×

সাময়িকী

সূর্য ওঠার আগে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০১৯, ০৮:১১ পিএম

অ, এই কথা! আমরা তো বন্দুক বাহিনী গঠন করেছি, তুমি শোনোনি? না তো! সেটা আবার কী? যাদের বাড়িতে বন্দুক আছে, তাদের সব বন্দুক এইখানে এনে জড়ো করা হবে। এদের নিয়েই বন্দুক বাহিনী। এরাই যুদ্ধ করবে? আরে নাহ্্! এরা পালাক্রমে পাহারা দেবে এই শহর। যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়। বাহ্। এরা তাহলে গাংনীতেই থাকবে? হ্যাঁ। মেহেরপুরেও এরকম বন্দুক বাহিনী তৈরি হয়েছে। আমি তো মেহেরপুরেই যাচ্ছি। আমাদের নূরু চাচাকে আনসার ক্যাম্পে রেখে আসি। এর মধ্যে হঠাৎ সংগ্রাম কমিটির নেতা হিসাবউদ্দীন এসে হাজির। সঙ্গে জোড়পুকুরের রহমান মিয়া। দুজনে কন্ট্রোল রুমের খোঁজখবর নেন। নূর মোহম্মদ মেহেরপুরে যাচ্ছে শুনে বলেন, বিকেল নাগাদ রাইপুর চাঁদপুর মিনিপাড়া থেকে আরো বেশ ক’জন আনসার আসবে। তুমি তাদের সঙ্গে গেলেও পার। কিন্তু নূর মোহম্মদের একই কথা- সে আর দেরি করতে পারবে না। কাজেই দেরি না করে নূর মোহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে হাফিজুর মেহেরপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় হঠাৎ এক অচেনা লোক এসে হন্তদন্ত হয়ে সাইকেল থেকে নেমে হিসাবউদ্দীনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, খবর শুনেছেন লিডার, তেঁতুলবাড়িতে তো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হিসাবউদ্দীন ভ্রু কুঁচকে তাকান। হাফিজুর কান খাড়া করে। তেঁতুলবড়ি হচ্ছে গাংনী থানার একেবারে সীমান্তবর্তী এক গ্রাম। সেখানে ইপিআর-এর একটি ক্যাম্প আছে। যুদ্ধ কি তাদের সঙ্গে? ইপিআরদের তো চুয়াডাঙ্গায় চলে যাবার কথা। সংবাদদাতা লোকটি হড়বড় করে জানায়- নুরু চেয়ারম্যানর লোকজন ক্যাম্পে গিয়ে এক ইপিআর সদস্যকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সেই ইপিআর ছিল অবাঙালি। হিসাবউদ্দীন গুরুগম্ভীর স্বরে বলেন, নূরু চেয়ারম্যান লোকটাই ভীষণ খামখেয়ালি। বাঙালি-অবাঙালি যা-ই হোক, এখনই এমন মারমুখী হবার কী দরকার? তেঁতুলবাড়ি ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান নুরুল হুদা সম্পর্কে মামা হয় হাফিজুরের। মায়ের চাচাতো ভাই। হাফিজুরকে যথেষ্ট আদর করেন। দেখা হলেই দেশের কথা, ঢাকার কথা, রাজনীতির কথা জিজ্ঞাসা করেন। যুদ্ধের সময় জ¦ালানি তেলের সংকট হতে পারে ভেবে গতকাল ভারতের তেহট্ট বাজার থেকে দুই ব্যারেল ডিজেল-পেট্রল এনে এসডিও সাহেবের কাছে জমা দিয়েছেন। সেই মানুষটা এমন মাথা গরম করে ফেললেন! হিসাবউদ্দীন সংবাদদাতা লোকটিকে নিয়ে একটু সরে গিয়ে নিচু গলায় কী সব আলাপ করতে থাকেন। হাফিজুর তার কিছুই শুনতে পায় না বলে পথে পা বাড়ায়। পথে নেমে কী কারণে যেন দুজনের কথা মনে পড়ে। একজন অতীন। অন্যজন বাঘা। বাড়ির সবার চেয়ে হাফিজুরের কাছে একটু বেশি প্রশ্রয় পায় বাঘা। কান নাচিয়ে লেজ নাগিয়ে নানাভাবে সে তার আনুগত্য প্রকাশ করে। এ বাড়ির সবার সঙ্গেই তার সম্পর্ক ভালো। রাজ্যের যতো খিটিমিটি মেজো জামাই কুদ্দুসের সঙ্গে। তার বিরুদ্ধে কোনো নালিশ সে জানায় না। কিন্তু বনিবনা মোটেই হয় না, সেটা বেশ ভালোই বুঝা যায়। সেই বাঘার কী যে হলো আজ সকালে, কিছুতেই হাফিজুরের পিছু ছাড়তে