×

মুক্তচিন্তা

গুজবের বলি তাসলিমা : দায় কার?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০১৯, ০৯:০৪ পিএম

গুজবের বলি তাসলিমা : দায় কার?
গুজবের বলি তাসলিমা : দায় কার?

তাসলিমা বেগম রেনুকে উন্মত্ত মানুষেরা নির্মম, বর্বর, অমানবিক ও পাশবিকভাবে যেভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে তা দেখে হৃদয়কে নাড়া দেয়নি এমন লোক নেই। রেনুর ১১ বছরের ছেলে ও ৪ বছরের মেয়ে তাসমিনের কাছে এ সমাজের জবাবদিহিতার জায়গাটা কোথায়? শিশু তাসমিন যখন তার মায়ের কাছে যাওয়ার আকুতি করে তখন আমাদের ব্যর্থতার লজ্জা কোথায় ঢেকে রাখব? নিশ্চয়ই এ দায় সমাজের এবং মানুষরূপী কিছু জানোয়ারের।

প্রায় এক মাস যাবৎ বাংলাদেশ ভাসছে গুজব প্রবাহের ওপর। গুজবে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। নিহত হয়েছে ছয় জন। আহতের সংখ্যা পঁচিশ ছাড়িয়ে যাবে। পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে। গ্রেপ্তার করছে। জনসচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি নিচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করছে। সরকার প্রেস রিলিজ দিচ্ছে। মন্ত্রী-নেতারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী, সমাজ-বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা গণপিটুনির বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করছেন। কিন্তু গুজবের ডালপালা বেড়েই চলছে। দুর্ঘটনা ঘটা অব্যাহত আছে। গুজবটি কি ছিল? গুজবটি ছিল পদ্মা সেতুতে শিশুদের মাথা লাগবে। কার দ্বারা কীভাবে এ গুজবটি প্রথম সূত্রপাত হয় তা পুলিশ বা গুয়েন্দা সংস্থা এখনো শনাক্ত করতে পারেনি। এটা দেশের মধ্য থেকেও হতে পারে আবার বাইরে থেকেও হতে পারে। ষড়যন্ত্র ও নাশকতা সৃষ্টির এ ধরনের গুজব ও মিথ্যাচার দেশের বাইরে থেকেই বেশি হয়। অতীতে দেখেছি এ ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবির অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। ওদের বহু আইটি স্পেশালিস্ট আছে যারা আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে একটির পর একটি মিথ্যা অপপ্রচার ও কল্পকাহিনী সামাজিক মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। তাদের সহযোগী সরকারবিরোধী মহলের সদস্যরাও থাকে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও ছেলেধরা আতঙ্ক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঝেমধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। কোথাও কোথাও গণপিটুনির ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ঘটনায়ই ছেলেধরা প্রমাণিত হয়নি। একশ্রেণির মানুষ গুজবে কান দিয়ে কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসে বশীভূত হয়ে ছেলেধরা কাল্পনিক ও কথিত বিষয়টি সত্য বলে বিশ্বাস করে আইন হাতে তুলে নিয়ে নিরীহ ও নির্দোষ ব্যক্তিদের হত্যা করে কিংবা গুরুতর জখম করে। ছেলেধরা ছাড়াও ডাকাত, চোর পকেটমার, ছিনতাইকারী বা মাদক ব্যবসায়ী সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা করার ঘটনা অতীতে আমাদের দেশে অনেক ঘটেছে। অতীত এবং বর্তমান এক কথা নয়। অতীতে আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক ছিল অশিক্ষিত, নিরক্ষর, অজ্ঞ এবং ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের প্রভাবে তাদের মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনা তাড়িত হতো। সুকুমার প্রবৃত্তি ও মানবিক মূল্যবোধ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে লোপ পেত। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক যুগে যেখানে শিক্ষার হার বেড়েছে, তথ্যপ্রযুক্তির কারণে মানুষ আধুনিকমনস্ক হয়েছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজ দর্শনে আমূল পরিবর্তন এসেছে সে যুগে কুসংস্কার ও গুজবে তাড়িত হয়ে নিরীহ ও নির্দোষ লোককে ছেলেধরা বা অন্য কোনো সন্দেহে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করবে এটা কোনো বিচারেই মেনে নেয়া যায় না। সুস্থ মানসিকতার যে কোনো লোকেরই হৃদয় কেঁপে ওঠার কথা। ঢাকার উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ২০ জুলাই তাসলিমা বেগম রেনুকে উন্মত্ত মানুষেরা নির্মম, বর্বর, অমানবিক ও পাশবিকভাবে যেভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে তা দেখে হৃদয়কে নাড়া দেয়নি এমন লোক নেই। রেনুর ১১ বছরের ছেলে ও ৪ বছরের মেয়ে তাসমিনের কাছে এ সমাজের জবাবদিহিতার জায়গাটা কোথায়? শিশু তাসমিন যখন তার মায়ের কাছে যাওয়ার আকুতি করে তখন আমাদের ব্যর্থতার লজ্জা কোথায় ঢেকে রাখব? নিশ্চয়ই এ দায় সমাজের এবং মানুষরূপী কিছু জানোয়ারের। গুজব, কুসংস্কার ও মিথ্যা শ্রুতি বিশ্বাস করা কোনো সচেতন নাগরিকের উচিত নয়। একশ্রেণির লোক অজ্ঞতার কারণে হুজুগে-গুজবে কান দেয় এবং নির্মম পাশবিক ও অমানবিক আচরণের মাধ্যমে গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে যায়। পিটিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করা একটি নির্মম ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের শাস্তি ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড। প্রত্যেক বিবেকমান নাগরিককে গণপিটুনির ভয়াবহতা ও করুণ পরিণতি উপলব্ধি করে এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে এবং এ জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধ করার জন্য সামাজিক, মানবিক ও আইনগত দায়িত্ববোধ থেকে নির্ভয়ে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। গণপিটুনির ঘটনায় দেখা যায় গুজবে কান দিয়ে একজন সন্দেহভাজন নিরীহ ও নির্দোষ ব্যক্তিকে গুটি কয়েক ব্যক্তি অমানবিক ও নির্মমভাবে পিটাচ্ছে এবং অসংখ্য লোক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। কেউ কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন। কিন্তু এ বর্বর কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করার জন্য কেউ অপরাধীদের বাধা দিচ্ছেন না। ভিকটিমকে বাঁচানোর জন্য কেউ আসছেন না। ভিকটিমের করুণ আর্তনাদ কারো হৃদয়কে নাড়া দিচ্ছে না। মানুষ কীভাবে এত নির্দয়, এত পাষণ্ড, এত পাশবিক ও এত অমানবিক হতে পারে। কোনো নাগরিকের সম্মুখে কোনো অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলে তা প্রতিরোধ করা এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা ওই নাগরিকের আইনগত দায়িত্ব। কিন্তু আমরা আমাদের সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বও পালন করছি না। এমনকি আইনগত দায়িতও¡ পালন করছি না। এটা নিতান্তই আমাদের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচাতে হলে, একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে সব অপরাধ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে সামাজিক ও আইনগত দায়িত্ব পালন করতে হবে। সমাজে একশ্রেণির দুষ্টচক্র আছে তারা তাদের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য কিংবা নিজেদের কোটারি স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথে নিয়ে যায়। আমাদের দেশের চিহ্নিত একটি মহল এসব অপতৎপরতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। অতীতে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ঘটনায় এদের অপতৎপরতার প্রমাণও পুলিশ পেয়েছে। এ মহল সুপরিকল্পিতভাবে চাঁদে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে দেখা গেছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি ছাত্রদের আন্দোলনে ছাত্র হত্যা ও ছাত্রী ধর্ষণের গুজব ও মিথ্যা তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে এবং রামু ও নাসিরনগরে গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছিল, মন্দির-উপাসনালয় ধ্বংস করেছিল এবং জননিরাপত্তাহীনতা পরিবেশ সৃষ্টি করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। পুলিশ সচেতন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সে সংকট উত্তরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী ও কুচক্রী মহলের সকল ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা উন্মোচিত হওয়ায় তা প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছিল। পদ্মা সেতু আধুনিক প্রযুক্তিতে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা তৈরি করছেন। শুরু থেকেই একটি মহল নানাভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালাচ্ছেন। দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংককে অর্থায়ন থেকে বিরত রাখতেও তারা সক্ষম হন। কিন্তু দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারেননি। কানাডার আদালতে আমলা করে দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি। পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা। এটা দেশের মানুষের আবেগ ও অহংকারের জায়গা। নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মিত হচ্ছে বলে আমাদের অহংকারটা একটু বেশি। পদ্মা সেতুর প্রতি মানুষের আবেগ ও অন্তরের ছোঁয়ায় আঘাত হেনে মানুষের মনকে বিষায়িত করার কুচক্রী মহলেরই হয়তো এ মিথ্যা প্রচার ও গুজব ছড়ানো। তাই দেশবাসীকে এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। পদ্মা সেতুতে শিশুদের মাথা লাগবে বলে যে গুজব দেশব্যাপী ছড়ানো হচ্ছে তা একশ্রেণির মানুষ বিশ্বাস করছেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসব গুজব ও মিথ্যাশ্রুতি বিশ্বাস করে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটিয়ে নিরপরাধ ও নিরীহ লোককে হত্যা ও গুরুতর জখম করে নির্মমতা, পাশবিকতা ও অমানবিকতার পরিচয় দিবে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাকর বিষয়। আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ডিজিটাল যুগে এ ধরনের গুজব, কুসংস্কার ও পৌরণিক কল্পকাহিনী সচেতন জনগোষ্ঠী প্রত্যাখ্যান করবে। অবিশ্বাস করবে এটাই হওয়া উচিত। শান্তিপ্রিয় দেশবাসী সেটাই কামনা করে। কোনো নাগরিকের সম্মুখে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তা প্রতিহত করার এবং অপরাধ সম্বন্ধে তথ্য পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে জানানো নাগরিকের যে আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে সে দায়িত্ব এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাউকে অপরাধী হিসেবে সন্দেহ হলে আইন হাতে তুলে না নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অবশ্যই তা পুলিশকে জানাতে হবে। ৯৯৯-এ ফোন করে যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো পরিবেশে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে জানানো সুযোগ আছে। গুজব ও অপরাধজনক অপতৎপরতা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা মুখ্য। এ পরিস্থিতিতে পুলিশকে চৎড়ধপঃরাব ঢ়ড়ষরপরহম কার্যক্রমকে অধিক মাত্রায় জোরদার করতে হবে। বিভিন্ন পেশা ও মতের মানুষ, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সংবাদকর্মী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি তথা সর্বমহলকে সঙ্গে নিয়ে গণপ্রতিরোধ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করে গুজবের ডালপালা যাতে আর বিস্তৃত না হতে পারে সে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে গুজব ছড়ানোকারীদের শনাক্ত করে কঠোর আইনের আওতায় আনতেই হবে। এ লক্ষ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

এ কে এম শহীদুল হক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল বাংলাদেশ পুলিশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App