×

মুক্তচিন্তা

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০১৯, ০৯:০৭ পিএম

আমাদের দেশের কালো মশাগুলো কামড়ে দেয়ার আগে গুনগুনিয়ে গান শুনিয়ে জানিয়ে দিত- আমরা আসছি কামড়াতে। হতে পারে সেটি এডিস অথবা এনোফিলিস। আজকালকার মশাগুলো সাদা বর্ণের এবং গান না শুনিয়ে কখন যে কামড়ে দেয় সেটি বোঝার উপায় নেই- হেতু গতবছরে আমাকে ধরেছিল ডেঙ্গু জ¦রে। পুরো একটি পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। ঠোঁট ফেটে ঝরেছিল রক্ত। দীর্ঘদিন হাসপাতালে এবং গৃহে বন্দি ছিলাম।

স্কুলজীবনের শেষ দিকে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের টেক্সট বুক বোর্ড নবম এবং দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য, রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ও শরৎচন্দ্রের গল্প পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানি লেখকদেরও কয়েকটি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা পাঠ্য বইয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্ট মাস্টার’, প্রভাত কুমারের ‘ফুলের মূল্য’ এবং শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পটি আমাকে বারবার পড়তে হয়েছিল, কেননা বিলাসী গল্পটির সঙ্গে আমাদের স্কুলে যাওয়ার পথে যেসব কর্মকাণ্ড আমরা করতাম, সেটি যেন গল্পকার শরৎচন্দ্র দীর্ঘদিন আগেই তার অনুভবে এবং গল্পে সেভাবে এঁকেছিলেন, যেন তিনি আমাদেরই সহপাঠী ছিলেন। ধুলোর বৃষ্টি, লেখাপড়ায় অমনোযোগী এবং শিক্ষার দেবী সরস্বতীর কৃপা না পাওয়া- সব ছিল আমাদের জীবনে। বিলাসী গল্পের মূল চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় হলেও তাকে আমার মনে খুব বেশি আন্দোলিত করেনি। যখন গল্পকার (শরৎচন্দ্র) বলেন, ‘মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হইয়া, আমি সন্ন্যাসগিরি ছাড়িয়া দিলাম।’ লেখক সন্ন্যাসী হয়তো হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বনজঙ্গলের ভেতরে সাধুর বা সন্ন্যাসীর সঙ্গ ত্যাগ করলেন একমাত্র মশার কামড়ে। হয়তো তিনি একদিন সন্যাসী হয়ে গেরুয়া বসনে ফিরতেন জনসমক্ষে। তবে তিনি জনসমক্ষে ফিরলেন, গেরুয়া বসনের বদলে ধুতি পাঞ্জাবিতে। যদি আমরা আমাদের স্কুলজীবনে ওই বিলাসী গল্পটি না পড়তাম তাহলে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, মশার জ¦ালায় সেকালের এবং একালের জনগণ অতিষ্ঠ। শরৎচন্দ্রের একাধিক গল্প উপন্যাসে প্লেগ ও ম্যালেরিয়া, বসন্ত, কলেরা এমনকি শারীরিক অন্যান্য কথা থাকলেও মশাকে নিয়ে ওই একটি লেখাকে এখনো স্মরণ করি, কেননা মশা দ্বারা দেশের জনগণ এমনভাবে অত্যাচারিত যেন আমরা আবার ফিরে গেছি সেই ১৯৭১ সালের ভয়াবহ দিনগুলোর কাছে। সেকালের উল্লেখযোগ্য অসুখের প্রথম স্থান অধিকার করেছিল ওলাওঠা বা কলেরা, দ্বিতীয় স্থান ছিল প্লেগ, ম্যালেরিয়া বা কালাজ¦র। ম্যালেরিয়া নিয়ে আমাদের দোহারপাড়ার গণেশ পাল দীর্ঘদিন রোগ ভোগের মাঝখানে তারই এক নিকটাত্মীয় কলকাতায় নিয়ে গিয়েছেন, ডা. বিধানচন্দ্রের কাছে। ডা. বিধান সবিস্তারে সবকিছু জানার পরে গণেশ পালকে নাকি গোটা কয়েক কথা বলেছিলেন- পরবর্তীতে শুনেছিলাম আমাদের পিতার কাছ থেকে, (১) পাল বাবু আপনার বাড়ি সংলগ্ন কোনো ডোবা অথবা পুকুর আছে কিনা- হ্যাঁ আছে। (২) পুকুর পাড়ে নিম বা নিশিন্দা গাছ আছে কিনা- হ্যাঁ, দুটোই আছে। আপনার ম্যালেরিয়ায় অচিরেই ভালো হয়ে যাবে, যদি আপনি আমার কথাগুলো মনে রাখেন। (১) প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে এই পৌষের ঠাণ্ডা জলে আপনাকে স্নান করতে হবে। (২) প্রতি প্রত্যুষে কাঁচা লঙ্কা পিঁয়াজ আর বিনা লবণে খেতে হবে পান্তা ভাত। ডাক্তার বাবু একটু থেমে বললেন, বাড়িসংলগ্ন পুকুর বা ডোবার জলে অনেকক্ষণ থাকতে হবে, নিমের এবং নিশিন্দার পাতা নিশ্চয়ই পচে জলের বর্ণ হয়েছে পচা ডিমের মতো- সে যাত্রায় পাল বাবুকে কোনো ওষুধই নাকি দেননি, যখন গণেশ পাল আর তার সঙ্গী ফিরে আসছিলেন ডা. বিধান বলেছিলেন, ম্যালেরিয়া ভালো হলে আর আসবার দরকার নাই পাবনা থেকে। আর যদি ভালো না হয় আপনার ম্যালেরিয়া তারপরে দেব ওষুধ। এসবই আমাদের পিতার থেকে শুনলেও শুনিনি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের ইবোলার নাম। আমাদের দেশের কালো মশাগুলো কামড়ে দেয়ার আগে গুনগুনিয়ে গান শুনিয়ে জানিয়ে দিত- আমরা আসছি কামড়াতে। হতে পারে সেটি এডিস অথবা এনোফিলিস। আজকালকার মশাগুলো সাদা বর্ণের এবং গান না শুনিয়ে কখন যে কামড়ে দেয় সেটি বোঝার উপায় নেই- হেতু গতবছরে আমাকে ধরেছিল ডেঙ্গু জ¦রে। পুরো একটি পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। ঠোঁট ফেটে