×

মুক্তচিন্তা

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সক্রিয় ও সংগঠিত হচ্ছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০১৯, ০৮:০৭ পিএম

বাঙালির বাঙালিত্বে যত অনুষঙ্গ আছে সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটি শক্তি বাংলাদেশে ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বিরোধিতাকারীরা ছিল এই বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই। আমি মনে করি এই বিরুদ্ধ শক্তি মাঝেমধ্যে দুর্বল হয়, কিন্তু হয়তো লুকিয়ে থাকে। তারা আবার শক্তি সঞ্চয় করবে এবং সময়মতো এরা সংগঠিত হবে। তাদের অস্তিত্বের কারণেই তারা এই বিরোধিতা করবে এবং সংগঠিত হবে। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

ঐক্যফ্রন্ট ছিল তাৎক্ষণিকভাবে গঠিত নির্বাচনী জোট। বিএনপির সমর্থকগোষ্ঠী আছে, কিন্তু তাদের নেতৃত্ব ছিল না। তাদের চেয়ারপারসন জেলে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বিদেশে। নির্বাচনে জেতার জন্য তাদের একজন নেতার দরকার ছিল। কয়েকজন সাবেক নেতা, সাবেক নেতা এ জন্য বলছি, তারা এক সময় নেতা ছিলেন, কিন্তু এখন যাদের কোনো অনুসারী নেই। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা এই সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন। বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়। তাদের নেতৃত্ব শূন্যতা ছিল। এই দলছুট এবং সাবেকরা কীভাবে আবার ক্ষমতার স্বাদ পেতে পারে, এটার একটা সম্মেলন করছিল জোট গঠনের মাধ্যমে। যেহেতু তারা কোনো আদর্শ মেনে চলে না। তাদের আদর্শে একেবারে চরম বৈপরীত্য। একদিকে কামাল হোসেন সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, আবার এর সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জোটের আরেক নেতা সুলতান মনসুর তিনি মুজিব কোট পরেন। আবার কাদের সিদ্দিকী তার স্ট্যান্ডগুলোকে রেখে জামায়াত-বিএনপিকে এক করলেন। এই যে টোটাল একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা, এইটা না টেকারই কথা এবং এর পরিণতি এখন যা হওয়ার তাই হয়েছে। নির্বাচন পার হলে কি করবে এই জোটটি, এই চিন্তা-ভাবনা তখনো তাদের ছিল না। অতএব এটা যা হওয়ার তাই হচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বৈরশাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং স্বৈরশাসক তকমা নিয়েই চলে গেলেন। আমি বলছি এই চলে যাওয়াটা হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষিত হবে। কিন্তু এর রেশ কিন্তু বহুদিন থেকে যাবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমি বলব পূর্ব পাকিস্তান কায়েম করা হলো। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বকালে একেবারে পাকিস্তানিকরণের জন্য যা কিছু দরকার তাই করা হলো। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা, যেইটার ওপর ভিত্তি করে সাম্যের চেতনা- সবকিছুকে মিলিয়ে ধর্মীয় একটা লেবাস নিয়ে আসা হলো। জিয়াউর রহমান যে কাজটা আংশিক করেছেন, সেটা পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন কিন্তু এরশাদ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যত রকমের অপশক্তি ছিল, বাম-ডান, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক, চাঁদাভিত্তিক সব মিলিয়ে এই প্লাটফর্মটা তৈরি করেছিল জিয়াউর রহমান। আর এই প্লাটফর্মেই কাজী জাফর, মওদুদের মতো লোকগুলোর আসা-যাওয়া। একই ঘটনা এখন ঘটবে। জাতীয় পার্টি যে দলটা, এইটাও কোনো না কোনোভাবে অবস্থান গ্রহণ করবে। আমার ধারণা আরো অনেক ঘটনা ঘটবে এর মধ্যে। তাদের নর্থ বেঙ্গল বা রংপুরকেন্দ্রিক যে সাপোর্টটা আছে, সেটা কোনদিকে যাবে- তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আর মনোজাগতিকভাবে এখনো কিছু লোক সেখানে রয়ে গেছে, যারা আসলে পাকিস্তানি ভাবধারার লোক। তবে এরশাদকে একটা বিষয়ের জন্য বাহবা দিতে হয়। আসলে বাহবা না ঠিক, ক্রেডিট দেয়া যেতে পারে। