×

মুক্তচিন্তা

সমাজটা কি ধর্ষকের হাতে চলে গেছে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০১৯, ০৯:৪৭ পিএম

এমন বহু ঘটনা আমাদের দৃষ্টির বাইরে, জানার বাইরে, সাংবাদিকের অনুসন্ধানী সংবাদের বাইরে। সেসব বিবেচনা করতে গেলে মনে হয়, সমাজের অভ্যন্তরীণ সুস্থ শক্তির আর কিছু অবশিষ্ট নেই, প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষকগণ নখদন্তহীন। কাজেই পূর্বকথার পুনরুক্তি : সমাজটা ধর্ষকের হাতে চলে গেছে। নারীর পক্ষে সমাজে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গীয় শিশু-কিশোরী-তরুণীসহ নারীর। তাই বলে অন্যরা যে একেবারে অক্ষত, তাও নয়।

বাংলাদেশের সমাজ যে দূষণ, অবক্ষয় ও বর্বরতার প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে, আশ্চর্য, তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিষয়টি যেন কোনো ইস্যুই নয়। অথচ প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকায় খবর বেরোচ্ছে শিশুধর্ষণ, নারীধর্ষণ ও প্রায়শ তাদের হত্যাকাণ্ডের। রক্ত চুইয়ে পড়ছে নিয়মিত। সে তুলনায় বিপুল প্রতিক্রিয়া নেই, যা কিছু প্রতিক্রিয়া তা মোটেই কার্যকর নয়, যথেষ্ট নয়। কাজেই ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে গণমাধ্যম, বিশেষ করে দৈনিক সংবাদপত্রগুলো। যেমন খবর ছেপে, প্রতিবেদন লিখে তেমনি সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় নিবন্ধাদি লিখে। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য বড়-সড় পরিত্রাতার ভূমিকায় উচ্চ আদালত তথা হাইকোর্ট। প্রশাসন যখন বাঞ্ছিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ, তখন উচ্চ আদালতই মানুষের জন্য একমাত্র ভরসাস্থল। আদালত প্রায়শ নিজগুণে ভরসার জায়গাটি তৈরি করেছে। তবু জবরদখলের বিরাম নেই। আর তাই আমরা দেখতে পাই বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ভরাট হচ্ছে, প্রশাসন নীরব; অবৈধ স্থাপনা যেখানে সেখানে তৈরি হচ্ছে, আদালতের রায়ে সেসব কখনো কখনো উচ্ছেদ হচ্ছে, আবার যথারীতি তা গজিয়ে উঠছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। এমন একটা নৈরাজ্যিক অবস্থা চারদিকে, খাল বিল ভরাট বা গাছপালা কাটার অবৈধ আয়োজনে। তার চেয়ে বড় সর্বনাশা দিক সমাজের নৈতিক দূষণ ও পচন, বিশেষ করে শিশুকন্যা ও বিভিন্ন স্তরে নারী নির্যাতনে ও হত্যাকাণ্ডের বর্বরতায়। এটা প্রায় নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাজে মূল্যবোধের বিকৃতি এবং তা নিয়ে বিশেষ কারো মাথাব্যথা নেই। লক্ষ করার বিষয় যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যায়-আধিপত্যের দিকগুলো নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে শিক্ষিত মননশীল শ্রেণিকে বিচলিত করছে না। কিন্তু বিচলিত করছে না আমাদের সমাজের একমুখী অনৈতিকতার কারণে। খবরটি হলো ‘ধর্ষণের শিকার বলে স্কুলে যেতে পারবে না মেয়েটি’। ঘটনা ঢাকার নবাবগঞ্জে। প্রথমত, মেয়েটি সামাজিক অপরাধের শিকার- বিপর্যস্ত মানসিকভাবে। তার জন্য দরকার সহানুভূতিশীল, মানবিক পরিবেশ, যাতে সে ক্রমে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। এ উদ্দেশ্যে মেয়েটির মা তাকে স্কুলে পাঠান যাতে স্কুলছাত্রীটি লেখাপড়ার মধ্যে ডুবে থেকে তার দুঃসহ অভিজ্ঞতা ক্রমশ ভুলে যেতে পারে। কিন্তু সমাজ অমানবিক, সমাজ বিপরীতমুখী। তাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধর্ষিত ছাত্রীকে তার স্কুলে শিক্ষার্থী হিসেবে রাখতে রাজি নন। সংবাদ সূত্রেও আমাদের জানা নেই এ ক্ষেত্রে ধর্ষক অপরাধী শাস্তি পেয়েছে কিনা। কিন্তু দ্বিতীয় দফা শাস্তি নির্যাতিত মেয়েটির জন্য নির্ধারিত হলো। আমাদের সমাজ এভাবেই এক বিপরীত ধারায় চলছে, বিশেষ করে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে। এ সমাজে প্রায়শ অপরাধী ধর্ষকদের শাস্তি হয় না বলেও তা অপরাধের তুলনায় নগণ্য। গ্রাম্য সালিশি বা বিচারসভায় দেখা যায় ফতোয়াবাজ গ্রামপ্রধানদের প্রাধান্য। সেখানে বিচারে পক্ষপাত দেখা যায় অপরাধী পুরুষটির পক্ষে। যত অপরাধ মেয়েদের। নির্যাতিত হয়েও সে অপরাধী।

