×

সাময়িকী

অগ্রন্থিত রফিক আজাদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০১৯, ০৭:৫৪ পিএম

অগ্রন্থিত রফিক আজাদ

এই গ্রন্থটি পাঠ করলে যে কোনো পাঠক একজন রফিক আজাদকে আবিষ্কার করতে পারবেন তার কবিতার বাইরে অন্য আরেক তথা একজন মানুষ রফিক আজাদকে; দোষে, গুণে, নিয়মে, অনিয়মে, কাজে কর্মের প্রিয় কবিকে। যে কবি কবিতার বাইরেও সাধারণ জীবনের অনেক কিছুই গ্রহণ করেছেন, বর্জন করেছেন। মোট কথায় পাওয়া যাবে, একজন রফিক আজাদের সারাংশ, যা কাজে লাগতে পারে পরীক্ষায়-নিরীক্ষায়। রেফারেন্স হিসেবেও কাজে লাগতে পারে অনেকের।

ইদানীংকালে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস পাঠ করতে অনেক সময়ই ভালো লাগে না। জীবনের অমীমাংসিত সংলাপগুলো সমানে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিমায় অঙ্গভঙ্গি করে যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে সময়ের ঘুঙুর। ভালো লাগে না বলতে খারাপ লাগে এমন নয়। এমনিতেই কয়েকদিন পর পর একটু ভিন্ন কিছু পড়তে চায় মন বা ভিন্ন কিছু পড়তে ভালো লাগে, এই আরকি। কবিতাই বেশি পড়ি বিধায় মাঝে মাঝে মন বিশ্রাম চাইলে জীবনচরিত পড়তে ভালো লাগে। জীবনী পাঠে অন্য একরকম আনন্দ পাই। কারো ব্যক্তি-জীবন জানতে ইচ্ছা যেমন হয় তেমনি বিখ্যাতজনদের জীবনী পাঠে তাদের জীবনাদর্শ বিশ্লেষক, ব্যাখ্যা করে বোধের কোরক গ্রহণ করতে শান্তি বোধ করি। রচনা পাঠ থেকে অনেক সময় ব্যক্তিকে উদ্ধার করা যায় না। জীবনী থেকে পুরোটা না পারলেও অনেকটা পারা যায়। এ ছাড়া কারো লেখা পাঠের সাথে সাথে সেই লেখক-জীবন সম্পর্কে জানলে লেখাটা আত্মকন্দরে প্রবেশ করে অনুধাবনকে উন্নত করে বলে তা-ই করি। জীবনী পাঠের বিকল্প হিসেবে সাক্ষাৎকারও পড়ে কেন জানি তৃপ্তি পাই। এসবে একজন লেখকের বিশ্বাস ও মতাদর্শের ধারণা পাওয়া যায়। লেখকের ব্যাপারে জ্ঞানী হওয়া যায়। এটা যে কেবল লেখক মাত্রের বেলায়, এমন নয়। হতে পারে রাজনীতিবিদের, হতে পারে ব্যবসায়ীর, হতে পারে কোনো শিল্পীর, হতে পারে কোনো অভিনেতার, হতে পারে যে কোনো সাধারণ মানুষের বা একজন পাঠকেরও। খ্যাতনামাদের হলে ঝুলি ভারী হয়, অনেক কিছুর সাথে তার সম্পর্কে জানার পরিধি হৃদ্ধ হয়। অনেক সময় অধিত জ্ঞান কাজেও লাগে- জীবনে বা নিরিক্ষায়। সবচেয়ে বড় কথা, পাঠে যে আনন্দ তা আর অন্য কিছুতে তেমন পাওয়া যায় না, কারো কারো কাছে। পাঠে আনন্দ খোঁজা মানুষ আমি। সে আনন্দ খুঁজতে যেয়ে শব্দ শিল্পী ‘বঙ্গ রাখাল’ সম্পাদিত কবি রফিক আজাদের অগ্রন্থিত সাক্ষাৎকার নিয়ে গ্রন্থ ‘অগ্রন্থিত রফিক আজাদ’ হস্তগত হলো। বইটি হাতে নিয়ে পড়ি পড়ি করে হাতে থাকা ল্যাতিন আমেরিকান কবি ‘বিসেন্তে উইদোরো, হোর্সে লুইস বোরহেসে, নিকানোর