×

সাময়িকী

প্রান্তিক গণমানুষের গল্পকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০১৯, ০৮:৫২ পিএম

প্রান্তিক গণমানুষের গল্পকার

প্রান্তিক মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা বেশি গল্পের কথামালাই তা বুঝিয়ে দেয়। তাই চারপাশের লুকিয়ে থাকা সমাজবাস্তবতাকে নিয়ত আত্মীয়ের মতো দরদি হয়ে তুলে ধরেন। কখনো সুতোয়, কখনো চিত্রে, কখনো শৈলীতে ঘটনাকে শব্দশৃঙ্খলে বেঁধে দেন।

প্রতিবাদী কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী মহাশ্বেতা দেবী। পড়াশুনা ইংরেজি সাহিত্যে। সুমিত্রা দেবী নামে ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছেন। অস্থির ও দুর্ভিক্ষকালে জীবনযুদ্ধের মুখোমুখি ছিলেন তিনি। জমিদার মহাজন ও দুর্নীতিগ্রস্ত অধিকারে ও প্রতিবাদী চরিত্রের মানুষটি সংসার জীবনেও ছিলেন আপসহীন। প্রথম জীবনে নাট্যব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্যকে বিয়ে করেন। পুত্রসন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য জন্মলাভ করে। আলাদা হয়ে দীর্ঘ বিরতির পর দ্বিতীয়বার অসিতগুপ্তকে সঙ্গী করে মনে করলেন জীবনের বাকি সময়টাও তার সাথে কাটিয়ে দেবেন কিন্তু সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হলো না। সম্পর্কের বাঁধন তৈরি হলো বাংলা সাহিত্যে। তাঁর প্রথম লেখা ঝাঁসির রাণী-(১৯৬৩)। হাজার চুরাশির মা উপন্যাসের কারণে পাঠকহৃদয়ে রয়ে গেলেন প্রসারিত জীবনের অধিকারী হিসেবে। লেখাকে পেশা করে ঐতিহাসিকতার মোড়কে লোকাচার সংস্কৃতি সমাজচিন্তা জীবনবাস্তবতা ও অর্থনীতির বৈচিত্র্যময়তাকে অনুষঙ্গ করে শিল্প-সাহিত্যে বহুমাত্রিক পথে পাড়ি দেন। ইতিহাস ও রাজনীতি দুটোকে গেঁথে প্রতিবাদী ও সংগ্রামশীল চরিত্রের সমাবেশ করলেও জীবন দর্শন ছিল প্রখর। সাহিত্যে ব্যাপ্তি থাকলেও গল্পে রয়েছে অন্যরকম জীবনজিজ্ঞাসা। সে কারণে কোনো কোনো গল্প পড়ে পাঠক মনে করে এগুলোই তার শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পের বিবরণে প্রান্তিক মানুষের চরিত্র নিখুঁতভাবে তুলে আনেন। তিনি মনে করেন পাঠকই তার বিচারক তাই সময়কে ধরেছেন। সমকালের শোষণ, অবিচার, স্বচক্ষে দেখা দৃশ্য ব্যাপক ও বিচিত্র ঘটনাকে অতীত ও বর্তমানের মানদণ্ডে একীভূত করে রৈখিকতা দাঁড় করেছেন। তিনি হেঁটেছেন দেখেছেন মননে ও কলমে উঠে এসেছে গল্পের শিরোনাম ও চরিত্রেরা। শ্রেষ্ঠ গল্পগ্রন্থের ভেতরের গল্পগুলো : চম্পা, পরম আত্মীয়, চিন্তা, ছায়াবাজি, সোনালী মাছ, দেওয়ানী খইমালা ও ঠাকুরবটের কাহিনী, শরীর, ধীবর, পিণ্ডদান, জল, রং নাম্বার, উর্বশী ও জনি, বায়েন, আজীর এবং স্তনদায়িনী প্রভৃতি। ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক থাকলেও চলমান সমাজ, রাজনীতি, নিপীড়ন সংকটের দিকেও প্রবল আগ্রহ রয়েছে। যা এ গল্পগুলোতে পরিদৃশ্যমান। ‘চম্পা’ গল্পে বুড়ো হরচান্দ সিং ১৮৩৭ সালে হুইলার সাহের ঘোড়া ছুট করতে গিয়ে পা জখম হয়। তার দয়াতেই রেজিমেন্ট রিসালা বাজারে ঘর নিয়ে শাকসবজি বেচার পারমিট নিয়েছে। হরচান্দের বাপ মা মরা নাতনি চম্পা। ব্রিজলালের সাথে চম্পাকে বিয়ে দিয়ে সংসারের বাঁধন তৈরি করেছে। তিনজন একসাথে বসবাস করে। চম্পা অসাধারণ চরিত্র। সে মেমসাহেবদের মন জয় করার কারণে স্নেহ আদর যত্নআত্তি বেশি এবং মাঝে মাঝে মেম সাহেবরা অনেককিছু দেয়। মেমসাহেবরা তার চলে যাওয়ার সময় তাকে জিজ্ঞাসা করে কী দিবে কিন্তু চম্পা সরলমনা হওয়ায় দামি কিছু আশা করে না। যা দেয় তাতেই খুশি তাই মেমসাহেবের ইচ্ছেমতো অল্প বয়সের রকেটটিই উপহার হিসেবে পায়। ব্রিজলালকে কর্মঠ চরিত্রবান মনে হয়, তার বেশভুষা দেখে পাড়ার লোকেরা অসন্তুষ্ট হলেও রামসহায় গলির মেয়েদের নজর পেরোনো দায়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলের চরিত্র হরচান্দ ব্রিজলাল ও চম্পা। তারা গরিব হলেও সততার স্পষ্টভাষ্য প্রকাশ করেছেন গল্পকার। মিথ্যা দায় ছাপিয়ে হরচান্দকে ফাঁসি দেয়া হলো। বুড়ো শেরিডান ভালোবেসে রকেট ও সেলাই বাক্স দিয়েছিল কিন্তু তার ভাতিজা তাকে লুটেরা বলেই স্বামী ও দাদা হরচান্দকে ফাঁসি দিলো। ইংরেজ ও কোম্পানির দ্বারা সাধারণ মানুষেরা কতটা বিপর্যস্ত ও অসহায় ছিলেন সে ইঙ্গিত দৃশ্যমান চম্পা গল্পে। বিষ মিশিয়ে সাহেবদের সায়েস্তা করতে গিয়ে ধরা পড়ে তাকেও জীবন বিসর্জন দিতে হয় ক্ষুদিরামের মতো। মৃত্যুসন্ধিক্ষণে তার কথা এরকম “Ñতোমাদের শাপ দিচ্ছি আমি... এর বিচার হবে... বিচার হবে... বিচার হবেÑ নয় তো মিথ্যে হয়ে যাবে জমানা। ধাক্কা দিতে থাকে দুজন সিপাহী। বিস্রস্ত চুল বাতাসে উড়ে ঝাপটায়। চোখে মুখে কপালে। প্রত্যেকের মুখ কিছুক্ষণ জ¦লন্ত দৃষ্টিতে দেখে সমস্ত জমায়েতটার প্রতি থুথু ফেলে চম্পা বলে সব বে হিম্মত, কাপুরুষ।” ‘পরম আত্মীয়’ গল্পে আত্মীয়তার বন্ধন ও স্বার্থচিন্তা প্রকাশ পেয়েছে। আত্মনির্ভরশীল হতে হলে পড়াশুনা ও পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রম সার্থকতার সোপান। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয় অবিনাশবাবু পরিশ্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং সমাজের মানুষের প্রতি দরদ দেখি যখন মণিকে তার ভাই বোনের প্রতি খেয়াল রাখা বিষয়ে বলছেন। আমরা উপলব্ধি করি কম্পিটিশনের যুগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা দুঃসাধ্য যা সমকালীনতা স্পর্শ করে কিন্তু মণির ক্ষেত্রে তাকে দেখি ভিন্ন চরিত্রে তাকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পেছনে ঘুরায় মণি তার চরিত্র দেখে চাকরি করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে। অবিনাশবাবু ও মণি চরিত্রের মাধ্যমে গল্পকার সমাজের বুকে রেখা এঁকে