×

মুক্তচিন্তা

দেশে কি হচ্ছে এসব?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০১৯, ০৮:২৪ পিএম

বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটছে। বন্যায়ও মানুষ মারা যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে সফল হতে হবে। বন্যা যদি সারাদেশে বিস্তার লাভ করে তাহলে মানুষের থাকা-খাওয়ার সমস্যা দেখা দেবে। বন্যায় ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হলে খাদ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে, সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়। এসব বিষয়ে আগে থেকে চোখ রাখতে হবে। কেউ যেন পরিস্থিতির সুযোগ নিতে না পারে সেটা দেখার যাদের দায়িত্ব তারা যেন চোখ বন্ধ করে বসে না থাকেন। মনে রাখতে হবে, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।

দেশে আসলে কি হচ্ছে? সবকিছু কি ঠিকঠাক মতো চলছে? নাকি বড় কোনো গড়বড় কোথাও হয়েছে কিংবা হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে? সরকার আছে। মন্ত্রী আছেন। আছেন নানা পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা। আছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং আছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো। উন্নয়নমূলক কাজকর্ম অব্যাহতভাবে চলছে। এতকিছু সত্ত্বেও মানুষের মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। নানা কারণে মানুষের মনে ভয়, উদ্বেগ। কেন এত গুজব? কেন মানুষের মনে অস্থিরতা? সরকারের নিয়ন্ত্রণ এত শিথিল কেন? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর নেই বা সদুত্তর নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে নেই। তিনি ফিরবেন আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। দায়িত্ব গ্রহণের পর সম্ভবত এত দীর্ঘ সময় টানা দেশের বাইরে থাকেননি। অবশ্য তিনি দেশের বাইরে থাকলেও দেশের সব ব্যাপারে খোঁজখবর রাখেন। প্রয়োজনানুসারে নির্দেশনা দেন। তিনি ছাড়া যে সরকারে আর ‘যোগ্য’ মানুষ তেমন কেউ নেই সেটা বারবার প্রমাণ হয়েছে, হচ্ছে। সঠিক সময়ে দ্রুততার সঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখ হাসিনার জুড়ি নেই। তার যারা সমালোচক তারাও এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে, শেখ হাসিনার বিকল্প নেতৃত্ব দেশে নেই।

দেশে একটি অস্থির পরিস্থিতি তৈরির পরিকল্পিত অপচেষ্টা যে আছে সেটা স্বীকার করতেই হবে। কারা এটা করছে? সরকারি তরফ থেকে বলা হবে, সব অনিষ্টের মূল তাদের বিরোধীরা। ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। সরকারের কাছে ‘কেষ্টা ব্যাটা’ হলো মোটা দাগে বিএনপি-জামায়াত। আবার বিএনপি-জামায়াতের কাছে ‘কেষ্টা ব্যাটা’ হচ্ছে সরকার তথা সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী দেশে বিভিন্ন ইস্যুতে গুজব ছড়ানো, পিটিয়ে নিরীহ মানুষ মারাসহ যেসব অঘটন ঘটছে তার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দুষছে। বলা হচ্ছে, সরকারকে বেকায় ফেলার জন্য তারা এসব করছে। আন্দোলন করে তারা সরকারকে কাবু করতে পারেনি। এখন তারা ভিন্ন কৌশলে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে চাইছে। এমনটা হতে পারে না, তা নয়। তবে এতদিন সরকারি লোকজন বিএনপি-জামায়াতের সামর্থ্য নিয়ে, সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের কিছু করার মুরোদ নেই বলেও ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা হয়েছে। হঠাৎ তাদের সক্ষমতা বাড়ল কীভাবে? এই যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, মানুষ সেসব গুজব বিশ্বাসও করছে। তো, এই রকম পরিস্থিতি দেশে তৈরি হলো কীভাবে? শক্তপোক্তভাবে তো টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগই। তাহলে অস্থিরতা কেন? কোনো কারণে কি সরকারের প্রতি মানুষের আস্থার অভাব বা ঘাটতি দেখা দিয়েছে? মানুষ বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেয় না। কিন্তু তারা গুজব ছড়ালে বিশ্বাস করে কেন? ভাবা দরকার, বিষয়টি নিয়ে সবারই ভাবা দরকার। নির্মোহভাবেই ভাবনা-চিন্তা করা উচিত।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশ এখন ভয়াবহ একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাচ্ছে একটি দল। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিচার পাওয়ার আশা এখন দুরাশা’। তার মানে দেশে যে গুজব রটছে, ছেলে ধরা সন্দেহে পিটিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে, এটা ‘গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের’ ফল। তার মানে বর্তমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দেশে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে? কীভাবে হবে সেটা? আওয়ামী লীগ সরকারকে হটিয়ে বিএনপি এবং তার সহযোগীদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই কি দেশ বর্তমান অবস্থা থেকে বের হতে পারবে? বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশে সুশাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে বলে দেশের মানুষ মনে করে না। মানুষ যদি বিএনপিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে ভাবতো তাহলে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি হয়তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতো না। পরিস্থিতি যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তাই বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কেমন একটা বিচলিতভাব অনেকের মধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। এই সমবেত হতাশা দেশের জন্য ভালো নয়।