পারা’র কবিতায় (বাংলা অনুবাদ) বুঁদ হওয়া থেকে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু রফিক আজাদের সাক্ষাৎকার! মনও আর সরিয়ে রাখা যাচ্ছিল না বিধায় কবিতার পাঠ শেষ করে শুরু করলাম ‘অগ্রন্থিত রফিক আজাদ’। শুরুতেই দেখলাম, অগ্রন্থিত তবে অপ্রকাশিত নয় সাক্ষাৎকারগুলো। কবি রফিক আজাদ জীবিতবস্থায় দীর্ঘ সময়ে নানান তরুণতুর্কী ও স্নেহভাজনেষুকে বিভিন্ন দৈনিকের প্রয়োজনে যে আলাপন অর্থাৎ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তার বেশ কয়েকটি সংগ্রহ করে বিচ্ছিন্নতার দুয়ার থেকে খুঁজে এনে সময়ের নবীন কবি ‘বঙ্গ রাখাল’র পরিশ্রান্ত ইচ্ছা, কবির প্রতি প্রেম ও দায়বোধ থেকে একটি গ্রন্থে আবদ্ধ করা হয়েছে যত্নের পালকে পরশ বুলিয়ে। কাজটি সহজ কিন্তু সহজ নয়। ...তবে এই আলাপনগুলোর কিছুটা ছাড়া-ছাড়াভাবে পূর্ব পাঠের অনুমান বলে হোঁচট খাইনি একটুও। কেননা, সম্পাদক বা প্রকাশক বইটিতে লুকোচুরির আশ্রয় নেননি অনেক কৌশলী লেখক, প্রকাশক, সংকলক বা সম্পদকের মতো। বইটির উপর-মলাটেই পরিষ্কার করে বড় হরফে লেখা আছে ‘সম্পাদিত’। তাতে বুঝি, তা কমন পড়তে পারে, নাও পড়তে পারে। কমন বা আনকমন যা-ই হোক রফিক আজাদের কথামালা একসাথে, এক মলাটে পাওয়া ও পড়া সে সহজ ভাগ্যের কথা নয়। জেনেশুনে পড়তে শুরু করি। ১১ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা-২০০৯’ উপলক্ষে তৎসময়ে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে আসীন থাকাবস্থায় দৈনিক ‘যুগান্তর’র পক্ষ থেকে ‘অর্জুন রামাই’র নেয়া কবি রফিক আজাদের সাক্ষাৎকারটির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে থাকি ‘অগ্রন্থিত রফিক আজাদ’-এ। জানা-অজানা কথাগুলো আবার ভাসতে থাকে চোখের আয়নায়। কবির কথাগুলো আবার জানি নতুন করে। ...পাঠ করি কবি, গল্পকার, প্রকাশক ‘চন্দন চৌধুরী ও ওমর শাদের’র নেয়া ‘অসম্ভবের পায়ে, চুনিয়া আমার অর্কেডিয়া, মৌলভীর মন ভালো নেই’ কাব্যগ্রন্থের স্রষ্টা ও বাংলা কবিতার সার্বভৌম কণ্ঠস্বর ‘রফিক আজাদ’র জীবন নিংড়ানো বয়ান। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকে ঘোরে কবির কথা। প্রশ্নকর্তার প্রশ্নে বেরিয়ে আসে কবির বলা, না বলা অনেক স্বর, সুর। আগ্রহ কমে না। বাড়ে। পরের বয়ানে যদি অন্য কিছু বলেন, আজো জানা হয়নি এমন কিছু যদি থেকে থাকে পরের সাক্ষাৎকারে! পৃষ্ঠা উল্টাই, পৃষ্ঠা শেষ হয়। একজনের আলাপ থেকে আরেকজনের আলাপ চলতে থাকে। জব্বার আল নাঈম, জাফর আহম্মেদ রাশেদ, বিমল গুহ, মৃধা আলাউদ্দিন, শিমুল সালাহ্উদ্দিন, শেখ মেহেদী হাসান, স্বকৃত নোমান, সালাম সালেহ উদ্দীনসহ সতের জনের নেয়া মোট সতেরটি সাক্ষাৎকার পাঠ করি একটানে, যা গ্রন্থিত হয়েছে ‘অগ্রন্থিত রফিক