×

জাতীয়

মাথাকাটা গুজব রটিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০১৯, ১১:০৫ এএম

মাথাকাটা গুজব রটিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কারা
দেশের গৌরব পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে’ এমন মিথ্যা গুজব রটিয়ে সমাজে ভয়ানক আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে একটি চক্র। কয়েক যুগ আগে বড় বড় পুকুর ও দিঘি খননের সময় এরকম কিছু গুজব ছড়াত নানা অঞ্চলে। কিন্তু কখনোই এসবের কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গত ২০-৩০ বছরে দেশে আর এ ধরনের গুজব ছড়ায়নি। তবে হঠাৎ করেই পদ্মা সেতু ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগার গুজব। আর তা বিশ্বাসও করছেন অনেকে। ফলে ছেলেধরা, কল্লাকাটা, মাথাকাটা, গলাকাটাসহ স্থানীয় প্রচলিত ভীতিকর নানা ভাষায় মিথ্যা-বানোয়াট কথা প্রচার পাওয়ায় সর্বত্র আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। অনেক স্থানে আতঙ্ক থেকে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গুজব ছড়িয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে। এরইমধ্যে ‘মাথাকাটা চক্রের সদস্য’ সন্দেহে গণপিটুনির স্বীকার হয়ে বেশ কয়েকজন নিহত ও আহত হয়েছেন। কিন্তু কাদের ইন্ধনে এ ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছে সে বিষয়ে এখনো স্পষ্টভাবে কিছু জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে, এ ধরনের গুজবে কাউকে বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এমনকি গুজবে উৎসাহিত হয়ে কেউ গণপিটুনিতে জড়িয়ে থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনার হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও গুজব প্রতিরোধে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ও র‌্যাবের একাধিক টিম। এরইমধ্যে র‌্যাব ও পুলিশের হাতে আটক হয়েছে গুজব রটানো চক্রের ২০ জন। তবে, জিজ্ঞাসাবাদে তারা কেউই সুনির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য দিতে পারেনি বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজন গণপিটুনির শিকার হয়েছে। এমনকি হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হয়েছেন কয়েকজন। সর্বশেষ গতকাল শনিবার একদিনেই পৃথক ঘটনায় ৩ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছে। গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার কাঁচাবাজারের সড়কে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক নারীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে বিক্ষুব্ধ জনতা। পরে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বাড্ডা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, উত্তর বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা পাশাপাশি। সেখানে শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনজন বোরকা পরিহিত নারী যান। তারা স্কুলের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। বাধার মুখে দুজন পালিয়ে গেলেও আরেকজন গণপিটুনির শিকার হন। একইদিন সকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পৃথক ঘটনায় একজন নিহত ও একজন আহত হয়। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মীর শাহিন শাহ পারভেজ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, গতকাল সকাল ৮টার দিকে মিজমিজির আল আমিন নগর এলাকার রাজমিস্ত্রি সোহেলের মেয়ে সাদিয়া (৭) স্কুলে যাওয়ার পথে এক যুবক তাকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এসময় স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ হলে তারা যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। একপর্যায়ে সে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে ও পালানোর চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় জনতা উত্তেজিত হয়ে তাকে গণপিটুনি দিলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পাঠালে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত বলে ঘোষণা করেন। এ ছাড়া সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি নতুন মহল্লার শাপলা চত্বর এলাকায় ইতালি প্রবাসী বিল্লালের বাড়ির চার তলায় খাদিজার ফ্ল্যাটে রেশমা নামে এক নারী বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে নাদিম (৩) নামের এক শিশুকে পুতুল দেয়। এতে পরিবারের লোকজনের সন্দেহ হলে তাকে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে স্থানীয়দের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এদিকে গতকাল কেরানীগঞ্জের হজরতপুর ইউনিয়নে ছেলেধরা সন্দেহে ২ যুবককে গণধোলাই দিয়েছে এলাকাবাসী। এতে অজ্ঞাতনামা (২৮) এক যুবক নিহত ও আজিজ (২২) নামে অপর এক যুবক আহত হয়েছে। নিহতের লাশ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে ও আহত যুবককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছে। নিহত ও আহত যুবককে রোহিঙ্গা হিসেবে সন্দেহ করা হলেও নিশ্চিত পরিচয় জানাতে পারেনি পুলিশ। অন্যদিকে বিকেলে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। গণপিটুনিতে আহত ওই নারীর নাম মমতাজ খাতুন। তিনি নেত্রকোনার দুর্গাপুর এলাকার আবদুল আলিমের স্ত্রী। পুলিশের দাবি, গণপিটুনির শিকার ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন। গাজীপুরের বাসন থানার ওসি এ কে এম কাউসার জানান, এক দম্পতির সন্তানকে আদর করতে গিয়ে গণপিটুনির স্বীকার হন মমতাজ খাতুন। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা শুধু রাজধানী বা আশপাশের জেলাতেই সীমাবদ্ধ নেই। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এরকম ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে পাবনা জেলার চাটমোহরে উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের বনগ্রাম বাজার এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে রাসেল রানা (৩২) নামে এক যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছেন এলাকাবাসী। স্থানীয়রা জানান, বনগ্রাম দিঘিপাড়া গ্রামের নায়েব আলির ছেলে মো. আবদুল্লাহ (৪) বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে বসে খেলছিল। এ সময় রাসেল রানা নামে ওই যুবক শিশুটিকে ডেকে চুইংগাম দেয়ার চেষ্টা করে। তবে চুইংগাম না নিয়ে আবদুল্লাহ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে তার হাত ধরে রাসেল হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটি বাটালি (কাঠমিস্ত্রিদের কাজে ব্যবহৃত) বের করে শিশুটির পিঠে আঘাত করে। শিশুটির চিৎকারে স্থানীয়রা এসে রাসেলকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে খবর দেন। এদিকে গুজবের বিষয়ে গতকাল শনিবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের সামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো নিহতের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ প্রত্যেকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন। র‌্যাব সদর দপ্তরের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেনেন্ট কর্নেল এমরানুল হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, গুজব প্রতিরোধে র‌্যাব সবসময় তৎপর রয়েছে। মাথা কাটা গুজব প্রতিরোধেও কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১২ জনকে আটক করেছে র‌্যাব। পুলিশের হাতেও আটক হয়েছে কয়েকজন। গুজব রটনাকারীদের গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে র‌্যাব। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যারা আটক হয়েছে তারা ফেসবুকে পেয়ে শেয়ার করেছে বলে জানিয়েছে। তবে, এ পেছনে মূল হোতাদের এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। আমরা চেষ্টা করছি। যেভাবে গুজব ছড়াল : ২০১৫ সালের ১ মার্চ নদীতে পশুর রক্ত ঢেলে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপন কাজের উদ্বোধন করে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তখন গণমাধ্যমেও এনিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময়ের রক্তের ছবি এখন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে একটি মহল। অসাধু ফেসবুক ব্যবহারকারীরা মূল তথ্য আড়াল করে পুরনো সেই ছবিকে মানুষের রক্তের ছবি বলে চালানো হচ্ছে। আর এতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App