দেখালেন। স্বার্থমোহে মানুষ কতটা অন্ধ। অবিনাশবাবু মণিকে চাকরির লোভ দেখিয়ে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যস্ত হয়েছে এবং আর্থিকভাবে হঠাৎ সচ্ছল হওয়ায় তার মধ্যে বেহায়াপনা ও বিলাসিতা ভর করে। ডেলকার্নেগি রকফেলার জীবনকাহিনী বর্ণনা করে মণিকে নিজ পরিবার ও দায়িত্ব সচেতনতা সম্পর্কে অবহিত করেন। ডেল কার্নেগি আমেরিকান লেখক যিনি কৃষক সন্তান হয়েও কৃষকদের জন্য আত্মউন্নয়নমূলক বই লিখে আশার আলো দেখিয়েছেন। রকফেলার আমেরিকান বড় ব্যবসায়ী যিনি ৫০ টাকা কৃষককে ধার দিয়ে ৭% মুনাফা লাভ করে। মায়ের সাথে টার্কি পালন ও চকলেট বিক্রি করে টাকাগুলো পেয়েছেন। মুনাফা লাভের দক্ষতায় ধীরে ধীরে বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। গল্পকার ভ্যানগগের চিত্রশৈলী জানান দিলেন। ভ্যানগগ রং তুলির আঁচড়ে তৈরি করেন চিত্রশিল্প মানুষের মননে জায়গা করে হয়ে ওঠেন শিল্পকারিগর। জয়ামসি তার বাসায় ভ্যান গগের চিত্রের মেলবন্ধন করে সাজাতে ব্যস্ত। সফল মানুষ ও চিত্রশিল্পের সাথে গল্পকার শব্দ দিয়ে মানুষের জীবন এঁকে তিনি হয়ে উঠলেন শব্দশিল্পী। সমসাময়িক বিষয়কে উপজীব্য করে উত্তরণের পথে হাঁটলেন সমাজবাস্তবতার আদলে পাঠকেরা সতত মেলাতে ব্যস্ত। ‘ছায়াবাজি’ গল্পে অচেনা পরিবেশে হাওয়া বদলও মেধাবী বিজয়ের মৃত্যুর বর্ণনা এসেছে। দুটো শ্রেণি দেখাতে গিয়ে প্রান্তিক জনপদের দিকে ইঙ্গিত করে উচ্চশ্রেণি ও সাধারণ শ্রেণিকে তুলে ধরলেন। মেধাবী হলে বড়লোকের মেয়েরা হুমড়ি খায় কিন্তু বিজয় গরিব হলেও ব্যক্তিত্ব চেতনায় সুমহান। কারো ধার ধারে না সে যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই আগ্রহসহকারে করেছে। তাতে বেশ ফল লাভে সমর্থ হয়নি কারণ স্থিরতার অভাব ছিল। অভাব ট্যালেন্টারা স্বভাবত ভালো কিছু করতে পারে না উদাহরণ হিসেবে বিজয়। সে টেস্টে ফেল করলে তার বাবা মা মর্মাহত হন। সবার ধারণা বিজয় ভালো কিছু করে দেখাবে। বন্ধুরা তার পিছু নিলো। মেধাবী ছেলেদের পেছনে মেয়েরা হুমড়ি খায় মাধবীও তাই বিজয়ের পেছন নিয়েছে। বিজয় শান্ত স্বভাবের লম্বা ছেলে বিবাহিতা-অবিবাহিতা নারীরা তার পেছনে ঘুরঘুর করছে। সবার প্রশংসা শুনলে মানুষ নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করে বিজয়ও নিজেকে দেখছে সত্যিই কী অসাধারণ। তার বাবা মারা যায়। সংসারের কর্তা মারা গেলে সংসারের হাল কী হয় সবারই জানার কথা। বিজয়ের মা তাই সংসার ধরতে চাকরি খুঁজতে বলে। কুমুদ ও সুজন চাকরি নিলো বিজয় তত্ত্ব আবিষ্কারের বই লিখলে লতিফা বই প্রকাশ করে। বন্ধুরা নানা বিষয়ে তাকে উৎসাহ জোগায় কিন্তু সে স্থির নয় তার স্বভাব হলো যখন যেটা ভালো লাগে সেটাই করা। কবিতা ছবি বই লিখা প্রতিভাধর বিজয় সঠিক ব্যবহারের অভাবে কিছু করতে পারেনি। থিয়েটারের ট্রুপ ভেঙে মাসিক পত্রিকা বের করে। ধীরে ধীরে বয়স পেকে যাচ্ছে বন্ধু-বান্ধবদের ভালো কিছু হলেও বারবার কাজ বদলানোর কারণে তার ভালো কিছু মেলেনি। বন্ধু-বান্ধবরা তার সাথে পেরে না উঠলেও তাদের চেষ্টা অনেক দূরে নিয়ে যায়।

