×

জাতীয়

প্রস্তুতি ছিল না, পদক্ষেপও নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০১৯, ১২:২৯ পিএম

প্রস্তুতি ছিল না, পদক্ষেপও নেই
দেশে এবার আগেভাগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়তই আগের রেকর্ড ভেঙে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। জানুয়ারি থেকেই এ রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে রাজধানীবাসী। এপ্রিলের পর আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বাড়তে থাকে। তবে এ নিয়ে তেমন কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি সংশ্লিষ্টদের। বরং ওষুধ কেন কাজ করে না, ঠিকাদার নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ করেছে; নাকি ওষুধ ঠিকই আছে, মশারা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে এসব নানা বিতর্কে মাসের পর মাস পেরিয়ে গেছে। অবশেষে জুলাইয়ের শেষার্ধে ডেঙ্গু যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল; তখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে নগরবাসীর সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলে এবং একে নিজেদের দায় অন্যের কাঁধে চাপানোর কাজেই ব্যস্ত ছিলেন জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও নগরকর্তারা। দিনে দিনে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়তে থাকায় বিষয়টি গড়িয়েছে হাইকোর্টেও। শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্দেশনা দিতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে। মশা নিধনে দেশে কার্যকর ওষুধ না থাকায় পাশর্^বর্তী দেশ থেকে তা আনার কথাও জানানো হয়েছে। কিন্তু তা কতদিনের মধ্যে আনা হবে সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। এদিকে সরকারের মন্ত্রী পরিষদের কেউ ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক প্রকাশ করছেন, কেউ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছেন আবার কেউ ডেঙ্গুর বিস্তারকে তুলনা করছেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রজনন ক্ষমতার সঙ্গে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৭, ফেব্রুয়ারিতে ১৯, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মে মাসে ১৮৪, জুনে ১ হাজার ৮২৯, জুলাইয়ে (২৫ তারিখ পর্যন্ত) ৭ হাজার ১১২ জন। মোট ৯ হাজার ২৫৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫৪৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এম এম আকতারুজ্জামান ভোরের কাগজকে জানান, চলতি বছর ৩ মার্চ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক বর্ষাকালীন জরিপের তুলনায় চলমান (১৭-২৭ জুলাই) বর্ষাকালীন জরিপে দেখা গেছে, আগের তুলনায় এডিসের লার্ভার হার বেড়েছে ৩ গুণ। আর বয়স্ক এডিস মশার হার বেড়েছে ৪ থেকে ৭ গুণ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের পূর্ব প্রস্তুতি না থাকা, নিয়মিত ওষুধ না ছিটানো, রাস্তায় খুঁড়ে রাখা জায়গা ও নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে এডিস মশা জন্মের হার বাড়ায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এখনো আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস বাকি। এখনই যদি কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া যায়, তাহলে এই দুই মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষকে একত্র করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও)। বুধবার এক সমন্বয় সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। পিএমও এ সময় ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাদের মশা নিধন অভিযানকে জোরদার করার আহ্বান জানায়। সেই সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে প্রতিটি হাসপাতালে বিশেষ মেডিকেল টিম গঠনের নির্দেশনা দেয়। সব সরকারি দপ্তরকে নিজস্ব অফিস এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয় পিএমওর নির্দেশনায়। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব মনে করেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশা নিধনে সংশ্লিষ্টরা পুরোপুরি ব্যর্থ। তাদের উচিত মানুষকে সঠিক তথ্য জানানো এবং রোগের প্রাদুর্ভাব ঝেঁকে বসার আগেই তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া। এদিকে ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে এডিস মশা নির্মূল এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে চার দিনের (৩০ জুলাই) পর্যন্ত সময় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই সময়ের মধ্যে ওষুধ ব্যবহারে মশা নিধন হয়েছে কিনা সে বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছে আদালত। দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বক্তব্য শুনে গতকাল বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মশানিধনে ওষুধ কাজ করছে না বলে আদালতকে জানান। আইসিডিডিআরবির গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে পূর্ণ বয়স্ক মশা মারতে এক লিটার কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক ১ শতাংশ এস বায়ো অ্যালাথ্রিনের মিশ্রন ফগার মেশিন দিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক লিটার কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ অ্যালেথ্রিন মেশানো হয়। এই মিশ্রনে মশা মারার মূল উপাদান হিসেবে থাকে পারমেথ্রিন, যা এখন মশা মারতে কাজ করছে না। এ তথ্যা মানতে রাজি নন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। জাতীয় মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গতকাল তিনি বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেই ওষুধের কার্যকারিতা এখনো আছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সকল সংস্থা একযোগে কাজ করছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি। আর নিজেদের ব্যর্থতার দায় নিতে রাজি নন দুই সিটি কর্তৃপক্ষও। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের দাবি মশা নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। সাড়ে তিন লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এ বিষয়ে ‘ছেলেধরার’ মতো গুজব ছড়ানো হচ্ছে। গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু জ¦রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ডেঙ্গুর যন্ত্রণা কী, আমি বুঝি। এ অসুস্থতা নিয়েই গত ১৩ জুন সংসদে আসি। আল্লাহ যেন আর কারো ডেঙ্গু না দেয়। আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতার তুলনা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল ডেঙ্গুবিষয়ক এক সেমিনারে তিনি বলেন, যেভাবে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ে সেভাবে মশার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। মশা নিধনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও এডিস মশার বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কাজ করছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, মশা নিধনের লক্ষে নানা তৎপরতা চলছে। ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ওয়ান স্টপ সেন্টার চালু হচ্ছে। দ্রুত রোগী শনাক্ত ও বিশেষজ্ঞদের তৈরি গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে ৪০ হাজারেরও বেশি ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটস রয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে আরো এক লাখ কিটসের সহায়তা চেয়ে অনুরোধ করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App