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে ওই গোষ্ঠীর (মুক্তিযুদ্ধবিরোধী) সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার যে প্রচেষ্টাটা ছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা অবস্থান নেয়াতে কিছুটা হলেও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির দিকে অবস্থান তাকে এতদিন ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা রাজনীতিতে থাকার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি। এরশাদ সাহেব যদি আগের প্লাটফর্মটা সমর্থন করে একই অবস্থানে থাকতেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের যে অর্জনগুলো ফিরিয়ে আনছি, তা অনেক কঠিন হতো। কারণ এরশাদ সাহেব সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরশাদ সাহেব অতীতে যে অপকর্ম করছেন, তা ঢাকা না দেয়া গেলেও এই বক্তব্যের মাধ্যমে কিছু বেনিফিট, রাজনৈতিক ফায়দা যাকে বলা হয়- সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দিকে কিছুটা হলেও আসছে বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশের যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে, সেই হিসেবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত কিন্তু এটা বাংলাদেশ ছিল না। পুরো সময়টা পূর্ব পাকিস্তানের যে সেটআপটা ছিল, সেই মেন্টালিটির ছিল। এরশাদ যখন শাসনে ছিলেন ৬৪ জেলার মাঝে ৫৪ জেলার এসপি সামরিক বাহিনীর লোক ছিল। আমি শুধু একটা উদাহরণ দিলাম। আমরা কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে টানা ২০-২২ বছর হ্যাঁ-না এসব ভোট দিয়ে আমাদের গণতন্ত্র চালিয়ে আসছি। আমাদের রাষ্ট্রপতি ক্যান্টনমেন্টে থাকতেন, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ক্যান্টনমেন্টে থাকতেন। পাকিস্তান যেভাবে চলছে, আমরা কিন্তু ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক সেই ব্যবস্থার মধ্যে ছিলাম। সে হিসেবে আমাদের গণতন্ত্রের বয়স কিন্তু ৫০ বছর না। ওয়ান-ইলেভেনের পরের ঘটনা হচ্ছে, সেখানে যে লোকগুলো সক্রিয় তাদের মুখগুলো দেখলেই বোঝা যায়। জাতি যখন একেবারে বিপন্ন, পেছন থেকে সামরিক শাসকরাই চালাচ্ছিল দুই বছর। তখন দেখা গেছে এই লোকগুলো বিভিন্ন নামে যেমন- সৎ প্রার্থী খুঁজবে, যোগ্যপ্রার্থী আন্দোলন, ট্রুথ কমিশন গঠন করে। এই লোকগুলো যখন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থাকে, তখন এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। আর ওই সময় তারা (সামরিক শাসক) মুক্ত ফিল্ড পেয়ে যায়। যতবারই বাংলাদেশে সামরিক শাসন বা কিছু একটা আসছে, ততবারই কিন্তু কিছু লোক স্বস্তিবোধ করছে। এই লোকগুলোর তালিকা করে দেখানো যাবে। আমি যদি শব্দটা বলি, এই লোকগুলো প্রাণ ফিরে পায় সামরিক শাসন বা ওই ধরনের কিছু আসলে। আমাদের গণতন্ত্র চর্চার যে বয়স, সেখান থেকে মাঝখানের এই ২২-২৩ বছর বাদ দিতে হবে। যদি বাদ না দিয়ে বলেন আমাদের গণতন্ত্র ৪০ বছর ৫০ বছরের মধ্যে আসছে, ম্যাচিউরিটি আসছে- আসলে এটা কখনো হয়নি। সে জন্য আমাদের আরো সময় অপেক্ষা করতে হবে। আরেকটা কথা হলো ঞযব ঃৎধফরঃরড়হ ভড়ৎস ড়ভ ফবসড়পৎধপু অর্থাৎ গণতন্ত্র ও গণতন্ত্র চর্চার যে রাজনীতি এর সঙ্গে যেসব বিষয় জড়িত