×

জাতীয়

চরম দুর্ভোগে বানভাসিরা ত্রাণের জন্য হাহাকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০১৯, ০২:০১ পিএম

চরম দুর্ভোগে বানভাসিরা ত্রাণের জন্য হাহাকার
কোথাও কোথাও পানি কমতে শুরু করলেও বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। বানভাসিদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিভিন্ন নদনদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে চরাঞ্চলের পানিবন্দি মানুষ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে চরাঞ্চলে আটকে পড়া গবাদিপশু যানবাহনের অভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর খাদ্য সংকট। পানিতে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় গত কয়েক দিন ধরে দুই জেলায় ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানির তোড়ে রাস্তা ভেঙে বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানি ঢুকে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত শিশু ও নারীসহ ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিচে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন গাইবান্ধা : গাইবান্ধা জেলায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। এতে গাইবান্ধা পৌর এলাকাসহ ৪ উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষ এবং বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত বন্যার্ত মানুষেরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। গাইবান্ধা পৌর এলাকায় ২০টি আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে ৪ হাজার বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে গত দু-তিন দিনে সদর উপজেলার খোলাহাটী ইউনিয়নের গোদারহাট এলাকার সোহাগ (৫) বন্যার পানিতে ডুবে ও সাঘাটার কুণ্ডুপাড়ায় উজ্জ্বল কুমার (১৫) সাপের কামড়ে মারা গেছেন। এদিকে গাইবান্ধার ত্রিমোহিনী থেকে বোনারপাড়া স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় রেললাইনের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত অব্যাহত থাকায় লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটে গাইবান্ধার ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন থেকে বোনারপাড়া জংশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ট্রেন যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। গাইবান্ধা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আবুল কাশেম জানান, লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটে গাইবান্ধার ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন থেকে বোনারপাড়া জংশন পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে রেললাইন ডুবে যাওয়ায় বুধবার বেলা ১১টা থেকে ওই রুটে সরাসরি এখন পর্যন্ত সব ধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখন থেকে ডাউন ট্রেনগুলো গাইবান্ধা রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত এবং আপ ট্রেনগুলো বোনারপাড়া পর্যন্ত চলাচল করছে। তবে আন্তঃনগর লালমনি এক্সপ্রেস ও রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন বিকল্পভাবে রংপুর-পার্বতীপুর-সান্তাহার হয়ে ঢাকায় চলাচল করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অপরদিকে গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের কদমের তল থেকে ফকিরপাড়া পর্যন্ত এবং গাইবান্ধা-ফুলছড়ি-সাঘাটা সড়ক, গাইবান্ধা-বালাসীঘাট সড়ক, গাইবান্ধা-বোনারপাড়া সড়ক এখন হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত। ফলে সড়কগুলোতে সব ধরনের যানবাহন ও পথচারীদের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। গাইবান্ধা শহরের পিকে বিশ্বাস রোড, সবুজপাড়া রোড, স্টেশন রোডের কাচারী বাজার থেকে পুরনো জেলখানা পর্যন্ত, ভিএইড রোড, ডেভিড কোম্পানীপাড়ার ২টি সড়ক, মুন্সীপাড়া শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়ক, ব্রিজ রোড কালীবাড়িপাড়া সড়ক, কুটিপাড়া সড়ক, পূর্বপাড়া সড়ক, একোয়াস্টেটপাড়া সড়ক, বানিয়ারজান সড়ক, পুলিশ লাইন সংলগ্ন সড়ক হাঁটু থেকে কোমর পানিতে নিমজ্জিত। গাইবান্ধা শহরের অধিকাংশ বসতবাড়ি-ঘরে হাঁটু থেকে কোমর পানি উঠায় পানিবন্দি মানুষদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এদিকে চরাঞ্চলের পানিবন্দি মানুষদের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে গবাদিপশু যেগুলো চরাঞ্চলে আটকা পড়েছে সেগুলো যানবাহনের অভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। গবাদিপশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী ইউনিয়নের সিংড়িয়া, উদখালী, পূর্ব ছালুয়া, কাঠুর, উড়িয়া ইউনিয়নের রতনপুর ও গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারীতে এ ধরনের অনেক পরিবার এখনো চরাঞ্চলে আটকা পড়ে রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির সংকটেও তারা ভুগছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার শহর সংলগ্ন বেশ কিছু বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধা-সাঘাটা আঞ্চলিক মহাসড়কের ভরতখালী ইউনিয়নের পোড়া গ্রাম এলাকায় ১০০ মিটার বাঁধ ভেঙে গাইবান্ধা-সাঘাটা সড়ক তলিয়ে গেছে । গাইবান্ধার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোছা. রোখছানা বেগম জানান, এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ৪ উপজেলায় জেলা ত্রাণভাণ্ডার থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫৮৫ টন চাল ও ৯ লাখ টাকা এবং ৪ হাজার কার্টন শুকনা খাবার। