×

জাতীয়

চরম দুর্ভোগে বন্যার্তরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০১৯, ১২:৪৯ পিএম

চরম দুর্ভোগে বন্যার্তরা
দেশের মধ্যাঞ্চলে দ্রুত পানি বাড়ছে। পাশাপাশি অন্যান্য স্থানেও বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অববাহিকায় বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে নদনদীর পানি। এদিকে, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। নদনদীর পানি দুই সপ্তাহ ধরে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গাইবান্ধায় বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যমুনার পানিতে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কুড়িগ্রামে নদনদীর পানি দেড় সপ্তাহ ধরে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে। সরকারি তথ্যমতেই জেলার ৯ উপজেলার ৭৩ ইউনিয়নের মধ্যে ৫৬ ইউনিয়নের ৪৯৮টি গ্রামের সোয়া ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। চলছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, জিঞ্জিরামসহ উত্তরের বেশির ভাগ নদনদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সড়কে পানি ওঠায় নাগেশ্বরী, চিলমারী, ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বানের পানিতে বাস্তুভিটা হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভবঘুরে জীবনযাপন করছে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার হাজারো পরিবার। চোখের সামনে বানের পানি বাড়ছে। এ ব্যাপারে উপজেলার শ্যামলী বলেন, ‘রাইতে হঠাৎ ঘরত পানি উঠি সউক ভিজি গেইছে। সড়কত উঠছি, এটিইয়ো পানি। কই যায়া আশ্রয় নেই! সকাল থাকি কোনও দানা পেটত যায় নাই। এখনা শুকনা খাবার দিলে খাবার পাইলং হয়!’ ঘরের ভেতর কোমর সমান উচ্চতায় পানি থাকায় রান্না করতে পারছেন না উপজেলার বালাবাড়ি এলাকা সংলগ্ন পানফুল বেওয়া, বিবিজান বেওয়াসহ রমনা বাঁধে আশ্রয় নেয়া কয়েকটি পরিবার। তাদের পানিবন্দি অবস্থার ছবি তুলতে গেলে পানফুল বেওয়া বলেন, ‘ছবি তুলি কী করবেন, হামাক এখনা শুকনা খাবার দ্যাও।’ বানভাসিরা জানান, তাদের ঘরে চাল রয়েছে কিন্তু সেই চাল রান্না করার জায়গা এবং শুকনো জ্বালানি নেই। তাই ভাত-তরকারি রান্না করতে পারছেন না। দোকান থেকে কিছু কিনে খাবেন, সে টাকাও তাদের কাছে নেই। যারা একটু উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে ঘরে থাকা চাল রান্না করছেন, তাদের অনেকে আবার টাকার অভাবে তরকারির সংস্থান করতে পারছেন না। পাচ্ছেন না বিশুদ্ধ খাবার পানি। পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য শুকনো খাবারের বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, বিষয়টি স্বীকার করে চিলমারী ও উলিপুর উপজেলার দায়িত্ব থাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমরা দুই উপজেলার জন্য ছয়শ’ শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ পেয়েছি, যা বিতরণ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার সবকটি নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে। ফরিদপুরে পদ্মার পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। এ ছাড়া, হঠাৎ করেই আড়িখাল নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী, আমির খাঁ কান্দি, জাজিরা কান্দি, বন্দখোলা, চরভদ্রাসন উপজেলার চরহরিরামপুর, হাজিগঞ্জ এলাকার অনেক বাড়িঘর। গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের ২৩০টি গ্রামের তিন লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেললাইন পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বাদিয়াখালী থেকে ত্রিমোহনী রুটে দ্বিতীয় দিনের মতো ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। জামালপুর দেওয়ানগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী রুটে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মহাসড়ক ডুবে যাওয়ায় ঢাকার সঙ্গে জেলার চার উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অব্যাহত পানি বাড়ায় নতুন করে প্লাবিত হয়েছে জেলার ৭ উপজেলার ৮ লাখ মানুষ। রেললাইনে পানি ওঠায় বন্ধ জামালপুর-সরিষাবাড়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত ট্রেন চলাচল। পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বাড়ায় শেরপুরে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বাড়ায় শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলার ৫ উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেঙে যাওয়া পুরাতন অংশ দিয়ে বন্যার পানি দ্রæতবেগে প্রবেশ করায় চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে পানির উচ্চতা এক মিটার বেড়ে বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় এখনো সাময়িক বন্ধ রয়েছে ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত ৫ দিনে শেরপুরে বন্যার পানিতে ডুবে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানা গেছে। যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। কাজীপুরের মেঘাইয়ে রিং বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পাঁচটি গ্রামের শত শত পরিবার নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে কাজীপুর-ধুনট সড়কে যান চলাচল। বগুড়ার নদীতে পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় তিন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ডুবে যাওয়া বাড়িঘর ফেলে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া বন্যার্তদের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। এসব স্থানে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা, কুতুবপুর, কর্ণিবাড়ি, দেলুয়াবাড়ি, গজারিয়া, বাগবেড়, হাটশেরপুর, কাজলা ইউনিয়নের ময়ূরের চর, কুড়িপাড়া গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক পরিবার গবাদিপশু ও সহায়-সম্বল নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বা স্কুলের কক্ষে ঠাসাঠাসি করে রয়েছেন। কাজলা ইউনিয়নের কুড়িপাড়া গ্রামের কৃষক আইয়ুব আলী, শাহারুল, নজরুল ইসলাম জানান, যমুনা নদীতে তীব্র স্রোতে তাদের ৩০ বিঘা জমির পাটের জাগ ভেসে গেছে। ওই পাট বিক্রি করে এবার কুরবানি ও সন্তানদের কাপড় দেয়ার নিয়ত ছিল। বাড়িঘরে পানি ওঠায় পরিবার-পরিজন নিয়ে আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের গো-খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। এদিকে কালিতলা গ্রোয়েনের উজানে তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের ৩০ মিটার অংশ ধসে যাওয়ায় আশপাশে বসবাসকারী শতাধিক পরিবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, তিন উপজেলার প্রায় ৪৫ কিলোমিটার বাঁধ রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাহার আলী মণ্ডল জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। বন্যা দুর্গতরা যাতে অনাহারে না থাকে সেজন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বন্যা দুর্গতদের জন্য ৩৩৭ টন চাল ও দুই হাজার শুকনা খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শুকনা খাবার (চিড়া-গুড়) কেনার জন্য সারিয়াকান্দিতে পাঁচ লাখ, সোনাতলায় দুই লাখ ও ধুনটে এক লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকায় আগামী ২৪ ঘণ্টা পানি বাড়বে। তবে দেশের উজানে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এ সপ্তাহে স্বাভাবিক হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App