সুন্দর চেহারার বিজয় ফ্যাকাসে হলে অনাদি, অরুণ, প্রণব, তাচ্ছিল্য করে অথচ এক সময় সে তাদের পছন্দের লোক ছিল। সে বই লেখা, ছবি আঁকা, থিয়েটার তারপর মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে কিন্তু আর্থিকভাবেও সচ্ছল হলো না বয়স বেড়ে যাচ্ছে দিনদিন ভেতরের মানসিকতা দুর্বল হচ্ছে। জীবনে অনেককিছু করার ইচ্ছে চুপে গেল। মানুষ মূলত নতুনের সন্ধানে থাকে বিজয়ের পরিবর্তে তারাও নতুন প্রতিভা খোঁজে। তপন ও স্বাতীর প্রেম ও বিয়ের পর তপনের ভাই বলেছে বিয়ে না করলে অ্যাসাইলামে যেতে হবে। তার মনে হলো তার বয়স তেতাল্লিশ। এবার সে নিজেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন কিন্তু প্রচলিত কথা আছে সময়ের কাজ সময়ে করতে হয় নচেৎ পস্তাবে। গল্পকার লতিফা ও বিজয়ের মধ্যে আগে ও পরের ব্যবধান দেখান। বয়সের মারপ্যাঁচে কোমলতার বিপর্যয় লতিফার চিনতে না পারা। বিজয়ের আবেদন প্রেমানুভূতি ও বয়সের পর তাদের চিন্তা। অবহেলায় সুপ্রিয়াকে সুসময়ে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি। বিজয়বাবুকে জানান দিচ্ছে অবহেলার দিনগুলো। শেষ সময়ে মাধবীর সঙ্গে দেখা। যৌবনের ক্লান্তলগ্নে সুদানের তেলের খনিতে কাজ করছেন বিজয়। ওপরওয়ালার চায়ের নিমন্ত্রণে মাধবীর সাথে দেখা হলে দুজনেই অবাক হলেন ফিরে এলে সে জ্ঞান হারিয়ে মাঝ রাতে চোখ খুলে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে নিজের ছায়াকে সম্বোধন করে। কুমুদ ও বিজয়ের ট্রেনে ভ্রমণ এবং গতিবেগ জানতে চেয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি। বিজয় হয়তো জীবনে ভালো কিছু করতে চেয়েছেন কিন্তু প্রতিকূলতা তাকে দেয়নি। জীবনের গতিবেগ ও কিছু করার গতিবেগ দুটোকে মেলাতে না পেরে ট্রেনের গতিবেগের সাথে নিজেকে নিঃশেষ করে। তার মধ্যে হতাশা এবং শূন্যতা কাজ করেছে তাই সময়কে হারিয়ে বিষণ্নতায় ভোগে। মেধাবী ছেলেটি কাজে লাগানোর অভাবে অকালে ঝরে যায়। এমন ঝরে যাওয়ার গল্প আমরা প্রতিনিয়ত শুনি। গল্পকার সমকালীন সমাজ প্রেক্ষাপটকে তুলে আনেন বিজয় চরিত্রের মধ্য দিয়ে। যার জীবনে অনেক কিছু করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সময়কে অনুধাবন না করায় জীবন থেমে গিয়ে পারিবারিক শূন্যতা দেখা দেয়। কুমুদ ও বিজয়ের মধ্যে ভ্রাতৃৃত্ববোধ থাকলেও জীবন সংগ্রামে সে পরাজিত। বিজয় সমকালীন সমাজের প্রতিনিধি। গল্পকার আমি চরিত্রের অধিকারী তিনি স্বস্তির জন্য স্টেশনের পাশে চলে আসা। যা কারো জানার কথা না কিন্তু বিজয়ের মৃত্যুতে কুমুদের আগমনে তার সন্ধান