×

অর্থনীতি

সাত কারণে টানা ধস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০১৯, ১২:২৮ পিএম

সাত কারণে টানা ধস
দেশের পুঁজিবাজারে রক্তক্ষরণ থামছেই না। চলছে চরম অস্থিরতা। টানা দরপতন হয়ে উঠেছে এর নিত্যসঙ্গী। প্রায় প্রতিদিনই কমছে মূল্যসূচক। মাঝেমধ্যে নানা চেষ্টায় একটু বিরতি নিলেও তা একেবারেই সাময়িক। বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, ২০১০ সালের পর আবারো পড়তে শুরু করেছে বাজার। গত ৭ মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৯শ পয়েন্ট কমেছে। শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে গত ৭ কার্যদিবসেই সূচক কমেছে প্রায় ২শ পয়েন্ট। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আতঙ্ক ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে, তা কাটাতে না পারলে সূচক অনেক দূর নেমে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বর্তমান অবস্থার জন্য প্রধান ৭টি কারণকে দায়ী করেছেন। এগুলো হচ্ছে পিপলস লিজিং কেলেঙ্কারি, আর্থিক খাতের অস্থিরতা, বিএসইসি ও ডিএসইর দ্বন্দ্ব, ফোর্সড সেল, বোনাস লভ্যাংশে বিধিনিষেধ, মুদ্রানীতি ও কারসাজির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, কোন দিকে যাচ্ছে পুঁজিবাজার? সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ভাষ্য মতে, দেশের অর্থনীতি যেখানে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো অবস্থায় রয়েছে, প্রতি বছর বাড়ছে প্রবৃদ্ধি; সেখানে অর্থনীতির আয়না হিসেবে পরিচিত পুঁজিবাজারের ধস কেন থামছে না। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারের ধস রোধে গত কয়েক মাসে নানা সংস্কার হয়েছে। বিনিয়োগসীমা সংশোধন, প্লেসমেন্ট শেয়ারে লক-ইনের মেয়াদ বাড়ানো, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা বাড়ানো ও মিউচুয়াল ফান্ডের রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (আরআইইউ) বাতিল করা হয়েছে। সংশোধিত হয়েছে বিতর্কিত বুক বিল্ডিং পদ্ধতিও। তারপরও বাজারের পতন থামছে না। যদিও আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজারে আসা কোম্পানির মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। ডিএসইর সামনে কয়েকজন বিনিয়োগকারী বলেন, অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়ার কথা বলেছেন। এতে দুইবার বিপর্যয়ের শিকার হওয়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখতে পাননি তারা। আবার নতুন করে আস্থাহীনতায় ভুগছেন তারা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য দেয়া কিছু কিছু প্রণোদনাকে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাজেট পাসের পর থেকেই টানা পতন ঘটছে পুঁজিবাজারে। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের পুঁজিবাজার অত্যন্ত ভঙ্গুর, দুর্বল কিছু কোম্পানি নিয়ে গঠিত। সরকারি বা বড় কোনো কোম্পানিকে এখানে আনতে পারছে না। এ ছাড়া যে অনিয়মগুলো বিগত দিনে হয়েছে, দৃশ্যত তার কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এতে প্রতিদিনই আস্থার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আস্থাহীনতা পুঁজিবাজারে স্থান পেতে পারে না। সুতরাং আস্থা সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার সেই বিষয়গুলো দৃশ্যমান করতে হবে। এছাড়া পুঁজিবাজারের বড় জোগানদাতা হচ্ছে ব্যাংক। সেই ব্যাংকই আছে এখন ভঙ্গুর অবস্থায়। ঋণখেলাপিতে জর্জরিত ব্যাংক সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা কিভাবে ফেরাবে, সেটাও ভাবার বিষয়। অর্থাৎ বাজারে পুঁজি বিনিয়োগের যেমন সমস্যা রয়েছে; তেমনি বিনিয়োগ করার মতো পরিবেশ পরিস্থিতিও অনুপস্থিত। কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে ভালো রোল প্লে করতে পারছে না। এ থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে ভালো ভালো কোম্পানি আনতে হবে পুঁজিবাজারে। সরকারি যত ভালো ও বড় কোম্পানি আছে সেগুলোকে এখানে যুক্ত করতে হবে। এছাড়া আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, সার্বিকভাবেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। এ আস্থা ফিরিয়ে আনাই মূল বিষয়। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের ঋণ সরবরাহ কমে গেছে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী ঋণ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ঋণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফা কমবে। এছাড়া একটি লিজিং কোম্পানি অবসায়ন হচ্ছে। অন্য লিজিং কোম্পানিগুলোর অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। এসব বিষয় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিএসইসির সঙ্গে ডিএসইর দ্ব›দ্বও আরো একটি কারণ বলে মনে করেন এই অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, দাম নিয়ন্ত্রণ করা কমিশনের কাজ নয়। তাদের দেখার বিষয় হচ্ছে কোনো যোগসাজোশ হচ্ছে কিনা। এর বাইরে দাম উঠল কি কমল, সেটা দেখা বিএসইসির কাজ নয়। সমস্যা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মানসিকতা। কয়েকজন বিক্রি শুরু করলেই অন্যরা বিক্রি শুরু করে। বিনিয়োগকারীদের এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে, চলমান পরিস্থিতি ঠেকানো বেশ মুশকিল হবে। তাদের বিচার বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করতে হবে। এখন পুঁজিবাজার অবমূল্যায়িত। ফলে এখন বিনিয়োগের অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের বিনিয়োগকারীরা সেদিকে কেন এগোচ্ছে না, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আর কোনো একটি কোম্পানির ইস্যুতে সার্বিক বাজারে অনাস্থার সৃষ্টি হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। এদিকে দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই এমডিবিহীন কার্যক্রম চলছে। এটাও শেয়ারবাজার পতনের একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি। এ বি আজিজুল ইসলাম বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একজন এমডি আবশ্যক। আর তাকে অবশ্যই নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি হতে হবে। তাহলে তার পরিকল্পনার আলোকেই স্টক এক্সচেঞ্জের কাজ এগিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে কমিশনেরও তাকে সহযোগিতা করা উচিত। দেখা গেছে, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫৯৫০ পয়েন্ট। যা গতকাল সোমবার ২২ জুলাই কমে দাঁড়িয়েছে ৪৯৬৬ পয়েন্টে। অর্থাৎ ৬ মাসে সূচক কমেছে ৯৮৪ পয়েন্ট বা প্রায় ১৬ শতাংশ। এই পতনের ফলে সূচকটি বিগত আড়াই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। আর এই পতনের কারণ অনুসন্ধানে গত রবিবার ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ এন্ড কমিশন (বিএসইসি)। একই পরিস্থিতি অন্য শেয়ারমার্কেট চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। এদিকে দুইদিন বিরতির পর দরপতনের প্রতিবাদে আবার বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সোমবার দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ডিএসইসির সামনে এ বিক্ষোভ হয়। এ সময় বিনিয়োগকারীরা বলেন, বাজারে ফোর্সড সেল অব্যাহত রয়েছে। এটি বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে বাজারে কারসাজি চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে তারা দাবি করেন। তারা বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা মনে করছেন প্রতিনিয়ত বাজার আরো খারাপের দিকে যাবে। এজন্যই তারা বাজার থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি একটি কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিয়ে বিএসইসি ও ডিএসই কর্তৃপক্ষ দুই মেরুতে অবস্থান করছে। যা আরও ফুটে উঠেছে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পুনঃনিয়োগ ঝুলিয়ে রাখার মাধ্যমে। গত মে মাসে কেএএম মাজেদুর রহমানকে ডিএসইর এমডি হিসেবে পুনঃনিয়োগের বিষয়ে অনুমতি চেয়ে বিএসইসিকে চিঠি দেয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর দেয়নি বিএসইসি। এরইমধ্যে গত ১১ জুলাই ডিএসই থেকে বিদায় নিয়েছেন মাজেদুর রহমান। তবে কমিশনের কোনো জবাব না পাওয়ায় মাজেদুর রহমানকে পুনঃনিয়োগ বা নতুন এমডির খোঁজে বিজ্ঞপ্তি দিতে পারছে না ডিএসই কর্তৃপক্ষ। প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালের পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের পর বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরতে এক যুগেরও বেশি সময় লেগেছে। এর পর আবার বিপর্যয় ঘটে ২০১০ সালে। ২০১০ সালের বিপর্যয়ের পর নতুন গঠিত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ তিন মাসের মধ্যে বাজার পরিস্থিতির উন্নতির ওয়াদা করে সংস্থাটির দায়িত্ব নিলেও গত আট বছরে এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের আশঙ্কা আগের বিপর্যয়গুলোর সময় পুঁজিবাজারের যে আকার ছিল এখন তার চেয়ে অনেক বড়। সুতরাং আবার যদি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে পুঁজিবাজার, তাতে লোকসান যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে লোকসানের শিকার বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App