×

জাতীয়

সাক্ষ্য দিলেন বাবা, মামা ও জেঠাতো ভাই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০১৯, ১০:০৫ পিএম

মামলা তুলে নিতে আমার ছেলেকে হুমকি দেয় হাফেজ আবদুল কাদের ও আফসার উদ্দিন

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় দায়ের করা মামলায় তার বাবা এ কে এম মুসা, জেঠাতো ভাই মুহাম্মদ আলী ও মামা সৈয়দ সেলিমের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সোমবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে উপস্থিত হয়ে তারা সাক্ষ্য প্রদান করেন।

জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি পিপি হাফেজ আহাম্মদ ও বাদীর আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, নুসরাত হত্যা মামলায় ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাদীসহ ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। আজ মঙ্গলবার ডা. সোহেল মাহমুদ, ডা. প্রদীপ বিশ্বাস, ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস, ডা. আবু তাহের, ডা. আরমান বিন আবদুল্লাহ, ডা. মোহাম্মদ ওবায়দুল ইসলাম, ডা. এ কে এম মনিরুজ্জামান, অর্চনা পাল ও জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার কথা রয়েছে। আদালত সূত্র জানায়, সাক্ষ্য প্রদানকালে নুসরাতের বাবা এ কে এম মুসা জানান, গত ২৭ মার্চ আমি কর্মস্থলে ছিলাম। আমার স্ত্রী মোবাইল ফোনে জানায়, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা দপ্তরি নুরুল আমিনকে দিয়ে আমার মেয়ে নুসরাতকে তার রুমে ঢেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। খবর পেয়ে পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে থানায় নিয়ে আসে। ওই দিন আমার স্ত্রী মামলা দিলে পুলিশ তাকে আটক করে। পরে শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের ও আফসার উদ্দিন মামলা তুলে নিতে আমার ছেলেদের হুমকি দেয়। ৬ এপ্রিল নুসরাতকে নিয়ে আমার বড় ছেলে নোমান পরীক্ষার হলে গেলে তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় নাই। কিন্তু এর আগে দুটি পরীক্ষায় অসুস্থতার কারণে সে নুসরাতকে হলে বসিয়ে আসত। ওই দিন আমার স্ত্রী ফোন করে জানায়, কে বা কাহারা নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছে। আমার স্ত্রীসহ দুই ছেলে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিক আমার কর্মস্থল থেকে বাড়ি এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই।

তিনি আরো বলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার মেয়ে প্রথম ২ দিন কথা বলতে পারত। কিভাবে তার গায়ে আগুন দেয়া হয়েছে সে আমাদের বলেছে। সে বলেছে, পরীক্ষা দিতে হলে প্রবেশ করলে অধ্যক্ষের ভাগনি তুহিন তাকে জানায় সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিশাতকে কারা যেন মারছে। এটা শুনে ছাদে গিয়ে বোরকা, হাতমোজা ও চশমা পরা চারজনকে দেখতে পায়। একজন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। সে মামলা তুলবে না বলায় একজন তার মুখ চেপে ধরে হাত-পা বেঁধে ফেলে। একজন তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের গলার স্বর চেনা লাগলেও পুরোপুরি চিনতে পারেনি বলে সে জানায়। তবে তারা একজনকে শম্পা বা চম্পা বলে ডাক দেয় বলে জানায় সে। পরে ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার মেয়ে মারা যায়। পরদিন হাসপাতালের মর্গে তার সুরতহাল রিপোর্ট হলে তাতে স্বাক্ষর দিয়ে তাকে নিয়ে আসি। ১১ এপ্রিল সোনাগাজীর সাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তার লাশ দাফন করি।’

নুসরাতের জেঠাতো ভাই মুহাম্মদ আলী সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘গত ৬ এপ্রিল ৯.৫০ মিনিটের দিকে আমার বড় ভাই ওমর ফারুক ফোন দিয়ে জানায়, নুসরাতের গায়ে কে বা কাহরা আগুন দিয়েছে। আমি দ্রুত হাসপাতালের গেটে গিয়ে জানতে পারি তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। আমি নোমান, রায়হান ও আমার চাচিসহ তাকে ঢাকায় নিয়ে যাই। ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। আমরা কুমিল্লা পৌঁছলে জানতে পারি নুসরাত মারা গেছে।

নুসরাতের দূর সম্পর্কের মামা সৈয়দ আলম বলেন, গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা আটকের পর অনুগত শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিনসহ আরো অনেকে তার মুক্তির জন্য মানববন্ধন করেন। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলম মাদ্রাসায় এসে অধ্যক্ষের মুক্তির জন্য ছাত্রছাত্রীদের যা করার দরকার তা করতে বলেন। পরে ৬ এপ্রিল অধ্যক্ষের নির্দেশে নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ, যোবায়ের, কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপিসহ তাদের সহযোগিরা পরিকল্পিতভাবে নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা চালায়।

চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। টানা পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App