চায় না। আরে বাপু, বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটুখানি এগিয়ে দিলি এই তো অনেক, সারা পথই কি পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে হবে তোকে! হাফিজুর তাকে ধমক দিয়ে সরাতে চায়, তখন সে গিয়ে নূরু চাচার পায়ের কাছে মুখ ঘষে, কী যেন বলতে চায়। এসবের কিছুই বোঝে না নূরু চাচা। বিরক্ত হয়ে তেড়ে মারতে উদ্যত হয়। অবশেষে ঘেউ ঘেউ করে নালিশ জানায়, তবু সাড়া না পেয়ে সূর্যখোলা গ্রামের শেষপ্রান্তের খালপাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে সে ফিরে যায়। একটি কুকুরের এবং বিধ আচরণের কোনো তাৎপর্য খোঁজার কথা তখন মনে হয়নি হাফিজুরের। নূরু চাচার কাছে কী বলতে চেয়েছিল সে! তারও কি তবে যুদ্ধে যাবার ইচ্ছে? এতক্ষণ পর এই প্রশ্ন জাগে হাফিজুরের মনে। কিন্তু কোথায় পাবে এ প্রশ্নের জবাব! যুদ্ধে যাবার প্রবল ইচ্ছে ছিল আরেকজনের। হাফিজুরের সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু অতীন। তার দু’চোখ জোড়া যুদ্ধের ঘোর। মুসলিম মেয়ের প্রেমে পড়েছে, দিনরাত সেই ধ্যানজ্ঞানে মগ্ন থাকার কথা, তা-ই থাকো; কী আশ্চর্য কথার ছিরি- নার্গিসকে পাবার জন্য তাকে যুদ্ধে যেতে হবে। বিশেষ করে সাতই মার্চের ভাষণ শোনার পর থেকে তার মাথার ভেতরে যুদ্ধভাবনা ছাড়া আর কিছুই নেই। যুদ্ধে সে যাবেই। যে কোনোদিন হাফিজুরের বাড়ি চলে আসবে। এখান থেকে এক লাফে বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়া। তারপর অস্ত্র হাতে ট্রেনিং। তারপর মরণাপন্ন যুদ্ধ। প্রয়োজনে গেরিলা কায়দার যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে বিজয়। তারপর আবার নার্গিসের হাতে হাত, সামনে নতুন পৃথিবী। হাফিজুরের ভাবনা হয়- অতীন কি যে কোনোদিন সত্যিই এখানে চলে আসবে? যে কোনোদিন মানে কী, সেই সময় কি এখনো হয়নি তার? বেশ হবে অতীন এলে, তার সঙ্গে হাফিজুরও চলে যাবে যুদ্ধে। মেহেরপুরে আনসার ব্যারাকে পৌঁছুনোর পর হাফিজুর অবাক হয়ে যায়। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা আনসার মুজাহিদের বিশাল বহর কাঁধে রাইফেল নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে কুচকাওয়াজ করছে। মাথার উপরে মার্চের কড়া রোদ। তার মধ্যেই চলছে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ। আনসার ইন্সট্রাক্টর আল আমিন দৃঢ় কণ্ঠে কমান্ড দিচ্ছেন। কখনো তার স্থানে আসছেন রহমতুল্লাহ খান সোনা, কখনো বা জহরুদ্দীন, রাহেন উদ্দীন। সবার চোখে-মুখে গভীর প্রত্যয়, প্রবল আত্মবিশ্বাস। সংখ্যায় এরা কতজন হতে পারে? দু’শ? তিনশ? কুষ্টিয়াকে দখলমুক্ত করতে এরাই যথেষ্ট? ইপিআর জওয়ানরাও তো আছে, তারা কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানতে পারে- তারা জড়ো হয়েছে উয়িং হেড কোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গায়। সেখান থেকেই ভাগ করে তাদের পাঠানো হবে বিভিন্ন দিকে। সহসা এসডিও সাহেবের জিপ এসে থামে আনসার ব্যারাকের সামনে। জিপ থেকে লাফিয়ে নামেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী। দ্রুত পায়ে গটমট করে এগিয়ে যান আনসারদের সামনে। তারা মার্চপাস্ট করে স্যালুট প্রদান করে। স্যালুট গ্রহণের পর তিনি আর বেশিক্ষণ দাঁড়ান না। হাতে