×

মুক্তচিন্তা

ডেঙ্গু নিয়ে বাদানুবাদ নয়, সতর্ক ব্যবস্থা জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০১৯, ০৯:০৬ পিএম

সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এই বর্ষা শেষে আগামী বছর আমাদের প্রস্তুতিটা কীভাবে নিলে শুধু এডিস মশাই নয়, চিকুনগুনিয়া বা অন্য ভাইরাসগুলোর প্রাদুর্ভাব থেকেও আমরা মুক্ত হতে পারব সে ব্যাপারে এখনই কার্যকর প্রস্তুতি নেয়া দরকার। এর জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সুপারিশ নেয়া এবং নির্বাহী সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন।

এই মুহূর্তে ডেঙ্গুর প্রকোপ বলতে গেলে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিশেষত ঢাকা শহরে এবার ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এতটা ঘটবে তা কোনো মহলই আগে অনুমান করতে পারেনি। যতটা করেছিল তার চাইতে এই রোগের জটিলতা সম্পর্কে অনেকেরই ধারণার চাইতেও নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দেয়ায় স্বয়ং ডাক্তাররাও অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তারপরও ঢাকার চিকিৎসকরা কয়েকদিন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীদের সারিয়ে তোলার চিকিৎসা দিতে। তাদেরও ডেঙ্গুর চিকিৎসা সম্পর্কে আগের ধারণা অনেকটাই এখন বদলাতে হচ্ছে। কারণ ডেঙ্গুর এডিস মশা এতসব জটিল বংশবৃদ্ধি নিয়ে আবির্ভূত হবে সেটি কারো কারো জানা থাকলেও সব চিকিৎসকের তা ছিল না। তারপরও আমাদের চিকিৎসকরা দ্রুতই তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে তৎপর রয়েছেন। এই মুহূর্তে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো ডেঙ্গুসহ নানা ধরনের জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের আগমনে একেবারেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে ঢাকায় এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটাই বেশি যে, সাধারণ মানুষ অনেকটা এডিস মশার আতঙ্কেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছেন। সেটি হওয়ার কথাই। কারণ কোনো মানুষই ভাবতে পারেনি মশা থেকে এতসব জটিল রোগে মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। ঢাকার বাইরেও এখন বেশকিছু শহরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে। তবে তাদের বেশিরভাগই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়েছেন বলে স্থানীয় ডাক্তাররা জানিয়েছেন। আসলে কিছুদিন আগেও মানুষ মনে করত যে ময়লা, নর্দমাসহ পচা জায়গাতেই যেসব মশা ভনভন করে সেগুলোই মানুষকে কামড়ালে মানুষ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এখন ডাক্তাররা মিডিয়ার মাধ্যমে যে ধারণাটি দিচ্ছেন সেটি একেবারেই ভিন্ন কথা। মোটেও কোনো পচা, নর্দমার মশার উৎপত্তিস্থল ডেঙ্গুর জন্মদাতা এডিস নয়। এডিস অত্যন্ত অভিজাত শ্রেণির মশা। এরা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে, মানুষের বাসাবাড়িতে এদের বসবাস বেশি। দিনের বেলায় এরা মানুষকে কামড় দেয়। তাই সবাইকে দিনের বেলাতেও মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হয়, শরীরে কাপড়-চোপড় বেশি রাখতে হয়। বড় বড় নির্মাণাধীন দালানকোঠায় এরা স্বচ্ছ পানিতে ডিম ছাড়ে সেখান থেকেই এদের বংশবিস্তার দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। আবার এসব এডিস মশা মানুষের শরীরে কামড় দিয়ে যে রক্ত চুষে নেয় তা থেকেই তারা আরো বেশি ভয়ানকভাবে বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এসব তথ্য গত কয়েকদিন আমরা কয়েকজন স্বনামধন্য ডাক্তার এবং কীটতত্ত্ববিদের কাছ থেকেই শুনেছি। আগে আমরা এসব তথ্য খুব একটা শুনিনি। এখন এডিশ মশার ভয়াবহতা কী হতে পারে সেটি সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার কারণে আমরা জানতে পারছি। আমরা এ কথাও জানতে পারছি যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন গবেষণা থেকে যেসব তথ্য-উপাত্ত ও ধারণা লাভ করেছে তা থেকে সংস্থাটি দাবি করছে