মেলে। পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনার শিল্পাঞ্চলের দিকে সবার নজর। এখানে পরিচিত কেউ নেই তবুও ডাকছে বিজয়ের ভাই কুমুদ। অচেনা জায়গায় কুমুদের আগমনে সে হতচকিত। ডালহৌসিতে শেষ দেখা। নির্জন জায়গায় হঠাৎ কারো আগমন মোটেও স্বস্তিকর নয়। গল্পকার কুমুদ ও বিজয় চরিত্রের সাথে উচ্চশ্রেণির জমায়েত করে শ্রেণিবিন্যাসে মেধাবীদের হতাশা, যৌবনের অপচয়, উদাসীনতা, ব্যক্তিত্ববোধের কারণে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে জীবনের গতিবেগ থামিয়ে দেয়া সময়ের ঘটনাপ্রবাহ। গল্পকার গল্পে সময়কে অনুষঙ্গ করে অতীতের ব্যবস্থাকে ইঙ্গিত করেছেন। দেখছি হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেক যুবক-যুবতী আত্মহননের সিদ্ধান্তে অবিচল। সে হিসেবে গল্পকাররকে মনে হয় প্রান্তিক গণমানুষের জীবনশিল্পী। ‘সোনালী মাছ’ গল্পে প্রান্তিক চরিত্র অমল বসু। অমলের সাথে নেতার কথোপোকথন এবং সে সাধারণের হয়ে কথা বলছে। দল গোষ্ঠীর বাইরে থেকে নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। শঙ্কর ও বীণা চরিত্রে স্বপ্নের সার্থকতা, নীতিবোধ, বিশ্বাসঘাতকতা, ঠকবাজ বিষয়কে টেনে সুন্দর মনন গঠনের দিকে একীভূত হয়েছেন। নেতৃস্থানীয়দের প্রভাবে এবং প্রতাপে সমাজে মানুষ কীভাবে বৈষয়িক সমস্যায় পড়ে অমল ও তিনি ঝাউবনে এলে চৌবাচ্চায় মাছের ঘুরপাক তাকে বিষয়টি আরো ভাবিয়ে তোলে। বড় মাছ ছোট মাছগুলোকে তাড়া করে ছোটরা পালিয়ে বাঁচতে চায়। এ দৃশ্য মনে হচ্ছে নিপীড়নেরই দৃশ্য। লেখকের ভাষায় মারণনীতি। এই যে পরস্পরকে সংহার করার ইচ্ছাবোধ যা চলমান মানুষের মধ্যেও বেশি। ক্ষমতাবান, ঊর্ধ্বতন এবং উঁচুশ্রেণি ব্যক্তিবর্গ সাধারণ মানুষকে মানুষ মনে না করা। কেননা তারা নিজেদের স্বার্থমোহে কাতর। ‘শরীর’ গল্পে উঁচু-নীচু মানুষের প্রেমবোধ, পতিতাবৃত্তি শিক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। নৃপতিদের রক্ষিতার প্রয়োজন পড়ে সুন্দরের প্রতি ওদের খুব আকর্ষণ। নৃপতি বয়স্ক মানুষ মেয়ের ভেতরে যুবকের অপূর্ণতা দেখতে পায় উপজাতির মেয়ে খুনের দায়ে তার বাবা-মায়ের ফাঁসি হয়। সরকারি তত্ত্বাবধানেই বড় হয়েছে। এমের মাধ্যমে নৃপতির রক্ষিতা এবং চুরি করে জীবন নির্বাহ করে। শেষে ধরা পড়ে অধ্যাপককে বাঁচাতে গিয়ে। তার বাড়িতে মেয়েটি যেত অনুপমকে দেখার জন্য। অনুপমের প্রতি তার উদার ভালোবাসা ইচ্ছে অনুযায়ী ভালোবাসতে পারবে। অধ্যাপককে দেখলে অনুপমের কথা মনে পড়ে। মেয়েটির কাছে অনুপম এক সময় আশ্রয় প্রার্থনা করলে অনুপমকে নিজের ঘরে দিয়ে বাইরে ঘুমায়। দুপুরের পর অতনু এমসহ অনেকেই আসে। অনুপম তাকে জিজ্ঞাস করেছে কত টাকা পাবে। ফ্ল্যাটে আনন্দ আসরের সময়গুলোতে বিষ মিশিয়ে মারতে পারতো কিন্তু বাথরুমের দরজা বন্ধ করে গুলি দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়। নৃপতি