ডেঙ্গু ঠেকাতে নেই সমন্বিত প্রয়াস, দায় এড়ানোর চেষ্টা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০১৯, ১১:২০ এএম
দেশে ডেঙ্গুর আবির্ভাব ২০০০ সালে। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছিল সবাইকে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি করপোরেশন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন তখন এডিস মশা নির্মূলে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাৎক্ষণিক কিছু কার্যক্রম দেখা গেলেও গত দেড় যুগেও এ নিয়ে কোনো সমন্বিত উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। বলা যায়, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে এবং মশা নিধনে বিপুল কর্মযজ্ঞের হাঁকডাক থাকলেও তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। চলতি বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার ঘটনা সেই সত্যই সামনে এনেছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সাধারণ মানুষের অসচেতনতাই এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। এর জন্য সাধারণত মশা নিধন কার্যক্রমের স্থবিরতা, গাইডলাইনের অভাব এবং মানুষের অসচেতনতাই দায়ী। তবে সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরের স্থানীয় প্রশাসন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ কাজে তৎপর হওয়া, রাজধানী এবং জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় বিশেষ ব্যবস্থা রাখা দরকার বলে মনে করেন তারা।
সোমবার কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। সেবা না পেয়ে যেন কারো মৃত্যু না হয় এটাই স্বাস্থ্য বিভাগ নিশ্চিত করতে চায়। মন্ত্রী দাবি করেন, বন্যার কারণে এডিস মশা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই মশা উৎপাদন হয় এমন সবস্থানে স্প্রে করা হয়েছে, কিন্তু এটি যথেষ্ট ছিল না বলে মশা বেড়ে যায়।
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিকতা থাকলেও যারা এটি বাস্তবায়ন করবে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। মশা মারার নামে নিম্নমানের ওষুধ ব্যবহারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ওষুধ ছিটানোর কাজটি যেন সঠিক সময়ে হয় সে বিষয়ে কাউন্সিলদের নির্দেশ দিয়ে তা মনিটরিং করবেন মেয়র। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর নয়; এর আগেই মশা নিধনের কাজটি শুরু করতে হবে। মশা নিধন ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়।
সম্প্রতি সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম মশার ওষুধ সরবরাহকারী লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস নামের এক কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা জানান। কারণ, ওই কোম্পানির ওষুধ তিনবার ছিটিয়েও মশা নিধনে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন দাবি করেন, তারা নৌবাহিনীর সরবরাহকৃত ওষুধ ব্যবহার করেন। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমরা চাইলেই যখন তখন যেখানে সেখানে ওষুধ ছিটাতে পারি না। এর সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্য পরিবেশসহ আরো নানা বিষয় জড়িত আছে।
জানা যায়, মশা মারার উপযোগী ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। ব্যবহৃত ওষুধে কমপক্ষে ৮০ ভাগ মশা মরলে সেটিকে কার্যকর বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু ওই কোম্পানির দেয়া ওষুধে কাক্সিক্ষত পরিমাণ মশা মরেনি। একবার মরেছে ২ ভাগ, আরেকবার ১৮ ভাগ, তৃতীয় দফায় ৫০ ভাগ।
এ দিকে গতকাল অনুষ্ঠিত এক সভায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, ডেঙ্গু মশা উৎপাদনের স্থান ধ্বংস করতে নাগরিকদের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড ভিত্তিক কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা, ডেঙ্গুর টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ করা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য আইন বিশেষজ্ঞ এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম জানান, সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুসারে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন স্থল ধ্বংসে ব্যক্তির পাশাপাশি সংস্থাগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিত প্রথমে সব নাগরিকদের এবং ওয়ার্ডের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিজ নিজ আওতাধীন এলাকায় ডেঙ্গু মশা উৎপাদনের স্থান পরিষ্কারের নির্দেশ দেয়া। পাশাপাশি একটি মনিটরিং সেল স্থাপন করতে হবে, যেখানে নাগরিকরা ডেঙ্গু মশা উৎপাদনের স্থান সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবেন। যে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হবে তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুসারে অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ড, বা অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০২ সালে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ২৩২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। ২০১৬ সালে হঠাৎ করে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৬০ জনে বেড়ে যায়। সে বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। ২০১৭ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৭৬৯ জন ও মৃতের সংখ্যা ৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার এন্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের পয়লা জানুয়ারি থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৭ হাজার ৭৬৬ জন। গতকাল মঙ্গলবার দেশের ইতিহাসের রেকর্ড সংখ্যক রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৭৩ জন। সেই হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় ২০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সাব্রিনা ফ্লোরা ভোরের কাগজকে বলেন, শুরুর দিকে এ দেশের চিকিৎসকরা ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়াইয়ে একবারে অনভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু সে অবস্থা এখন বদলেছে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় একটি চিকিৎসা সহায়িকা তৈরি করা আছে। তা প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয়। এ বিষয়ে চিকিৎসকদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
এদিকে চলমান ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবে করণীয় বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গতকাল মঙ্গলবার এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে সভায় জরুরি ভিত্তিতে ডেঙ্গুর আধুনিক চিকিৎসা সংবলিত পকেট বুক ও ফ্লোচার্ট তৈরি করে সর্বস্তরের চিকিৎসক ও হাসপাতালসমূহে বিতরণ, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত নতুন প্রযুক্তি বাংলাদেশে প্রয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হেল্প ডেস্ক খোলা, সংক্রমক রোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়াসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়।