ছিল। যেমন- জনসমাবেশ, জনগণকে একত্রিত করা, মিছিল করা, হরতাল-অবরোধ এগুলোর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে নেতিবাচক হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ রাজনীতির নামে এ অঞ্চলের মানুষ যা দেখেছে, তাতে কোনোভাবেই এসব হরতাল-অবরোধে মানুষের সাড়া আর পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ নতুন কোনো পন্থা বের করতে হবে, পুরনো পন্থা দিয়ে রাজনীতি আর চলবে না। সম্পূর্ণ বিরোধী চিন্তা-চেতনার লোকদের ঐক্য ইতিহাসে নতুন কিছু না। ইতিহাসে এ রকম বহু ঘটনা আছে, চরম বৈরী বা পরস্পর একেবারে মুখোমুখি অবস্থানে থাকে। বিপরীত অবস্থানে থেকে পরবর্তী সময় একসঙ্গে রাজনীতিতে কাজ করার ঘটনা কিন্তু পৃথিবীতে বিরল না। যদি কেউ মনে করে যে, বিএনপি একটা দল যারা চরম অসংগঠিত হয়ে গেছে বা তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই- এমন ভাবনা ভুল। কারণ বিএনপি একটি প্লাটফর্ম। ১৯৪৭ বা তারও আগ থেকে একটা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী আমাদের রাজনীতিতে ছিল। যারা আমাদের ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রসঙ্গীত, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ছিল। ৭০-এর নির্বাচনে ২৩.৭৪ শতাংশ লোক ৬ দফার বিরোধিতা করেছিল। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাও করেছিল। এসব শক্তির লোকের একটা প্লাটফর্ম এই বিএনপি। এখন জেনেটিক্যালি তাদের আওয়ামী লীগের বিপক্ষে থাকতে হবে। অর্থাৎ বিএনপি ইচ্ছা করুক বা না করুক তবুও তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে থাকবেই। বিএনপি অন্য যে কোনো নাম ধারণ করুক, অন্য কেউ নেতৃত্বে আসুক, তারপরও কোনো না কোনোভাবে বিরুদ্ধ শক্তির লোক সেখানে থেকে যাবে। এটাই বাস্তবতা। অর্থাৎ বাঙালির বাঙালিত্বে যত অনুষঙ্গ আছে সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটি শক্তি বাংলাদেশে ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বিরোধিতাকারীরা ছিল এই বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যেই। আমি মনে করি এই বিরুদ্ধ শক্তি মাঝেমধ্যে দুর্বল হয়, কিন্তু হয়তো লুকিয়ে থাকে। তারা আবার শক্তি সঞ্চয় করবে এবং সময়মতো এরা সংগঠিত হবে। এ জন্য যারা প্রগতিশীল, বাঙালিত্ব, মুক্তিযুদ্ধ, সাম্য, অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতি করে, তাদের খুব বেশি স্বস্তিতে থাকার কারণ নেই। আমরা যতই বলি যে এদের কোনো আদর্শ নেই। আদর্শ অবশ্যই আছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আদর্শ তাদের আছে। যার জন্য লাখো শহীদ রক্ত দিয়েছেন, যেটা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা, আমাদের যে সাম্যের রাজনীতি এই সবকিছুর বিরুদ্ধাচারণ করে যারা আছে, আমি মনে করি তাদের সংখ্যা কমেনি। আরো বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুধু রেমিটেন্স আসেনি, মরু কালচারও আসছে। আমি মনে করি আমাদের বাংলাদেশ সরকারের যত রকমের অর্থনৈতিক কমকাণ্ড পরিচালনা করা আছে, এর মধ্যে এমনটা হওয়া উচিত যাতে করে আমাদের লোককে কাজ করতে পশ্চাৎপদ কোনো দেশে যেতে না হয়। আমরা মনে করি কিছু টাকা হয়তো পেয়ে গেলাম। কিন্তু ওই যে পাকিস্তান, ইসলাম, মুসলমান, সৌদি আরব, সাতচল্লিশের পর থেকে এই যে ঘটনা, তা এখনো সক্রিয়। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক ফ্লো, টাকাপয়সা ইত্যাদিতে তারা শক্তি সঞ্চয় করছে। এরা কখনো দমবে না। তাদের অস্তিত্বের কারণেই তারা এই বিরোধিতা করবে এবং সংগঠিত হবে। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App