খুব সময় কম। ভয়ানক ব্যস্ততা। ইন্সট্রাক্টর আল আমিনের সঙ্গে খাটো গলায় কী যেন পরামর্শ করেন, তারপরই রওনা হয়ে যান চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে। দূর থেকে এই সব কর্মকাণ্ড দেখে হাফিজুরের ভাবনা হয়- কুষ্টিয়া-অভিযান কি খুব শিগগিরই শুরু হয়ে যাবে? নূরু চাচার ভেতরে কি সেই জন্য এত তাড়া? আনসার ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসার পর একেবারে আকস্মিকভাবেই বাজারের মধ্যে দেখা হয়ে যায় বড় দুলাভাই আব্দুল গণি বিএসসির সঙ্গে। শালাবাবুর উপরে তার খুব রাগ এতদিনেও একবার তাদের বাড়ি যাওয়া হয়নি বলে। আজ কোনো কথাই শুনবে না, হাফিজুরকে ধরে নিয়ে যাবে বৈদ্যনাথতলায়। মা-বাবার দাহাই দিয়ে নিজেকে রক্ষার খুব চেষ্টা করে হাফিজুর। শেষে কথা দিতেই হয় দু’চার দিনের মধ্যে সে যাবে বড়বুকে দেখতে। আব্দুল গণি খুব মজা করে দোয়াজ মাস্টারের গল্প শোনায়, দোয়াজ স্যারের কথা মনে আছে হাফিজ? হাফিজুর হেসে বলে, মনে থাকবে না কেন? আব্বার বন্ধু যে! কী হয়েছে দোয়াজ চাচার? কী আর হবে! তার সেই বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি নিয়ে তিনি মহাব্যস্ত। ভালোই তো। দেশের কাজই তো করছেন। আব্দুল গণি সেই কাজের বিবরণ দিয়ে জানায়- ইপিআর সদস্যেরা চুয়াডাঙ্গা চলে যাবার পর তাদের ক্যাম্পের সামনে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে থাকনে দেয়াজউদ্দীন মাস্টার। ইন্ডিয়ার জনগণ, ব্যবসায়ী, ছাত্র শিক্ষক নানা রকম সাহায্য সামগ্রী দিতে আসে আমাদের যুদ্ধের জন্য দোয়াজ স্যার, আয়ুব হোসেন, রুস্তম আলীসহ সংগ্রাম কমিটির লোকজন সে সব জিনিস খাতায় লিখে রিসিভ করে এবং সন্ধ্যা বেলায় মেহেরপুরে পাঠিয়ে দেয়। এ খবর শোনার পর হাফিজুর বলে, আপনিও দোয়াজ চাচার সঙ্গে লেগে যান না দুলাভাই! আমিও বাড়ি গিয়ে ওই কাজে নেমে পড়ব। ইন্ডিয়ান সাহায্য না হোক, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ অনেক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সেগুলোই কন্ট্রোলরুমে এনে জমা দেব। তবু তো মনে হবে যুদ্ধের সঙ্গেই আছি।

এগার. যুদ্ধযাত্রা কীভাবে ২৮ তারিখেই? চারিদিকে সাজ সাজ রব। নানা রকম প্রস্তুতি চলছে তো চলছেই। আনসার-মুজাহিদ চলে গেছে একদিনের ট্রেনিংয়ে। ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের সীমান্ত চৌকি থেকে তুলে আনা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এরই মধ্যে কুষ্টিয়া দখলকারী শত্রুসৈন্যের অবস্থান সংখ্যা অস্ত্র-গোলাবারুদের পরিমাণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সেই অনুযায়ী ভেবেচিন্তে যুদ্ধের ছক সাজাচ্ছেন এবং সহঅধিনায়ক এ আর আজম চৌধুরীর সঙ্গে যুক্তি পরামর্শ করছেন, কুষ্টিয়া অভিযানের পূর্ণ নেতৃত্ব তাঁর হাতেই তুলে দিতে চান। হেড কোয়ার্টারে থেকে পুরো এলাকার উপরে নজরদারি করবেন তিনি নিজেই। যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দেবেন আজম চৌধুরী, পরিকল্পনা এ রকমই। ইপিআর আনসার মুজাহিদ পুলিশ সব মিলিয়ে যে সৈন্য সংখ্যা এবং যে সামান্য পরিমাণ থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও গোলাবারুদের মজুদ আছে, তাই দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত চৌকস সৈন্যদের মোকাবিলা করা যাবে কিনা সে ভাবনা একেবারে হয় না তা নয়। তবু বিশ্বস্ত সহকর্মী আজম চৌধুরীর কাঁধে থাবা দিয়ে তিনি গভীর আস্থার সঙ্গে বলে ওঠেন, শুধু থ্রি নট থ্রি রাইফেল নয়, আমার চূড়ান্ত হাতিয়ার যা পাকিস্তান সেনা বাহিনীরও নেই, তা হলো বাংলার স্বাধীনতাকামী আপামর জনসাধারণ। কুষ্টিয়া-অভিযানের পরিকল্পনাও সাজানো হয় জনগণকে সম্পৃক্ত করেই। ইপিআর-এর পূর্ব এক উইং সৈন্যের সঙ্গে যুক্ত হয় মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার আনসার মুজাহিদের। মাত্র একদিনের ট্রেনিংয়ে তাদের নিয়মিত যোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই মোট যোদ্ধাকে তিন ভাগ করে ত্রিমুখী আক্রমণ চালানো হবে। তাহলে আর প্রত্যেক ভাগে কয়জন যোদ্ধা হয়। এই সংখ্যাকে আড়াল করার জন্য অধিনায়ক অদ্ভুত এক কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। প্রতিটি ভাগেই সশস্ত্র যোদ্ধাদের পেছনে থাকবে পাঁচ সহস্রাধিক নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। তাদের কাজ হবে উচ্চস্বরে জয় বাংলা স্লোগান সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত করে তোলা। শত্রু সৈন্যের মনোবল ভেঙে দেয়া। শত্রুপক্ষ যেন প্রতিপক্ষের যোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা বুঝতে না পারে। এই বিভ্রান্তিটুকু তাদের মনে সৃষ্টি করাটাই জরুরি। হাতে যত বড় আগ্নেয়াস্ত্রই থাকুক, হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি তাদের মনে আতংকের সৃষ্টি করবে, তারা হতাশ হয়ে পড়বে, আর হতাশ যোদ্ধাকে দিয়ে কিছুতেই যুদ্ধজয় সম্ভব হবে না। তৌফিক এলাহী চৌধুরী গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়েন সাত সকালে। না, আজ আর চুয়াডাঙ্গা নয় তার গন্তব্য; শহর থেকে বেরিয়ে কলেজ রোড হয়ে ওয়াপদা মোড় থেকে এগিয়ে চলেন পূর্বদিকে। গোপালপুর মদনাডাঙ্গা আলমপুর গাঁড়াভেবে বাঁশবাড়িয়া গাংনী- কী যে ছবির মতো সবুজাভ সব গ্রামগুলো। মার্চের রোদে ধোয়া প্রগাঢ় সবুজ থেকে চোখ ফেরানো দায়। তৌফিক এলাহী গাংনী বাসস্ট্যান্ডে এসে একটু দাঁড়ান, বন্দুক বাহিনীর দুজন সদস্য ছুটে এসে স্যালুট জানায়। আনসার ইন্সট্রাক্টর কাশেম কোরেশী এগিয়ে এসে তার সঙ্গে একান্তে কী যেন আলাপ করেন, হিসাবউদ্দীনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে তিনি আবারও গাড়িতে উঠে বসেন। আরো পূর্বে, কোথায় যে তার গন্তব্য কে জানে! জোড়পুকুরিয়া গ্রামের স্বেচ্ছাসেবকেরা এসডিও সাহেবকে চিনতে না পেরে তাঁর গাড়ির গতি রোধ করে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে নেমে স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতা দেখে ধন্যবাদ জানান তিনি। তারপর আবারও পূর্ব মুখে রওনা দেন- তেরাইল বামুন্দি বাওট ছাতিয়ান আকবপুর খলিলাকুণ্ডি; এইখানে এসে থামতে হয়। ২৫ মার্চ গভীর রাতে স্থানীয় মানুষজন এখানকার কাঠের ব্রিজ ভেঙে কুষ্টিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। খবরটুকু জেনেছেন পরদিন ভোর বেলাতেই, কিন্তু সরেজমিন এদিকে আমার সময় হয়ে ওঠেনি। আজ এই চরম সংকটময় মুহূর্তে কেন এসেছেন মাথাভাঙ্গা নদীর পাড় পর্যন্ত, সে কথা কেউ জানে না। কাঠের ব্রিজের ভগ্নদশা দেখে তাঁর