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সেগুলো বিতরণের কাজ চলছে। গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র এডভোকেট শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবীর মিলন জানান, এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি ত্রাণসামগ্রী পাওয়া যায়নি। তবে এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের কাছে জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ সহায়তার জন্য আবেদন করা হয়েছে। পৌর এলাকার বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত পরিবারগুলোর মধ্যে পৌরসভার মেয়রের পক্ষ থেকে দুবেলা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে তৈরি খাবার খিচুড়ি ও শুকনো খাবার। এ ছাড়াও জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ, স্যালাইনও সরবরাহ করা হচ্ছে। পৌরসভার স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিটি কেন্দ্রে জরুরি ওষুধপত্রসহ বন্যা দুর্গত এলাকায় সার্বক্ষণিক কর্মরত রয়েছেন। পৌরসভার নিজ উদ্যোগে প্রতিটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ, বিশুদ্ধ পানির জন্য নলক‚প স্থাপন করে দেয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করলেও বন্যা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। উলিপুরের অনন্তপুর বাজারের পাশে বাঁধের ভাঙা অংশ, কাঁচকোল সড়ক ও বালাবাড়ি-গাবেরতল সড়ক ভেঙে পানি ঢুকে নতুন নতুন উঁচু এলাকা ও লোকালয় জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে চিলমারী থানা, হাসপাতাল ও উপজেলা পরিষদের কার্যালয়গুলোতেও পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় শুকনো খাবার ও রান্না করার জ্বালানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বন্যার পানিতে নলকূপ তলিয়ে থাকায় মিলছে না বিশুদ্ধ খাবার পানি। টয়লেট ব্যবস্থা না থাকায় বন্যার্তদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী উপজেলা কার্যত এখন পানির নিচে। জেলার সব চরাঞ্চলসহ ৬৪ ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক পরিবারের প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ এখন বানের পানিতে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। এসব এলাকায় নারী শিশু, বয়োবৃদ্ধ ও গবাদিপশু নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করছেন মানুষজন। সরকারি হিসাব মতেই জেলায় প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে তাদের জন্য মাত্র ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ নিয়ে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে বন্যাদুর্গতদের মাঝে। রৌমারী উপজেলার চর বন্দবের ইউনিয়নের বন্দবের গ্রামের সাধু শেখের স্ত্রী ফিরোজা বেগম (৪৫) জানান, বন্যায় খুব দুর্ভোগে আছি। রান্না করার উপায় নেই। ঘরে শুকনো খাবারো নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাঁচার উপায় থাকবে না। খোঁজখবর নিতে কেউ আসে না। কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বন্দবের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবির হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নের ৪৭ হাজার মানুষই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এদের বেশিরভাগ মানুুষ ইউনিয়ন পরিষদসহ উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব মানুষের জন্য সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ১১০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ৯ টন টাল বরাদ্দ পেয়েছি, যা বিতরণ চলছে। রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর রায় বলেন, আমার উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছি। সরেজমিন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার ৯ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকেই যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ১০৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও তিস্তা নদীর পানি কমে বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানির চাপে জেলার রৌমারী, রাজীবপুর, কুড়িগ্রাম সদর, নাগেম্বরী, ভ‚রুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী, চিলমারী ও উলিপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে সড়ক-মহাসড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে তা ঢুকে পড়ছে উঁচু এলাকার গ্রাম ও হাট-বাজারগুলোতে। স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এখন