আজাদ’ গ্রন্থে। ষাটের দশকের অন্যতম এই কবি রফিক আজাদকে নিয়ে এই সাক্ষাৎকারগুলো তাঁর কোনো বইতে বা তাঁকে নিয়ে গ্রন্থিত কোনো বইতেও ঠাঁই পায়নি এর আগে। সম্পাদক ‘বঙ্গ রাখাল’ অত্যন্ত পরিশ্রম করে, কবে কোনো দৈনিকে কার সাথে কবির সাক্ষাৎকার হয়েছে সেসব খুঁজে খুঁজে বের করে লম্বা সময় ধরে দেখে-শুনে সাহিত্যের দায় থেকে দায়িত্ব মনে করে আদরের সাথে সম্পাদন করেছেন বক্তব্যগুলো। এতে একজন রফিক আজাদকে পাঠক যেমন পাবেন নতুন করে তেমনি পাবেন একসাথে। কবিতার ভেতর দিয়ে যে রফিক আজাদকে পাওয়া যায়, সতেরটি সাক্ষাৎকারে সেই কবি রফিক আজাদকে ব্যক্তিবিন্যাস রূপে পাওয়া যায় অন্য রকম এক আঙ্গিকে। এমন কথা সব অবলীলায় আলাপনে উঠে এসেছে যা কবিতায় বলেননি কোনো পয়ারে। এমন কথাগুলো হয়তো কবিতার শরীরে বলাও যায় না। চিরদিনই লেখকের লেখায় পাওয়া যায় চিন্তা-চেতনা স্বপ্নের স্ফটিক, সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায় সে লেখকের, লেখার পেছনের গল্প, সময়, যুদ্ধ আর ব্যক্তি লেখককে। সাক্ষাৎকার-ধরন যা হয়, যে গুণকণা মিলে একটি সাক্ষাৎকার সাহিত্য হয়ে ওঠে তার সবই সম্মিলিত হয়েছে ‘বঙ্গ রাখাল’র জোগাড় করা প্রতিটি সাক্ষাৎকারে। কয়েকটি আলাপনে একই কথা বারবার উঠে আসলেও, কয়েক আলাপনে দুর্বল প্রশ্নবাণ পরিলক্ষিত হলেও, কয়েকটি সাক্ষাৎকারে কবিকে খণ্ডিত করে বের করে আনা হয়েছে অখণ্ডিত অনেক কথা। মনে হয় এই গ্রন্থটি পাঠ করলে যে কোনো পাঠক একজন রফিক আজাদকে আবিষ্কার করতে পারবেন তার কবিতার বাইরে অন্য আরেক তথা একজন মানুষ রফিক আজাদকে; দোষে, গুণে, নিয়মে, অনিয়মে, কাজে কর্মের প্রিয় কবিকে। যে কবি কবিতার বাইরেও সাধারণ জীবনের অনেক কিছুই গ্রহণ করেছেন, বর্জন করেছেন। মোট কথায় পাওয়া যাবে, একজন রফিক আজাদের সারাংশ, যা কাজে লাগতে পারে পরীক্ষায়-নিরীক্ষায়। রেফারেন্স হিসেবেও কাজে লাগতে পারে অনেকের। কবির জমানো কথাগুলো পাওয়া যাবে একসাথে। কোনো পাঠক বইটি পাঠ করে পাঠানন্দ বৈ-কি মুখ ভার করার কোনো সুযোগ পাবেন-না বলে এই পাঠকের ধারণা। সম্পাদক ‘বঙ্গ রাখাল’র কাছে সাহিত্যের এমন কাজের আরো আরো প্রত্যাশা রেখে সবিশেষে বলতে চাই, বইটি কবি রফিক আজাদের কবি সত্তার পাশাপাশি-হাঁটা একটি জীবনচরিতও বটে, যা সাক্ষাৎকার আদলে বাঁধাই করা। ‘ভাত দে হারামজাদা’ খ্যাত কবি রফিক আজাদকে যারা হাতের কাছে রাখতে চান, তারা এই বইটি পাঠপর রাখতে পারেন সংগ্রহে।

গ্রন্থ : অগ্রন্থিত রফিক আজাদ। ধরন : সাক্ষাৎকার। সম্পাদনা : বঙ্গ রাখাল। প্রচ্ছদ : আল নোমান। প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি-২০১৯। প্রকাশনী : জেব্রা ক্রসিং। মূল্য : ৩৫০ টাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App