ঝরেছিল রক্ত। দীর্ঘদিন হাসপাতালে এবং গৃহে বন্দি ছিলাম। চিকুনগুনিয়া নামের আরেকটি অসুখে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে বেঁচে আছেন ঠিকই, তবে তিনি চলাফেরা করেন লাঠিনির্ভর হয়ে। এখনো শুনিনি ‘ইবোলা’ এসেছে বা হয়েছে কারো, তবে গণমাধ্যমের কল্যাণে জেনেছি ইবোলায় আক্রান্ত হলে, তার আর ধরাধামে ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায়শই থাকে না। সেকালের কলেরায়, বসন্তে অত্যধিক মানুষ মারা যেতেন, যেহেতু তখনকার দিনে উন্নত মানের ওষুধ ডাক্তার প্রায় ছিলেনই না। আমাদের পাবনা শহরে একমাত্র একজনই এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন আবু ইসহাক। আর সকলেই এলএমএফ, পরিতোষ সাহা, আবুল হোসেন, হারুন রশিদ এবং স্মৃতিকণা সাহা। হোমিওপ্যাথির প্রখ্যাত ডাক্তার ছিলেন শিশির রায়। তাদের কাছে নিশ্চয়ই রোগীরা যেতেন তবে কেউ চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু নিয়ে নয়। কেননা, সেকালে মশাবাহিত অসুখ বিসুখ কমই হতো। প্রতিটি গ্রামের বাড়িতে গরুর খাবার খড় পুড়িয়ে ধোঁয়া দিয়ে মশার অত্যাচার থেকে গরু এবং নিজেদের রক্ষা করতেন গ্রামবাসীরা। অপরদিকে হিন্দু পরিবারে সন্ধ্যে লাগার সঙ্গে সঙ্গে কাঁসর ঘণ্টা শিঙ্গা বাজিয়ে পূজা অর্চনা শেষ করার আগেই মন্দিরে এবং গৃহে জ¦ালিয়ে দিতেন সুগন্ধি ধূপ। ফলে মশাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতেন জনগণ। মুসলিম পরিবারে ধূপ জ¦ালালে অনেকে নিন্দাসূচক কথা বলতেন। তবু আমাদের বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় জ¦ালানো হতো ধূপ, বর্তমানে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব যেভাবে বেড়েছে সেটি অসহনীয়, অপরিকল্পনীয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে পাঠকরা জেনেছেন ডেঙ্গুর প্রভাব এবং তার বিস্তার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইতোমধ্যে মাননীয় হাইকোর্ট ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ও নিধনে অকার্যকর ওষুধ কেনা এবং সরবরাহে জড়িতদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে ঢাকা শহরের সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭,১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী, ইতোপূর্বে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি ছিল, ২৬৬ জন। এছাড়া সরকারি, আধা-সরকারি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বা ভর্তি হয়েছিল ১১০৩ জন। এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৩৯৫ জন রোগী। সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুর রোগীর সংখ্যা গত মঙ্গলবার ৪৭৩ জন। সরকারি তথ্যমতে এ বছর ৫ হাজার ১৬৬ জন মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত সংখ্যা হয়তো আরো বেশি হতে পারে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক। সরকারি হিসাবে ২০১৮ সালে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছে ২৮ জন। রাজধানীর বাইরের হাসপাতালগুলোর চিত্র আরো ভয়াবহ। সেখানে যথেষ্ট সেবার অভাব আছে। যদিও রোগীকে বা আত্মীয় স্বজনকে দিতে হচ্ছে টাকা, ২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছে ৯ জন। ২০১৮ সালে ২৬ জন। ব্যতিক্রম ২০১৭ সালের মৃত্যু তালিকায়। আর এ বছর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে আরো মারা গিয়েছে ডেঙ্গুতে ১০ জন। অন্য জেলায় বা উপজেলায় তথ্য আর জানা নেই। তবে গত ১৮ জুলাই ২০১৯ তারিখের একটি পত্রিকায় দেখলাম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি- উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকাস্থ প্রতিনিধি। প্রতিনিধি জানিয়েছেন ‘বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। তবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয় বলে মন্তব্য করেছেন- বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি (ভারপ্রাপ্ত)। এডউইন সালভাদর এডিস মশা নিয়ে এক আলোচনায় ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের বাস ভবনে গত ১৭ জুলাই এক বৈঠকে কথা বলেন। তিনিসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চারজন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। এডিস কিংবা এনোফিলিস মশা গল্পকার শরৎচন্দ্রকে কামড়ে ছিল কিনা, তিনি সেটা না জানালেও আমরা জানি, গ্রাম্য একটি প্রবাদের বা গানের দুটো চরণ। ‘সন্ধ্যা বেলায় ঘরে দিলাম ধুমা, মধ্যরাতে মশা এসে গালে দিল চুমা’।

মাকিদ হায়দার : কবি ও প্রাবন্ধিক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App