আকাশ ছোঁয়া। জেলার ৯ উপজেলার ৬৪টি ইউনিয়নে ৫০০ গ্রামের প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আর এসব পানিবন্দি মানুষের জন্য বুধবার পর্যন্ত জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫০০ টন চাল ও ৯ লাখ টাকা। জামালপুর : যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বন্যার্তরা সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে গবাদিপশুর খাবার নিয়ে। পানিবন্দি মানুষের অভিযোগ, অনেকেই এখনো কোনো ত্রাণসামগ্রী পাননি। তবে যে ত্রাণ আসছে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আর ত্রাণ বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বৃহস্পতিবার যমুনার পানি বিপদসীমার ১৬৬ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গত বুধবার মাদারগঞ্জ উপজেলার চরনাদাগাড়িতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানের রেললাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেলপথ এবং জামালপুর-তারাকান্দি-বঙ্গবন্ধু সেতু রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। উপজেলা সদরের সঙ্গে আন্তঃইউনিয়নের সব সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ। এ পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে ৪ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে ১৮ হাজার ২০৩ হেক্টর জমির ফসল। বন্যার্তদের চিকিৎসা সহায়তায় গঠন করা হয়েছে ৮০টি মেডিকেল টিম। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় ৪০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যার পানির তোড়ে পুরো জেলার ৪ হাজার ৪১৬টি মৎস্য খামারের ২১ কোটি টাকার অধিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, জেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯টি ইউনিয়ন এবং ৮টি পৌরসভার মধ্যে ৭টি পৌরসভা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পুরো জেলায় ৯০ হাজার ১৩০টি পরিবারের ৪ লাখ ৪৩ হাজার ১৮০ জন পানিবন্দি রয়েছে। এদের একটি অংশ ৩৭টি আশ্রয়কেন্দ্র আশ্রয় নিলেও অধিকাংশ বানভাসি মানুষ বিভিন্ন পাকা সড়ক, ব্রিজ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। এসব বন্যার্তদের মাঝে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গবাদিপশুর খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষের অভিযোগ অনেকেই এখনো কোনো ত্রাণসামগ্রী পাননি। তবে এ বিষয়ে ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম জানান, সরকারিভাবে যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে তা ২৫ ভাগ মানুষে কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। ৭৫ ভাগ মানুষই বঞ্চিত থাকছে। তাই তিনি ত্রাণের পরিমাণ বাড়ানো দাবি জানান। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ পর্যন্ত বন্যার্তদের জন্য ৭৮০ টন চাল এবং নগদ ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। ত্রাণ বরাদ্দের পরিমাণ আরো বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আহমেদ কবির। সিরাজগঞ্জ : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির ফলে যমুনা নদীর পানি বেড়ে সিরাজগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের ৯০০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। এ দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ২৩ সেন্টিমিটার বেড়ে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এ পর্যন্ত কাজীপুর, সদর, বেলকুচি, এনায়েতপুর ও শাহজাদপুর উপজেলার ৯৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ২১ হাজার ৫৫২ পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যা কবলিতদের বিতরণের জন্য ৪৯৪ টন চাল ও ৮ লাখ টাকা মজুদ রাখা হয়েছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পানিবন্দি মানুষ গবাদিপশু আর আসবাপত্র নিয়ে বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে ঝুপড়ি ঘর তুলে রাত যাপন করছেন তারা। এ ছাড়া পানি উঠে পড়ায় সিরাজগঞ্জের কাজিপুর-ধুনট সড়ক দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তলিয়ে গেছে অনেক ফসলি জমি। সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ডিডি) হাবিবুল হক বলেন, জেলার প্রায় ৬ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির পাট, রোপা আমন, আউশ ও সবজির ক্ষেতে পানি উঠেছে। তবে এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, যমুনা নদীর পানির প্রবল স্রোতে কাজীপুর উপজেলা পরিষদের নির্মিত রিং বাঁধের অন্তত ৬০ মিটার এলাকা ধসে নতুন নতুন এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বাঁধটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নয়। এটি কাজীপুর উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই মুহূর্তে সেটি মেরামত করা সম্ভব না। আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এখন পর্যন্ত ঠিক রয়েছে। কোনো সমস্যা নেই। সিলেট : প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি কমতে থাকায় সিলেটে গত