×

মুক্তচিন্তা

পাল্টাচ্ছে মার্কিন রাজনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০১৯, ০৮:২৪ পিএম

পাল্টাচ্ছে মার্কিন রাজনীতি
পাল্টাচ্ছে মার্কিন রাজনীতি

৩৮০ কোটি মানুষ যারা পৃথিবীর জনসংখ্যার দরিদ্র অর্ধেক তাদের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক ২৬ জন ধনী বিলিয়নেয়ার। বৈষম্য-বৃদ্ধি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত করছে, অথচ ১ শতাংশের সম্পদের ওপর করারোপ করে বছরে আনুমানিক ৪১৮ বিলিয়ন পাওয়া যাবে- যা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে ৩০ লাখ মৃত্যু প্রতিরোধের জন্য ও বিদ্যালয়বহির্ভূত প্রত্যেক শিশুর শিক্ষার জন্য যথেষ্ট।

পৃথিবী ও মানবতা এখন দুটি বড় বিপদের মুখোমুখি- প্রকৃতি ধ্বংস ও সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি। সারা বিশ্বে নীতিনির্ধারকরা এ দুটি বিরাট সমস্যা মোকাবেলা করতে আজ হিমশিম খাচ্ছেন। একদিকে, ‘মৌমাছি ও পতঙ্গরা হারিয়ে যাচ্ছে, প্লাস্টিক দূষণ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উত্তর মেরুর বরফ গলে শেষ হতে পারে ২০৫০ সাল নাগাদ এবং ইউরোপে এখনই যে অগ্নিকাণ্ড, খরা ও বন্যা চলছে তা আরো খারাপ আকার ধারণ করবে। ... ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের তথ্যানুযায়ী ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আনুমানিক ৬০ শতাংশ কমে গেছে।’ প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক নিবন্ধে (It’s Time for a Green EU Deal,  এপ্রিল ১৭, ২০১৯) ইউরোপিয়ান কমিশনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ফ্রান্সের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল বার্নিয়ার এসব কথা লিখেছেন। আবার জ্যাকোবিন সাময়িকীর ব্রাঙ্কো মার্সেটিক লিখেছেন, ‘সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক নতুন গবেষণায় জানা গেছে বিশ্বে পতঙ্গ সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে, যেখানে পতঙ্গ প্রজাতিসমূহের এক-তৃতীয়াংশই বিলুপ্তির হুমকির মুখে, এভাবে চললে এ শতাব্দীর শেষে সব পতঙ্গই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে, যার ফলে খাদ্য, পানীয় ও জীবনযাপনের জন্য আমরা যে প্রাকৃতিক বিশ্বের ওপর নির্ভর করি তা ধসে পড়বে। এই গণবিলুপ্তির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন ও তাকে উসকে দিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহারসহ শিল্পনির্ভর কৃষির চর্চা।’ (The Green New Deal Is the Only Realistic Option, ০২.২১.২০১৯, জ্যাকোবিন)

অন্যদিকে, ‘বিশ্বের সম্পদ কয়েকজনের কাছে কুক্ষিগত হয়ে পড়ার চিত্র ফুটে উঠেছে এক প্রতিবেদনে যেখানে দেখানো হয়েছে ৩৮০ কোটি মানুষ যারা পৃথিবীর জনসংখ্যার দরিদ্র অর্ধেক তাদের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক ২৬ জন ধনী বিলিয়নেয়ার।’ ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভা উপলক্ষে বার্ষিক সম্পদ বিষয়ক প্রতিবেদনে উন্নয়ন-সাহায্য সংস্থা অক্সফাম বলেছে, ‘বৈষম্য-বৃদ্ধি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত করছে, অথচ ১ শতাংশের সম্পদের ওপর করারোপ করে বছরে আনুমানিক ৪১৮ বিলিয়ন পাওয়া যাবে- যা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে ৩০ লাখ মৃত্যু প্রতিরোধের জন্য ও বিদ্যালয়বহির্ভূত প্রত্যেক শিশুর শিক্ষার জন্য যথেষ্ট। (World’s 26 richest people own as much as poorest 50%, says Oxfam, ল্যারি এলিয়ট, ২১ জানুয়ারি ২০১৯, দ্য গার্ডিয়ান)

আমাদের বর্তমান দুনিয়ায় এই দুই বক্তব্য ও ছবির মাঝে কি কোনো সম্পর্ক আছে? সম্পর্ক শুধু আছে না, এ সম্পর্ক খুবই দৃঢ়। এই দুই বিপদকে একসঙ্গে মোকাবেলা করার চেষ্টা করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্তেজ ও সিনেটর এড মার্কি কর্তৃক কয়েক মাস আগে প্রস্তাবিত সবুজ নয়া চুক্তির মাধ্যমে। ঘোষণার পর থেকেই এখন পৃথিবীর সব দেশে চুক্তিটি নিয়ে কথা হচ্ছে। নামটির মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হয়েছে ১৯৩৩ সালে মন্দার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের নেয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে। এতে বার্নি স্যান্ডার্সের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযান থেকে বহু উপাদান নেয়া হয়েছে। শুরু হয়েছে ইইউ গ্রিন নিউ ডিল, গোবাল গ্রিন নিউ ডিলসহ বিভিন্ন সবুজ নয়া চুক্তির কথা। এ ধরনের উদ্যোগ অবশ্য বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। তবে এটি বিশ্বব্যাপী মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্ব আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্তেজের, যাকে সংক্ষেপে এওসি বলেও ডাকা হয়।

