×

মুক্তচিন্তা

গুজব আর সত্যের মাঝামাঝি আমরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০১৯, ০৮:৪৩ পিএম

কোনটিকে আমরা বিশ্বাস করব আর কোনটিকে করব না সেই বিষয়ে আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধের যুক্তিই যথেষ্ট নয় কি? আমাদের যুক্তির পেছনে দর্শন থাকবে, ভিত্তি থাকবে, তথ্য থাকবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের বিবেক-বুদ্ধির এই ম্যাড়ম্যাড়ে অস্তিত্বের বিপরীতে যৌক্তিক-সামাজিক সত্তার জোরালো অবস্থানই আমাদের নিয়ে যাবে নিশ্চিতভাবে গুজবের বিপক্ষে।

সাম্প্রতিক সময়ে রোগ হিসেবে যেমন ডেঙ্গু আতঙ্ক তেমনি সামাজিকভাবে ‘ছেলেধরা’ আতঙ্কে আছে অনেকেই। এই দুটির মধ্যে কোনটি গুজব আর কোনটি সত্যি সেটিতে আমরা ইতোমধ্যেই গোলমাল পাকিয়ে ফেলছি। আমরা গুজবকে সত্যি ভাবছি আর সত্যকে ভাবছি গুজব। পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে তাই ‘ছেলেধরা’ ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই মাথার খোঁজে- আমরা এই মাত্রার গুজবেও আস্থা রাখছি। অখচ ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এবং মহামারি রূপকে আমরা গুজব বলে অবহেলা করছি এবং উড়িয়ে দিচ্ছি। আমরা এক অতি মাত্রার ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছি। এটি সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্তে পৌঁছার সময়। এখন মানবিক মূল্যবোধ কেবলই ক্ষমতানির্ভর। মানুষের সঙ্গে মানুষের সমর্থন কেবল এই ক্ষমতার ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ছে। যার কারণে আমরা সত্য এবং গুজবের পার্থক্য করতে পারছি না। আমাদের মধ্যে গুজব এবং সত্যের মধ্যকার পার্থক্য না থাকায় আমরা ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছি, আর সেখান থেকে উঠতে পারছি না। আমাদের যা করার কথা আমরা করছি তার বিপরীত। এই অবস্থা একদিনে হয়নি। আমাদের বহু কসরতের ফল এই বিশেষ অবস্থাটি। আমরা জেনে গেছি আমাদের বিবেক, বুদ্ধি, মানবিকতা সব আমরা ঝেড়ে ফেলে মানুষ নামের মমিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের সামাজিক সত্তা আর নেই, আছে শুধু শরীর আর হাড়-কঙ্কালের অবয়ব। আমাদের গুজব উড়িয়ে মানুষের কথা বলার কথা অথচ আমরা গুজবে ভর দিয়ে মানুষ মারছি। আমরা একটি গুজবের ওপর বিশ্বাস করে ইতোমধ্যে কয়েকজনকে হত্যা করেছি। ‘ছেলেধরা বাঁশি বাজিয়ে হত্যা করেছি এক মাকে।’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তাসলিমা বেগম রেনু তার মেয়েকে ভর্তি করার জন্য উত্তর বাড্ডার একটি স্কুলে যান। তার আচরণ অস্বাভাবিক, সামনে বসে থাকা কিছু অভিভাবকের মনে হয়েছে তাসলিমা ছেলেধরা। তারা হৈচৈ শুরু করেন। এর পর স্কুলের কিছু অভিভাবক ও বাইরে থেকে আসা উৎসুক জনতা কক্ষের দরজা ভেঙে রেনুকে ‘ছেলেধরা’ বলে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে এবং মারধর করতে থাকে। পুরো এলাকায় গুজব রটানো হয়, স্কুলে এক ছেলেধরাকে আটক করা হয়েছে। এই গুজবে মুহূর্তেই ডালপালা গজায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে কেউ শোনেন- তাসলিমার ব্যাগে ছুরি, স্প্রে আছে। কেউ শোনেন- ব্যাগে একটি আস্ত কাটা মাথাই পাওয়া গেছে, আবার কেউ শোনেন- স্কুলের এক বাচ্চার মাথাই নাকি ইতোমধ্যে কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু ঘটনাটি আসলে কী? আদৌ এটি সম্ভব কিনা? তাকে মারার আগে কেউ তার ব্যাগ যাচাই করে দেখেছেন কি? আদৌ সেখানে কোনো কাটা মাথা ছিল কিনা? কাটা মাথা নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব কিনা? সেগুলো যাচাই করার বুদ্ধি এবং সামাজিক দায়িত্ব আমাদের অনেক আগেই লোপ পেয়ে গেছে। তাই আর যদি অভিভাবকরা সত্যিই বিশ্বাস করে থাকেন যে তিনি কাটা মাথা নিয়ে ঘুরছিলেন, তাহলে সেক্ষেত্রে সচেতন অভিভাবকরা কেন পুলিশকে খবর দিলেন না? এখন তো পুলিশকে খবর দেয়া খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। কিন্তু আমাদের সচেতনতার ধরনটি এখন ভিন্নভাবে চর্চিত হচ্ছে। আর তাই তো গুজবপ্রিয় এবং গুজব বিশ্বাসী মানুষ আর বিলম্ব করেননি। শুরু করেন গণপিটুনি। এক পর্যায়ে গণপিটুনিতে তিনি মারা যান। সবাই আমরা এক একজন বিচারক হয়ে বসে আছি। সেই বিচারখানায় গুজব নামের একটি অদেখা কিন্তু অতীব শক্তিশালী বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসিয়ে