কয়েকদিনের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, পিয়াইন নদীর পানি কমা অব্যাহত রয়েছে। বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার নিম্নাঞ্চল থেকে পানি নেমে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে পানি কমে এলেও এখনো দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এসব এলাকার বানভাসিদের। বিশেষ করে দিনমজুর ও কৃষকরা আছেন ভোগান্তিতে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এখনো পাথর কোয়ারি ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় কাজের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। এখন পর্যন্ত ৩টি পাথর কোয়ারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্ধ রাখায় বেকার সময় কাটাচ্ছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। এদিকে বন্যায় আউস, রোপা আমন ও অনেক বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সংকটে আছেন কৃষকরাও। জেলা কৃষি অফিসের সূত্র জানায়, ৩ উপজেলায় ৩ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার হেক্টর জমির ফসল। গবাদিপশুর খাদ্য সংকট ও বিভিন্ন রোগ বালাই ছড়ানোর কারণে বন্যা পরবর্তী খাদ্য সংকটে পড়ার আশঙ্কায় দিন কাটছে লক্ষাধিক মানুষের। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় বাড়ছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। তবে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন বলছে, বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সচেষ্ট রয়েছেন তারা। এখনো বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখা হয়েছে। একাধিক মেডিকেল টিম কাজ করছে, দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে ওষুধ। এ ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। বন্যায় বন্ধ থাকা বিদ্যায়গুলোর বেশিরভাগই খুলে দেয়া হয়েছে, বাকিগুলোতেও পাঠদান শুরু হবে বলে জানায় জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া বন্যায় জেলার ১৫টি স্থানে প্রায় ২৪৫ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা ইতোমধ্যেই মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে পাউবো। লালমনিরহাট : জেলায় তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। গত ৫ দিনে তিস্তা ও ধরলার ভাঙনে ৫ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ভাঙনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিস্তা ও ধরলা পাড়ের হাজার মানুষ। পরিবারগুলো গৃহহীন হয়ে বাঁধের রাস্তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। ১০ কেজি ত্রাণের চাল বা ছোট ছোট বাঁধ না দিয়ে, সেই টাকায় তিস্তা নদী খনন করে এবং স্থানীয় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে চিরস্থায়ী বসবাসের নিশ্চয়তা চান তিস্তাপাড়ের মানুষ। তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা জানান, প্রতি বছর বন্যা আর ভাঙনের কবলে পড়ে দেশের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। বর্ষা এলে জিও ব্যাগ বা বালুর বস্তা ফেলে সরকারি শত কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। মেরামতের নামে অর্থ খরচ করে ছোট ছোট যেসব বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে, তা কয়েক দিনের স্রোতে বিলীন হচ্ছে। আবার কখনো বাঁধের পাশে ভেঙে গিয়ে অকার্যকর হচ্ছে এসব ছোট বাঁধ। কারণ তিস্তা নদীর তলদেশ বালু পড়ে ভরাট হওয়ায় পানিপ্রবাহের রাস্তা না থাকায় প্রতিনিয়ত লোকালয় ভেঙে সম্প্রসারিত হচ্ছে তিস্তা। ভাঙনের কবলে ঘরবাড়ি। ক্লান্তি যেন শেষ হয় না তিস্তা পাড়ের মানুষের। তিস্তার ভাঙনরোধে প্রতি বছর শত কোটি টাকা খরচ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু এতে মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হচ্ছে না, বরং বেড়েই চলেছে। এ ছাড়াও বন্যা ও ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার নামে কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেও তিস্তাপাড়ের মানুষের দুর্ভোগ দূর হচ্ছে না। তাই নদী খনন করে দুই তীরে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ চান তিস্তা পাড়ের মানুষ। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা চণ্ডীমারী গ্রামের আব্দুল মজিদ, মহিয়ার রহমান, মোফাজ্জল হোসেন, রাশেদুল ও সোলেমান আলী বলেন, ভাঙন শুরু হলে বোমা মেশিনে বালু তুলে প্রতি বছর বাঁধ বা বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের ব্যর্থ চেষ্টা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বোমা মেশিনে বালু তোলায় পরক্ষণেই ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ। ১০টি বালুর বস্তা ফেলে ৫০ বস্তার ভাউচার জমা দিয়ে কোটি টাকা লোপাট করছেন তারা। কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। সারা বছরের রোজগারে তৈরি করা বাড়ি বন্যা মৌসুমে তিস্তায় বিলীন হয়ে হাজারো পরিবার পথে বসছে। পুরো বছরের আয় এক মুহূর্তে বিলীন হয়ে মিলছে মাত্র ১০ কেজি চালের ত্রাণ। তাই ত্রাণ নয়, তিস্তা