বুকের ভেতরে কে যেন অচেনা কণ্ঠে হা হা করে হেসে ওঠে। শূন্য প্রান্তরে সে হাসি ফিরে আসে বিদ্রুপ হয়ে। সূর্যখোলা থেকে বেরিয়ে নানান গ্রাম জনপদ ঘুরে ঘুরে হাফিজুর যখন গাংনী বাজারে এসে পৌঁছে তখন মধ্য দুপুর গড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গে ছিল সাহারবাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ছেলে খোকন। মেহেরপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। পাস করলেই ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হবে এই তার ইচ্ছে। রোভার স্কাউট করার সুবাদে হাফিজুরের সঙ্গে পরিচয়। ভীষণ গা-লাগা স্বভাব। হাফিজুর ইচ্ছে করেই গতকাল তাকে খবর পাঠিয়েছিল। হ্যাঁ, সাতসকালে তার পঞ্চাশ সিসি মোটরবাইক নিয়ে সূর্যখোলায় হাজির। হাফিজুর তাকে নিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য খাদ্য সংগ্রহে নেমে পড়ে। এমন একটি কাজ পেয়ে খোকন মহাখুশি। গ্রাম্য রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চলে তাদের চালডাল টাকা পয়সা সংগ্রহ অভিযান। দুপুর গড়িয়ে গেছে তবু ক্ষুধা ক্লান্তি নেই। বরং চোখেমুখে উপচে উঠে বিমল আনন্দ। সারা দিনের আয় উপার্জন কন্ট্রোর রুমে জমা দেয়ার কাজ শেষ হতেই কানে আসে সমুদ্রগর্জন স্লোগান- জয় বাংলা। খোকন এবং হাফিজুর ঘুরে তাকায়। পশ্চিম থেকে পুবে ধেয়ে আসছে মানবসমুদ্রের বিশাল প্রবাহ। ওরা কি তবে মেহেরপুর থেকে রওনা হয়েছে? কত দূর যাবে- কুষ্টিয়া? খোকনের চোখে বিস্ময়। এত বড় মিছিল? কন্ট্রোলরুম থেকে বেরিয়ে এসে রহমান মিয়া জানায়, মিছিল নয়, এ হচ্ছে যুদ্ধ যাত্রা। তা বটে। সামনের দিকে বেশ কিছু রাইফেলধারী মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে চলেছে। তারা নিশ্চয় যোদ্ধা। তাদের পেছনে অসংখ্য সাধারণ মানুষ চলেছে পায়ে পায়ে। কণ্ঠে তাদের বুক কাঁপানো স্লোগান। রাস্তার দু’পাশের অনেক মানুষ এসে মিশে যাচ্ছে মানবপ্রবাহে। খোকন এবং হাফিজুরও কখন অজান্তে শামিল হয়ে গেছে সেই স্রোতে। মাইলখানেক যাবার পর মোটরবাইকের কথা মনে তারা আবার ফিরে আসে গাংনীতে। বাজারে তখন সবার মুখে মুখে এই যুদ্ধ যাত্রার আলোচনা। এ বিষয়ে যার যেটুকু জানা আছে সেটুকুই মেলে ধরে সগৌরবে। এতদঞ্চলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নূরুল হক সাহেব এসে ধমকে ওঠেন। যুদ্ধ নিয়ে এত কথা কিসের, অ্যাঁ? তোমরা কী জানো যুদ্ধের? তাই তো, পাবলিক জানবে কী করে! তারা কি যুদ্ধ দেখেছে কখনো? হক সাহেব দেখেছেন নিকট থেকে। যৌবনের প্রারম্ভে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক। যুদ্ধ শেষে গ্রামে এসে হাই ইশকুল খুলেছেন, হেড মাস্টারি করেছেন দীর্ঘদিন, রাজনীতি করতে করতে নির্বাচিত হয়েছেন। মানুষ তাঁর কাছেই জানতে চায় বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা। সবার প্রশ্ন- যুদ্ধ কি তবে শুরু হয়ে গেল? তিনি জানান, যুদ্ধ শুরু হবে কাল রাতে। সকল দিকের প্রস্তুতি সারা হলে তারপর। সকল দিকের মানে? হ্যাঁ, কুষ্টিয়ায় শত্রুসৈন্যের উপরে আক্রমণ হবে তিন দিক থেকে। ত্রিমুখী। একযোগে তিন দিক থেকে? হ্যাঁ, সাঁড়াশি আক্রমণ নয়, এ হচ্ছে ত্রিশূল আক্রমণ। টের পাবে পাকসেনারা। (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App