বিচার কার্য সম্পাদন করছি। তাসলিমাকে নিয়ে অতি দ্রুত তৈরি হওয়া গুজবের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো একটি গুজবের সম্পর্ক আছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ দেশে বিভিন্ন সময়ে দাপুটে গুজব রটানো হয়েছে। সেই গুজবে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে পর্যন্ত পৌঁছে নিয়ে গিয়েছিল। ফেসবুকে রটানো গুজবকে কেন্দ্র করে এ দেশে গত দশ বছরে কয়েক দফা সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। তবুও মানুষ গুজব বিশ্বাস করে চলছে, গুজবে মন সঁপে চলছে। এই গুজবগুলো কীভাবে সামাজিক ভিত্তি পায়? কীভাবে মানুষ এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে? এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতি আসলে কী? শুধু সমাজের গুটিকয়েক মানুষের একজন মানুষকে দেখে কী মনে হলো তার ওপর ভিত্তি করে একজন মানুষকে মেরে ফেলা- এ প্রবণতা এই সমাজে কীভাবে আসলে প্রতিনিয়তই উৎপাদন হচ্ছে? কীভাবে গুজব এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠে? সেটি কীভাবে সমাজ এবং রাষ্ট্র কর্তৃক বৈধতা পায়? কীভাবে গুজবগুলো অতি মাত্রায় ক্ষমতাবান হয় সেই বিষয়ে আমরা মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজনও বোধ করি না। অন্যদিকে আমাদের ডেঙ্গুকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়ার কথা, কিন্তু আমরা একে গুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছি। বর্তমানে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশ। দেশের প্রায় ৫০টি জেলাতেই এই রোগ ইতোমধ্যেই বিস্তার করেছে। আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার বরাতে গণমাধ্যম এই তথ্য প্রকাশ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৫৬৫ জন মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১০ জন। কিন্তু ডেঙ্গু তো হঠাৎ করে নতুন আসা কোনো রোগ নয়। প্রায় বিশ বছর ধরেই চলে আসছে। সঠিক সময়ে মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের কাজের ব্যর্থতার কারণেই ডেঙ্গু এতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বরং একজন মেয়র এটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেননি। যার কারণে জনগণও ডেঙ্গু মোকাবেলায় তেমনভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেনি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এক্ষেত্রে তো তাদের আগে থেকেই একটা পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু দুই মেয়রই ব্যর্থ ছিলেন। বিশেষ করে যখন ঢাকার অনেক রাস্তাতেই এখন মেট্রো রেলের কাজ চলছে এবং বর্ষাকালে সেখানে পানি জমে মশার বসতি হবে, সেখান থেকে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত জ্বর হবে, এই চিন্তা তো সবার মাথাতেই আসার কথা। কিন্তু মেয়রদের মাথায় আসেনি। কারণ তাদের মাথা ব্যস্ত ‘গুজব’ অস্ত্র ব্যবহারে। গুজব আর বাস্তব চিত্রের পার্থক্য তাদেরই তো সবার আগে বুঝতে হবে। কিন্তু তারাও এই পার্থক্য করতে পারেননি। এই মুহূর্তে আমাদের দোনোমোনা সত্য এবং গুজবের পার্থক্য নিয়ে। কীভাবে আসলে আমরা এই পার্থক্য নিরূপণ করব? নানা ধরনের গুজবের ভিড়ে সত্য তার পথ হারিয়ে ফেলে, মানুষকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। মানুষ গুজব-সত্যের পার্থক্য করার বোধ হারিয়ে ফেলে। এটি করার কোনো সামাজিক নিক্তি নেই। তবে আছে বিবেক, বুদ্ধি এবং সাধারণ জ্ঞান। সেগুলোকেই বাটখারা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে প্রথম দফায়। যে কোনো মানুষের ডেঙ্গু হওয়া সম্ভব, কিন্তু একজন ছেলধরা, সে ইতোমধ্যে একজনের মাথা কেটে ফেলেছে- এগুলো কি আসলেই বিশ্বাসযোগ্য? কোনটিকে আমরা বিশ্বাস করব আর কোনটিকে করব না সেই বিষয়ে আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধের যুক্তিই যথেষ্ট নয় কি? আমাদের যুক্তির পেছনে দর্শন থাকবে, ভিত্তি থাকবে, তথ্য থাকবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের বিবেক-বুদ্ধির এই ম্যাড়ম্যাড়ে অস্তিত্বের বিপরীতে যৌক্তিক-সামাজিক সত্তার জোরালো অবস্থানই আমাদের নিয়ে যাবে নিশ্চিতভাবে গুজবের বিপক্ষে।

জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App