেবে নানা রকমের কাজ আমরা করি। সাধারণ মানুষের সামান্যতম অধিকারকে যদি আমরা গুরুত্ব না দেই সেটাও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আবার ময়লা পরিষ্কারের নামে যখন তখন মানুষকে এভাবে কষ্ট দিয়ে, অসম্মান করার মধ্য দিয়ে দেশ কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। উন্নত রাষ্ট্র চাইলে উন্নত মানসিকতা নিয়ে সাধারণের অতি সাধারণ সুবিধাগুলোকেও গুরুত্বের মধ্যে আনতে হবে। এগুলোই জনগুরুত্বপূর্ণ। এত গেল রাজধানীকন্দ্রিক সমস্যার কথা। এখন রাজধানীর বাইরের বড় বড় সড়কপথ ধরে দূর-দূরান্তে যেদিকেই যেতে চাই দেখব মহাসড়কের পাশেই গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল ময়লার স্তূপ, ভাগাড়। পেশাগত কারণে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় আমার বসবাস। এখান থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। অথচ এই ৩০ কিলোমিটারের মধ্যেই ছোট-বড় কমপক্ষে ১০-১২টি ময়লা ফেলার স্তূপ রয়েছে। সে হিসাবে প্রতি আড়াই থেকে ৩ কিলোমিটার পরপর একটি করে ময়লা ফেলার স্তূপ। যানবাহনে যাতায়াতের সময় এসব স্তূপ থেকে যে দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগে তখন মনে হয় পেটের ভেতরকার পাকস্থলি পর্যন্ত ছিঁড়ে বাইরে চলে আসে! এই গন্ধ স্বাস্থ্যের জন্য যে কী মারাত্মক ক্ষতি তা বলে শেষ করা যাবে না। সড়ক-মহাসড়কের পাশে এত ঘনঘন এরকম অপরিকল্পিত ও দুর্গন্ধময় ময়লার স্তূপ পৃথিবীর আর কোথায় আছে জানি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় এটি সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাজ। কারণ এসব ময়লা ফেলার উদ্দেশ্য হয়তো মাটির পরিবর্তে ময়লা-আবর্জনা দিয়ে মহাসড়কের দুপাশের নিচু জায়গা উঁচু করার প্রকল্প! তাই আমরা দেখি ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার মতো চার লেনের চমৎকার নতুন মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানের দুপাশে ময়লার স্তূপে সয়লাব হয়ে গেছে। এই সুন্দর সড়কপথে ভ্রমণের আনন্দ ছিল ভিন্ন মাত্রার। কিন্তু বর্তমানে মহাসড়কটির দুপাশের বিভিন্ন স্থানে ময়লার স্তূপ থেকে ভেসে আসা তীব্র ও ঝাঁঝালো, উৎকট ও অসহনীয় গন্ধে একদিকে ভ্রমণের আনন্দ যেমন বিনষ্ট হয় অন্যদিকে তেমনি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। আমরা জানি না, আমাদের পূর্বোক্ত ধারণাটি সঠিক কিনা। অর্থাৎ এটি সড়ক যোগাযোগ বিভাগের কর্ম কি না। তবে বিশ্বাস করতে চাই এটি সড়ক বিভাগের কর্ম নয়। পাশাপাশি এও বিশ্বাস করতে চাই যে, যদি তা না হয় তবে যারা সড়ক-মহাসড়কের পাশে এভাবে ময়লা-আবর্জনা ফেলে জনস্বাস্থ্যের এরূপ ক্ষতি করছে সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনবে। শুধু ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কই নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ সড়কের দুপাশের এই চিত্র আমাদের বিস্মিত করে। আমাদের ভাবায় এই মানসিকতা ও স্বভাববৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা কীভাবে উন্নত রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হবো? আমাদের সব কিছুই কি সরকার বলে দিবে তারপর ঠিক হবো? আমরা নিজে থেকে কি কখনোই বদলাব না? নাগরিক হিসেবে অপর নাগরিকের প্রতি আমরা কি কখনোই শ্রদ্ধাশীল হবো না? এটির জন্যও কি আমাদের সরকারের মুখের পানে তাকিয়ে থাকতে হবে? এ জন্যও কি প্রয়োজন হবে জননেত্রীর নির্দেশনা? ভবিষ্যতে আমরা যতই মেট্রোরেলে যাতায়াত করি না কেন, যতই আমরা পাতাল রেলের স্বপ্নে বিভোর হই না কেন আমাদের স্বভাব ও আচরণগত চেতনার গুণগত পরিবর্তন সবার আগে প্রয়োজন। রাজ্যের দুর্গন্ধ নাকে নিয়ে মেট্রো কিংবা পাতাল রেলে বসে কী শান্তি, কী স্বস্তি পাব কে জানে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা রূপকল্প-২০৪০ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছেন। আমরা সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখার জন্য যখন অধীর অপেক্ষায় মগ্ন থাকি তখন কিছু কিছু সংস্থার কিছু কিছু মানুষের অবহেলা, অযত্ন ও উদাসীন কর্মকাণ্ড আমাদের নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করায়। ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক স্বভাব ও প্রবৃত্তির মূলেই যদি স্ব-স্ব কর্মের প্রতি অবহেলা ও তাচ্ছিল্যভাব থাকে এবং মানুষের প্রতি থাকে অশ্রদ্ধা তবে কী করে উন্নত হবো আমরা? পচা শরীর, দুর্গন্ধময় দেহ এবং অপরিচ্ছন্ন মনোভাবই যদি আমরা লালন করি তবে আমাদের উন্নত না হওয়াই মানবজাতির জন্য কল্যাণ! কারণ এরূপ স্বভাব নিয়ে উন্নত হলেও সেই ‘উন্নতি’ দীর্ঘস্থায়ী হবে না, হতে পারে না। তাই অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়ার আগে বরং স্বভাব ও নৈতিকতার দিক থেকে আগে পরিচ্ছন্ন হওয়া জরুরি। ময়লা ফেলার সময়ও পরিচ্ছন্ন হওয়া জরুরি। তবে কি পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, অসম্ভব কল্পনামাত্র?

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App