দুই. সমাজের অর্ধেক বা পঞ্চাশ শতাংশ নারীর জীবনযাপন শুধু নিরাপত্তাহীনই নয়, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের শিকারও তারা। তদুপরি ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার নারী। কিন্তু তাতে করে সমাজের অপর অংশ মোটেই বিচলিত নয়। অতি ছোটখাটো অংশে দেখা যায় প্রতিবাদ, কিন্তু তা কার্যকর ফলাফল তৈরি করে না। তাই নারী নির্যাতন সমাজে এক বাস্তব সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তারই অপ্রিয় প্রতিফলন নারী নির্যাতনের ব্যাপক সামাজিক বিস্তার। একই সময়ের আরেকটি খবর ‘বিধবা ও স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ’। প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশটা কি ধর্ষকদের হাতে চলে গেছে? নারীর নিরাপত্তা বলে আর কিছু নেই? এ খবরের বিবরণে প্রকাশ কক্সবাজারের চকরিয়ার এক ছাত্রীকে ধর্ষণে বাধা দেয়ায় তার আশ্রয়দাতা ওই বিধবাকে গণধর্ষণ করা হয়। এ ছাড়া ফরিদপুরের সালথা, বরিশালের উজিরপুর, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, রাজশাহীর দুর্গাপুর ও শরিয়তপুরে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টায় পাঁচটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। ভাবতে পারছি না একই দিনের অন্য একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম : ‘গৃহবধূকে তুলে নিয়ে ১৪ দিন আটকে ধর্ষণ, মুক্তিপণ দাবি’। এ ছাড়া একই প্রতিবেদনে রয়েছে ‘মাদারীপুরে এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা’। রয়েছে এমনি একাধিক ঘটনার খবর। কত আর লেখা যায় এসব বীভৎস ঘটনার বিবরণ। লিখব না বলেও না লিখে পারছি না নতুন নতুন অনুরূপ ঘটনাগুলোর খবর প্রতিবাদের অন্তনির্হিত তাড়নায়। একটি দৈনিকে দুই কলামে মোটা হরফে শিরোনাম : ‘নোয়াখালীতে ধর্ষণ বাড়ছে/স্কুলছাত্রীরা বেশি শিকার’। ‘ছয় মাসে ৬৩ ধর্ষণ’। এ ক্ষেত্রে ঘটনার বৈশিষ্ট্য হলো ‘নির্যাতিতদের বেশিরভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারের সদস্য এবং শিশু ও কিশোরী’। এসব ঘটনার বিশদ বিবরণ রয়েছে প্রতিটি প্রতিবেদনে। আমরা সাধারণত প্রতিটি ঘটনার প্রাথমিক তথ্যটির অভিঘাতে ক্ষুব্ধ ও তাড়িত হই, প্রতিবাদের ভাষ্যে নিজ নিজ ভাবনামাফিক কথা বলি বা লিখি, লেখেন সাংবাদিক বন্ধুরা। কিন্তু পরিণামের গভীর দিক নিয়ে ভাবি না বা জানার চেষ্টা করি না। কী পরিণাম এদের জীবনে অপেক্ষা করছে সে হিসাব বড় করুণই হবে। বিভিন্ন পরিবেশে ও সূত্রে বিভিন্ন অপ্রিয় পরিণাম সংসারে বা অন্যত্র, কখনো আত্মহত্যা।

তিন. এমন বহু ঘটনা আমাদের দৃষ্টির বাইরে, জানার বাইরে, সাংবাদিকের অনুসন্ধানী সংবাদের বাইরে। সেসব বিবেচনা করতে গেলে মনে হয়, সমাজের অভ্যন্তরীণ সুস্থ শক্তির আর কিছু অবশিষ্ট নেই, প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষকগণ নখদন্তহীন। কাজেই পূর্বকথার পুনরুক্তি : সমাজটা ধর্ষকের হাতে চলে গেছে। নারীর পক্ষে সমাজে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গীয় শিশু-কিশোরী-তরুণীসহ নারীর। তাই বলে অন্যরা যে একেবারে অক্ষত, তাও নয়। ধর্ষণ যেহেতু এখন মহামারীসুলভ ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, এর প্রতিরোধ, প্রতিকার ও শাস্তিও কঠিনতম চরিত্রের না হলে এ ব্যাধির নিরসন ঘটানো যাবে না। পরিস্থিতি যেহেতু প্রশাসনের আওতা ও ক্ষমতা অতিক্রম করে গেছে এখন আমাদের আশ্রয়, ভরসা শেষ পরিত্রাতা উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালত অবস্থাদৃষ্টে ৭ দফা নির্দেশনা জারি করেছেন। এ সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিক্রিয়া- ‘এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না’র পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিশ্বাস তারা ওই ৭ দফা যথাযথভাবে পালনে তৎপর হবেন। তবু প্রশ্ন থাকে তাতে কি এ ভয়াবহ ব্যাধির নিরাময় ঘটবে যদি এর সঙ্গে প্রকৃত শিশুধর্ষক-নারীধর্ষক অপরাধীর জন্য চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা না হয়? ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে বিভিন্ন মতামত প্রকাশে দেখা গেছে তাদের অনেকে উল্লিখিত বীভৎস অপরাধের জন্য চরম শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী। এমন অভিমত অনেকের, কেউ সৌদি শাস্তি ব্যবস্থার উদাহরণ টানছেন এই জন্য যে তা না হলে এ অপরাধ বাঞ্ছিত মাত্রায় বা পুরোপুরি হ্রাস পাবে না, বন্ধ হবে না। কিছুদিন আগে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রয়োজনে কঠিন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। বর্তমান পরিস্থিতি সেই ‘প্রয়োজনে’র অবস্থা অতিক্রম করে গেছে। এখন আর অপেক্ষার অবকাশ নেই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যমাফিক ধর্ষণের জন্য কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং তা কার্যকর করা হোক এটাই আমাদের দাবি। সমাজটাকে সুস্থ পথে চালনার অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা আছে বলে আমাদের মনে হয় না।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App