যে, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এডিস মশার প্রকোপ এখন এশিয়াসহ আরো কয়েকটি অঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটি আরো জটিল রোগ ধারণ করতে পারে বলে সংস্থাটি আভাস দিয়েছে। এ মুহূর্তে প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে ডেঙ্গু রোগের বিষয়টিকে হালকা বা সাধারণভাবে নেয়ার কোনো বাস্তবতাই এখন আর নেই। এটিকে নিয়ে আমাদের দেশেও ব্যাপক গবেষণা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসা বিদ্যায় যারা গবেষণা করছেন তাদের স্ব-স্ব অথবা যৌথভাবে ডেঙ্গু এবং এডিস মশা নিয়ে ব্যাপক গবেষণায় হাত দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করবে বলেই আমরা আশা করি। কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভবিষ্যদ্বাণী যদি বাস্তব হতে থাকে তাহলে ডেঙ্গুর নানা ধরনের প্রকরণ শিগগিরই দেখা দিতে পারে। সেটি ঘটলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বেই এতে কোনো সন্দেহ করার কিছু নেই। ডেঙ্গু জরাক্রান্ত রোগীরা সাময়িকভাবে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারেন, কিন্তু শরীরের ভেতরে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধি রোগীকে ভয়ানকভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। সুতরাং ডেঙ্গুর এসব বিশেষত্ব নিয়ে এখনই যদি আমরা ব্যাপক গবেষণায় মনোনিবেশ না করি, এডিস মশার নিধনে কার্যকর ও ওষুধ আবিষ্কার ও ব্যবহারের পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে না পারি তাহলে আমাদের মৃত্যুঝুঁকি কতটা বেড়ে যাচ্ছে সেটি সহজে অনুমেয়। আমাদের পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমরা যত কথাই বলি না কেন পরিবেশ নষ্ট ও ধ্বংস করার জন্য আমাদের শিল্পপতি থেকে নিচের সব আতিপাতি কম দায়ী নয়। তারা খুব বেশি রাষ্ট্রের প্রচার-প্রচারণায় সচেতন হবেন বলে মনে হয় না। সুতরাং পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে আমরা কতটা নিজেদের রক্ষা করার জন্য সচেতন হবো সেটি নিয়ে মস্তবড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। ঢাকা শহরে ডেঙ্গুজ্বরের শুরু থেকে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতে বেশকিছু টকশোর অনুষ্ঠান হতে দেখছি। যতদিন যাচ্ছে তত বেশিরভাগ টিভি চ্যানেলই ডেঙ্গু নিয়ে নির্ধারিত সংবাদে গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রচার করছে, আবার টকশোগুলোতেও এই নিয়ে মন্ত্রী, মেয়র, সরকারি আমলা, ডাক্তার, কীটতত্ত্ববিদ এবং সাংবাদিকরা নানাভাবে আলোচনা করছেন। বিশেষজ্ঞদের আলোচনাগুলো অনেক বেশি সহায়ক হয়। তাদের আলোচনা থেকেই আমরা এডিস মশার বিশেষত্ব সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য পাচ্ছি। দুয়েকজন কীটতত্ত্ববিদও এসব আলোচনাকে অর্থবহ করে তুলেছেন। প্রয়োজন এ ধরনের জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা ব্যাপকভাবে করা। তবে মাঝেমধ্যে দেখা যায় সংবাদগুলোতে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রদানের মাধ্যমে যেভাবে বক্তব্য দেয়া হয় তাতে অনেক সময় মানুষের মধ্যে আতঙ্কের বিষয়টি আরো যেন বেড়েই চলে। একইভাবে কর্তৃপক্ষের অজ্ঞানতা ও সীমাবদ্ধতাকে অবচেতনে হলেও প্রচারে আনার ফলে একশ্রেণির দর্শক-শ্রোতা ডেঙ্গু রোগের সর্বশেষ ব্যাপকতা উপলব্ধি না করতে পেরে কারো কারো অবহেলাকেই দায়ী করতে দেখা যায়। আবার অনেক টকশোতেও কিছু কিছু আলোচক নানা ধরনের প্রশ্ন তুলে মেয়রদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে যে আবহটি তৈরি করেন তাতে ডেঙ্গুজ্বরের সর্বশেষ প্রকরণ সম্পর্কীয় ধারণাটি গুলিয়ে ফেলা হয়। আমরা লেখার শুরুতেই যে বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করেছি তা হচ্ছে এডিস মশার সর্বশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে কারোরই তেমন বিশেষ সুনির্দিষ্ট ধারণা ৬/৭ মাস আগে স্পষ্ট ছিল না। মেয়ররা হয়তো এটি নিয়ে সাধারণ মশার ওষুধ ছিটানোর প্রকল্পের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন। এই