আর এম আটতলা থেকে ফুটপাতে ভাঙাচোরা তার শরীর জানালার পাশে এবং আরেকটি মুখ দেখে জড়ো হয় শত শত মানুষ। সাধারণ মানুষ জগৎ জীবিকার তাড়নায় লাশ উত্তোলন করে। নেশা করলে আবার কাজে আগ্রহী হয়। ছেলে অভয় বাবাকে প্রশ্ন করেছে তার ভয় করে কিনা। জগতের কথা ভয় করে বলেই সে নেশা করে। সমাজপতিরা লাশ গুম করে জলে ফেলে রাখে জগতের মতো সাধারণ মানুষের কাজ জল থেকে লাশ তুলে দেয়া বিনিময়ে সামান্য প্রাপ্তি ঘটে কিন্তু মুখ খুলতে পারে না। লেখাপড়া করে কাজ জুটে না অভয়ের জগৎ মনে করে পড়াশুনো করলে কাজ পাওয়া যায়। সে তো বাবার মতো ওসব করতে পারে না। দারোগাবাবু অভয়কে দেখা করতে বললেও সে দেখা করে না কারণ কাজটি ছিল খোঁজখবর দেয়া। জগৎ না বুঝে ছেলেকে বললে ছেলে করপোরেশন এ নৃসিংহ দত্তকে বলে চাকরি দেয়ার কথা বলেছে কিন্তু দারোগাবাবু রাগ হয়ে বলেÑ ‘চাকরি গাছের ফল আঁকশি টানলে পড়বে’। মানুষ পাপী, মানুষ মানুষকে হত্যা করে। অভয়ের চাকরি হয়নি তাই জগৎই সংসারের অন্নদাতা। পড়ালেখা জানে না সাত টাকায় লাশ উঠানোই তার কাজ। পুকুরপাড়ে কালো গাড়ি পাশে মানুষের ভিড়, সে জলে নেমে ছয়টি লাশ তুলে আনে। জগৎ দারোগা নিষেধ অনুযায়ী লাশের খবর কাউকে দেয় না। আজ সে মদ খায় না তার ভেতরে অস্বস্তিবোধ। দারোগা অনেককে ধরে নেয় সে দলে অভয়ও ছিল কিন্তু অভয় ফিরেনি। দারোগাকে জিজ্ঞেস গল্প ক্ষুদ্র ঘটনার অনুষঙ্গ হলেও বাস্তবানুগ। নিম্নশ্রেণির মানুুষের জীবন-জীবিকা, হতাশা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, নিরুপায় মনোভাব তুলে আনতে গল্পকার মাটির কাছাকাছি মানুষের সঙ্গে মিশে আলংকারিক উপায়ে ঘটনা ব্যক্ত করেন। যারা প্রতিনিয়তই ক্ষমতাধরদের মোচড়ে ধলিত হয়। তাদের ভাষা, মনের কথা, চলনে বিধি আরোপিত। মোড়লরা যে দিকে হাত ঘুরায় সেদিকেই তাদের পথ। গল্পকার দুর্ভিক্ষের চিত্র, জমিদারী প্রথা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হত্যা খুন গুম, পেশাবৃত্তি এবং পতিতাবৃত্তির বর্ণনা করতে গিয়ে দুটো সমাজচিত্র এঁকেছেন উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। উচ্চশেণির হাতে নিম্নশ্রেণি কীভাবে পদলেহিত ও নিগৃহীত হচ্ছে তার বর্ণনায় অসাধারণ শিল্পচাপ লক্ষণীয়। প্রান্তিক মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা বেশি গল্পের কথামালাই তা বুঝিয়ে দেয়। তাই চারপাশের লুকিয়ে থাকা সমাজবাস্তবতাকে নিয়ত আত্মীয়ের মতো দরদি হয়ে তুলে ধরেন। কখনো সুতোয়, কখনো চিত্রে, কখনো শৈলীতে ঘটনাকে শব্দশৃঙ্খলে বেঁধে দেন। বর্ণনাকৌশল দেখে সহজেই অনুমেয় হয় এটি তার স্বতন্ত্র কথামালা। তিনি গল্পে যে শৈল্পিক চাপ রেখেছেন সমকালীন পাঠক ও সচেতন মহল এবং গবেষকরা জোর গলায় দাবি জানাবেন তিনি সমকালীন প্রান্তিক গণমানুষের গল্পকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App