বিএনপি তার রজনীতি করবে, করছে। বিরোধী দল হিসেবে সরকারের সমালোচনা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কোথায় এবং কি করছে সরকারে থাকা এই দলটি? আওয়ামী লীগ নামের বিশাল দলটির অস্তিত্ব কি টের পাওয়া যাচ্ছে কোথাও? হ্যাঁ, কোথাও খারাপ কিছু ঘটলে তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নাম জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। যেমন বরগুনায় প্রকাশ্যে রিফাত নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা এবং তারপরের ঘটনাবলির সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের নাম আসছে নানাভাবে। প্রকৃত অপরাধী আড়াল করার একটি চেষ্টা চলছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এই যে খারাপ সব কিছুর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নাম জড়িয়ে যাওয়া এটা কি ভালো লক্ষণ? মানুষের বিপদ-আপদে পাশে না থেকে আওয়ামী লীগ যদি মানুষের বিপদ-আপদের কারণ হয়, তাহলে দলটি কি আর মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবে?

আমরা জানি, সারাদেশে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শেকড় বিস্তৃত। বাংলাদেশে এমন বাড়ি হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী বা সমর্থক পাওয়া যাবে না। দেশ যখন গুজবের বন্যায় ভাসছে (প্রাকৃতিক বন্যায়ও দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাসছে), তখন কোথায় আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিশ্রামে আছেন? পিটিয়ে যখন মানুষ মারা হয় তখন আওয়ামী লীগের কেউ থাকেন না, সেটা কি হতে পারে? ভোটের হিসাবে তো প্রতি দশজনে আওয়ামী লীগার থাকার কথা অন্তত তিনজন। মানুষ হত্যার উন্মত্ততা যারা দেখাচ্ছেন তারা সবাই সরকারবিরোধী হয় তাহলে আওয়ামী লীগের লোকজন কোথায়? আওয়ামী লীগাররা কি তামাশা দেখছেন?

ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মানুষ হত্যার বিষয়টি সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। গুজব রটনাকারী এবং পিটিয়ে হত্যা করছে যারা তাদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নাও থাকতে পারে। গুজবের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু করতে দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। না হলে গণবিচ্ছিন্নতার পরিণামে এক সময় হয়তো ঐতিহ্যবাহী এই দলটি মুখ থুবড়ে পড়বে।

ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। এটা গুজব নয়, বাস্তব। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ বাড়ছে না। মশা নিধনে বা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ-পদক্ষেপ দেখা যায় না। মশা মারার জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তার কার্যকারিতা নাকি শেষ হয়েছে। এটা শোনা যাচ্ছে কয়েকদিন থেকেই। তাহলে জননিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে দ্রুত কার্যকর ওষুধ আমদানির ব্যবস্থা নেয়া হলো না কেন? ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র মশা নিধনে সফল না হয়ে কথায় সফল হতে চেষ্টা করছেন। তার কিছু কথা এর মধ্যেই মানুষের মনে বিরূপতা তৈরি করেছে। আশা করি সাঈদ খোকন কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবেন। ঢাকার দুই মেয়র যেহেতু আওয়ামী লীগ করেন, সেহেতু তাদের ব্যর্থতা কার্যত সরকারের ব্যর্থতা বলেই গণ্য হবে।

বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটছে। বন্যায়ও মানুষ মারা যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে সফল হতে হবে। বন্যা যদি সারাদেশে বিস্তার লাভ করে তাহলে মানুষের থাকা-খাওয়ার সমস্যা দেখা দেবে। বন্যায় ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হলে খাদ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে, সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়। এসব বিষয়ে আগে থেকে চোখ রাখতে হবে। কেউ যেন পরিস্থিতির সুযোগ নিতে না পারে সেটা দেখার যাদের দায়িত্ব তারা যেন চোখ বন্ধ করে বসে না থাকেন। মনে রাখতে হবে, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।

বিভুরঞ্জন সরকার: যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App