সীমাবদ্ধতা তাদের থাকতেই পারে। কারণ মেয়ররা কীটতত্ত্ববিদও নন, ডাক্তার তো ননই। অথবা সিটি করপোরেশনে যেসব ডাক্তার রয়েছেন তারাও এসব বিষয়ে কতটা সর্বশেষ জ্ঞান রাখেন- সেটি একটি প্রশ্ন। এখন মেয়রদের নানাভাবেই সমালোচনা ও ব্যর্থ বলে দাবি করতে পারি। কিন্তু তাতে কি সমস্যা সমাধান হবে? তবে মিডিয়ায় যে কোনো মানুষের বক্তব্যদানের ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক থাকা ভালো। সেটি মন্ত্রী বা মেয়র কিংবা সাংবাদিক অথবা যে কোনো সাধারণ মন্তব্যদাতাও হতে পারেন। আমি একটি উদাহরণ দিতে পারি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন পত্রিকায় প্রকাশিত সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গুজ্বরের সংখ্যা নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তিনি বলেননি যে, ঢাকা শহরে ডেঙ্গুজ্বর নেই। তিনি শুধু বলেছেন এ ধরনের সংখ্যাতত্ত্ব প্রচার করলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যেতে পারে। তার এই বক্তব্য নিয়ে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। আমি একটি টিভি চ্যানেলে একজন সাধারণ মন্তব্যদাতার মন্তব্য শুনেছি। তিনি বলেছেন সাঈদ খোকন কি অস্বীকার করতে পারবেন যে, ঢাকা শহরে কোনো ডেঙ্গুজ্বর নেই। তাহলে দেখুন বাদানুবাদটা কোনদিকে চলে যাচ্ছে। আবার আরেকটি টিভি টকশোতে সাঈদ খোকন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো কোনো এলাকায় কম আবার কোনো কোনো এলাকায় বেশি এডিস মশার প্রজনন ঘুরছে সেই তথ্য টিভিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে একজন আলোচক তার আলোচনাটি খণ্ডিতভাবে বুঝেছিলেন। ফলে আরেক ধরনের হালকা বিতর্ক সূত্রপাত হলেও মেয়র সেই বিতর্ক এগিয়ে নেননি। এই বক্তব্য দিয়ে আমি মেয়রের পক্ষ অবলম্বন করছি না। আমার বক্তব্য হচ্ছে বিষয়টি একান্তই বিশেষজ্ঞদের এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব পালনের ওপর ছেড়ে দেয়ার বিষয়। আমাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে আমরা সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা শহরের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের যথাসম্ভব নতুন জটিলতায় ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে এবং এডিস নিধনে তাদের করণীয় এবং জনগণের বাড়িঘর, পরিষ্কার রাখার নিয়মাবলি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা প্রয়োজন। আমরা এখন কাউকে অভিযুক্ত করে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ থামাতে পারব না। এই মৌসুমে এডিস মশার নিধন, বংশবিস্তার রোধ ইত্যাদি কাজে মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন আরো কীভাবে উদ্যোগ নিলে মানুষ ভয়াবহ এই অসুখ থেকে মুক্তি পাবে, একই সঙ্গে এডিস মশা এবং ডেঙ্গুজ্বর যেন ঢাকার বাইরে খুববেশি বিস্তার লাভ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিটি শহর, সিটি করপোরেশন, পৌর করপোরেশন, সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখনই যেন সেখানে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মনে রাখতে হবে আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কুরবানির ঈদ উপলক্ষে অনেক মানুষই হয়তো ঢাকা থেকে মফস্বল শহরে যেতে পারেন। সেই শহরগুলোর জন্য ডেঙ্গুজ্বর ঝুঁকিপূর্ণ, গ্রামগুলো নয়। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এই বর্ষা শেষে আগামী বছর আমাদের প্রস্তুতিটা কীভাবে নিলে শুধু এডিস মশাই নয়, চিকুনগুনিয়া বা অন্য ভাইরাসগুলোর প্রাদুর্ভাব থেকেও আমরা মুক্ত হতে পারব সে ব্যাপারে এখনই কার্যকর প্রস্তুতি নেয়া দরকার। এর জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সুপারিশ নেয়া এবং নির্বাহী সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন। তাহলেই আমরা এমন একটি সমস্যা ও সংকট থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে পাব।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App