পুয়ের্তোরিকান বংশোদ্ভূত ওকাসিওর জন্ম নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসে। একটি পানশালায় ওয়েট্রেসের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাকে এক সময় অন্যের ঘরদোর সাফ করতে হয়েছে, মাঝে মাঝে তিনিও যোগ দিয়েছেন। এখন ২৯ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এ যাবৎকালের কনিষ্ঠতম কংগ্রেসওম্যান। আর বর্তমানে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান রাজনীতিকদের একজন, বলেছেন ব্রিটেনের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বর্তমানে লন্ডন ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক জর্জ ওসবোর্ন। (জিম ওয়াটারসনের লেখা নিবন্ধ, দ্য গার্ডিয়ান, ৭ মার্চ ২০১৯) মার্কিন রাজনীতিতে তার এই উল্কার মতো উত্থানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তার প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্মপরিকল্পনাকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে উপস্থাপনের ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের দক্ষতার ওপর। কোর্তেজ ২০১৬ সালে বার্নি স্যান্ডার্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী অভিযানে সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন, সবুজ নয়া চুক্তির অনেক কিছুই যাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন এই প্রস্তাবনা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থাকে জীবাস্ম জ্বালানি থেকে ভিন্নমুখী করে এই চুক্তি আগামী দশ বছরে দেশকে কার্বন-দূষণ মুক্ত করতে চায়।

এ বিষয়ে গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস বলেন, ‘একটি আন্তর্জাতিক সবুজ নয়া চুক্তি অতিশোষিত এলাকার ক্ষতিপূরণ করতে বিশ্বে সম্পদের পুনর্বণ্টন করবে, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিকে রোধ করবে ও সব জলবায়ু-শরণার্থীর জন্য একটি সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করবে।’ তিনি একটি আন্তর্জাতিক সবুজ নয়া চুক্তির প্রয়োজন অনুভব করেন, ‘বিশ্ব জিডিপির ৫% করে নিয়ে প্রতি বছর ৮ ট্রিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে, নবায়নযোগ্য শক্তিসম্পদে রূপান্তরের জন্য বিনিয়োগ সমন্বয় করতে এবং কোনো দেশের সামর্থ্যরে বদলে তার প্রয়োজনের ভিত্তিতে তাকে জলবায়ু নিরাপত্তা প্রদান করতে।’ (It’s time for nations to unite around an International Green New Deal, ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস ও ডেভিড অ্যাডলার, দ্য গার্ডিয়ান, ২৩ এপ্রিল ২০১৯)

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিস্মিত করে কোর্তেজ গত বছর নভেম্বরে ১০ বার বিজয়ী ডেমোক্রেট নেতা জো ক্রাউলিকে পরাজিত করে যুক্তরাষ্ট্রের ১২৯তম কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন। পলিটিকো সাময়িকীতে ডেভিড ফ্রিডল্যান্ডার তার এই আবির্ভাবকে রাজনৈতিক আকাশে সুপারনোভার বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন কীভাবে তিনি আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্রকে বদলে দিচ্ছেন। (How Alexandria Ocasio-Cortez Broke All the Rules of New York Politics, এপ্রিল ৮, ২০১৯) জনপ্রিয়তা অর্জনের ও ট্রাম্পের মতো টুইট ব্যবহারের কৌশলকে পুরোদমে ব্যবহার করে তিনি সবুজ নয়া চুক্তির ধারণাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন। টুইট ব্যবহারে তার মুন্সিয়ানার কারণে ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিও তাকে এতদিন আক্রমণ করতে ভয় পেয়েছেন। অবশেষে ট্রাম্পও পিছলে গেলেন সম্প্রতি কোর্তেজসহ চারজন অশ্বেতাঙ্গ কংগ্রেসওম্যানকে আমেরিকা ছেড়ে যেখান থেকে তারা এসেছেন সেখানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে। বলেছেন, ‘সেই সম্পূর্ণ ধসে পড়া ও অপরাধে ভরা নিজ দেশকে ঠিকঠাক’ করতে। ওকাসিও-কোর্তেজ ঠিক তাই করছেন। যে আমেরিকায় তার জন্ম সেই ধসে পড়া ও অপরাধে ভরা জায়গাটিকে ঠিক করার অভিযানে নেমেছেন তিনি। কোর্তেজের পথ ধরে একটি আন্তর্জাতিক সবুজ নয়া চুক্তিও লাগবে এখনকার ধ্বংসোন্মুখ পরিবেশ ও বৈষম্যে ভরা বিশ্বকে ও এর অধিবাসীদের রক্ষা করতে।

আলমগীর খান: নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App