×

মুক্তচিন্তা

আসছে নতুন মুদ্রানীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০১৯, ০৯:৩০ পিএম

বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার তার নিকট প্রতিবেশীগুলোর তুলনায় একটি স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি ধরে রাখতে পেরেছে, যা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ থেকে উঠে এসেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রথমার্ধের ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে এই সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পূর্বে ঘোষিত বিষয়গুলোর প্রতি নির্দেশনা থাকা উচিত।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাক্সিক্ষত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বাজারে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ সম্পর্কে একটি আগাম ধারণা দিতে প্রতি ছয় মাস অন্তর মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যুরোর তথ্য মতে সদ্য শেষ হওয়া (২০১৮-১৯) অর্থবছরে প্রথমবার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অর্জিত হয়েছে ৮.৩ শতাংশ এবং চলতি বছর (২০১৯-২০) সদ্য ঘোষিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮.৫ শতাংশ। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৮-১৯) মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫.৬ শতাংশ, যদিও বছর শেষে মূল্যস্ফীতির সার্বিক গড় দাঁড়ায় টার্গেটের চেয়েও কম অর্থাৎ ৫.৪৭ শতাংশ। এখানে আরো উল্লেখ্য, গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল মে মাসে (৫.৬৩ শতাংশ)। বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় বাজেটে ঘোষিত দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করে থাকে, যা একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং তারই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে দুবার (জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথমার্ধের জুলাই-ডিসেম্বরের মুদ্রানীতি প্রণয়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং বর্তমানে মাসের শেষ সপ্তাহে তা ঘোষণা কথা রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের নিয়ে অন্যবারের মতো এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে মুদ্রানীতির দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণের জন্য। কারণ ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত তারল্য না থাকায় ঋণপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা রয়েই যাবে। এর কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে ব্যাংকগুলোতে ঋণ ও আমানত (এসডিআর) অনুপাত অনুকূলে না থাকায় মূলধন ঘাটতি বিদ্যমান এবং খেলাপি ঋণ যার পরিমাণ গত মার্চ পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা দেশে মোট বিনিয়োগের প্রায় ১২ শতাংশ, যা এই পরিস্থিতিকে আরো উৎসাহিত করে চলছে। সরকার এ ব্যাপারে পরিস্থিতির উন্নতির চেষ্টা চালাচ্ছে এবং এর মধ্যে ঘোষণাও আসছে যে শতকরা ২ ভাগ টাকা পরিশোধ করে ১০ বছরের মতো ঋণ পরিশোধ সুযোগ পাবে ঋণখেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদে যদিও এই সময়ে তারা কোনো নতুন ঋণ নিতে পারবে না। এসব কারণে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, যা গত মে পর্যন্ত ছিল ১২.১৬ শতাংশ এবং আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ওপর ঋণ সঞ্চয় (এডিআর) অনুপাত সমন্বয়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর একটি চাপ অব্যাহত থাকবে বিধায় আগামী ছয় মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ খুব একটা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন না এই ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা। এ অবস্থার বিবেচনায় চলতি মাসের শেষে ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন বাস্তবতার নিরিখে, যা বাস্তবায়নযোগ্য হবে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বেসরকারি ঋণপ্রবাহ কমিয়ে ধরলে সরকারের প্রক্ষেপিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে কিনা যে বিষয়ে তক-বিতর্ক রয়েছে। কারণ চলতি মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা গড়ে ১৬ শতাংশ কিন্তু প্রকৃত অর্জন ১৩ শতাংশ কম হতে পারে, যার জোগান দিয়ে এবার ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। তাই নতুন মুদ্রানীতিতে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে রাখলেও ৮ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ কমলেও সরকারি বিনিয়োগ বাড়বে বিশেষত পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের কারণে। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কম, যা দিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কর্মসংস্থান বিহীন প্রবৃদ্ধির। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮৮৮ মার্কিন ডলার হলেও দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের ওপরে রয়েছে, যা দিনে দিনে বৃদ্ধির প্রবণতা বিদ্যমান। বাংলাদেশ আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল বা মধ্যআয়ের দেশে যাওয়ার পথে রয়েছে যেখানে জিডিপিতে বিনিয়োগের হার হতে হবে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাধ্যতামূলক, যা বর্তমানে রয়েছে ৩২ শতাংশ। এ বিষয়টি অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিবেচনায় রেখে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করবে, যা বাস্তবায়নযোগ্য। প্রতি বছরই যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয় তার বৈশিষ্ট্যগুলো অভিন্ন ও গতানুগতিক বলে মনে হয় যেমন বেসরকারি-সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির হার, সুদের হার, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাজার শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যের বাস্তবায়ন কতটুকু কীভাবে সংঘটিত হচ্ছে বা হবে তার কোনো বিশ্লেষণ বিগত মুদ্রানীতির ঘোষণা পত্রগুলোতে উল্লেখিত হয়নি। যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার গতানুগতিক ছক থেকে বেরিয়ে আসার যে প্রচেষ্টা তা পরিলক্ষিত হওয়ার সময় এসেছে। মুদ্রানীতির বিশ্লেষক গণতাত্ত্বিকভাবে (ঃযবড়ৎবঃরপধষ) বলছেন, মুদ্রানীতি হলো কতগুলো আইনকানুন (ৎঁষবং ধহফ ৎবমঁষধঃরড়হং), যা দিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় কতগুলো পূর্বে নিধারিত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য, যা বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-এর দলিলে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে মুদ্রা চালু, টাকার মূল্যমান নির্ধারণ, অন্য মুদ্রার বিপরীতে আর্থিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশ উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি নির্দেশনা আসে সিআরআর ১ শতাংশ কমিয়ে আনার জন্য বিশেষত বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। এতে করে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ব্যাংকারদের কাছে চলে আসে। এর পরপরই মিডিয়াতে প্রশ্ন রাখা হলো নির্বাচনের আগে এই বাড়তি অর্থ সরবরাহ অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেনইবা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল এই সিদ্ধান্ত পালনে। এ ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ ও সুশাসন আগামী মুদ্রানীতি বিশ্লেষণের দাবি রাখে; তৃতীয়ত, বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে বিনিয়োগবান্ধব ব্যবসার পরিবেশের র‌্যাংকিংয়ে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪। এতে করে বিনিয়োগের দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি খেলাপি ঋণের কারণে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী বিধায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল ব্যাংক হার কমানো। কিন্তু দীর্র্ঘদিন ধরে এটি ৫%-এর মধ্যে অপরিবর্তিত রয়েছে। আগামী মুদ্রানীতিতে ব্যাংক হার অর্থাৎ রেপো ও বিভার্স রেপো সুদের হার কমিয়ে আনার প্রস্তাব থাকবে। কারণ নীতি সুদের হার কমলে ব্যাংকের লেনদেনের খরচ কমবে এবং আরো কম সুদে ব্যাংকগুলো ঋণের জোগান দিতে পারবে। ব্যবসায়ীসহ সমাজের অন্য উদ্যোক্তারা আরো বিনিয়োগের প্রতি উৎসাহিত হতে পারবে এবং কোনো কোনো ব্যাংকের অধিক তারল্যের সমস্যা দূর হতে পারবে; চতুর্থত, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নের হার শতকরা ৯৪ ভাগ, যা খুবই আশাপ্রদ যার ভেতর দিয়ে সরকারি খাতের বিনিয়োগের একটি চিত্র পাওয়া যায়, যদিও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম হলেও এটা বলা যায় যে দেশে বিনিয়োগ থেমে নেই। স্থির বাজার মূল্যে বিগত তিন বছরে সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রতি বছরে গড় ১৪ শতাংশ হারে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬.৯৩ শতাংশ হারে, যা অবশ্যই বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালো করছে তার সূচকের মানদণ্ডে বিধায় এখনই প্রকৃত সময় প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, সঞ্চয়, মাথাপিছু আয়, কর আদায় ইত্যাদির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে নির্ধারিত করা, যার নির্দেশনা আগামী মুদ্রানীতিতে আসা উচিত; পঞ্চমত, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতিনির্ধারণী বিষয় যেমন- খেলাপি ঋণ, ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা, পুঁজিবাজার ও বন্ড মার্কেট উন্নয়ন, পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদান, শেয়ারবাজারে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর অন্তর্ভুক্তিকরণ, প্রযুক্তিনির্ভর গ্রিন হাউসভিত্তিক বাণিজ্যিক কৃষি খামার প্রতিষ্ঠায় ঋণ কর্মসূচি প্রচলন, কৃষি ও পল্লী অর্থনীতিতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো ইত্যাদি বিষয় আগামী মুদ্রানীতিতে ঘোষণা সংযোজন হতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার তার নিকট প্রতিবেশীগুলোর তুলনায় একটি স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি ধরে রাখতে পেরেছে, যা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ থেকে উঠে এসেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রথমার্ধের ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে এই সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পূর্বে ঘোষিত বিষয়গুলোর প্রতি নির্দেশনা থাকা উচিত।

ড. মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App