খনন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করার নিশ্চয়তা চান তারা। নেত্রকোনা : জেলায় বন্যায় প্লাবিত এলাকা থেকে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে পানি। তবে প্লাবিত এলাকায় সাড়ে ৪ লাখেরও বেশি গবাদিপশু গরু, ছাগল ও মহিষের তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কাঁচা ঘাসসহ শুকনো খেড় নষ্ট হয়ে গেছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও বারহাট্টায় ৬১ হাজার গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে কৃষকের মজুদ ৪৩ টন শুকনো খড় নষ্ট হয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের কর্মীরা গবাদিপশুর চিকিৎসা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে গো-খাদ্যের সংকট নিরসনে সাহায্যের জন্য জানানো হয়েছে। বন্যার্ত, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোমেশ^রী, কংশ, উব্ধাখালী, ধনুর পানি কমছে। এতে করে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পানিবন্দি ৪ শতাধিক গ্রামে আছেন লক্ষাধিক মানুষ। বানভাসিদের মাঝে প্রশাসন ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করেছে। ধুনট (বগুড়া) : বগুড়ায় যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানিবৃদ্ধির ফলে ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলায় বন্যার পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ধুনট উপজেলায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলায় ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বগুড়া জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, গত শনিবার দুপুরে সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যুমনা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে। গত ৫ দিনে যমুনা নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের যমুনা নদীর চরাঞ্চল এবং নদীর তীরবর্তী এলাকার ১০২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। এ ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে মাত্র ২ হাজার পরিবার। অধিকাংশ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করছে। বিশেষ করে বন্যাদুর্গত পরিবারগুলো গবাদি প্রাণী ও শিশু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। বাঁধে আশ্রিত এবং পানিবন্দি পরিবারগুলোর রান্নার সমস্যার কারণে পর্যাপ্ত শুকনো খাবারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ খাবার পানি, জরুরি মেডিসিন এবং গো-খাদ্যের চরম সংকট রয়েছে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় ৩ উপজেলার ৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলায় প্রায় ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা মূল্যের ২২২টি পুকুরের ৭৪ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এদিকে বুধবার সকালে বন্যার পানিতে ডুবে ধুনট উপজেলার ভূতবাড়ী গ্রামের আব্দুর রহমানের স্ত্রী হাসিনা খাতুন (৫০) মারা গেছেন। এদিকে পানি বৃদ্ধির ফলে যমুনা নদী হিংস্র হয়ে উঠেছে। পানি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে। ৩ উপজেলায় প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। বালু-মাটির তৈরি এই বাঁধের অসংখ্য স্থানে ইঁদুরের গর্ত এবং দুর্বল অংশ দিয়ে পানি চুয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। কয়েকটি স্থানে বাঁধ দেবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবুও বাঁধটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে কোনো মুহূর্তে বাঁধের যে কোনো স্থানে ভেঙে বন্যার পানি লোকালয়ে প্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করলে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের ৬টি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। পুরো বাঁধ সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। বালুর বস্তা এবং জিও ব্যাগ দিয়ে পানি চুয়ানো বন্ধে কাজ শুরু হয়েছে। বগুড়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক রায়হান ইসলাম জানান, ৩ উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের জন্য ৩২২ টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও এক হাজার পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মান্দা (নওগাঁ) : উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে আত্রাই নদীর ডান তীরে উপজেলার কশব ইউনিয়নের চকবালু এলাকায় বাঁধটি ভেঙে যায়। এতে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ক্ষেতের ফসল। বসতবাড়িতে পানি ঢোকায় ঘরের আসবাবপত্র ও মালামাল নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে দুর্গত এলাকার মানুষ। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে উপজেলা সদরের সঙ্গে পূর্বমান্দার সব ধরনের যোগাযোগ। গত কয়েকদিনের একটানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আত্রাই নদীর পানি জোতবাজার পয়েন্টে বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে আত্রাই ও ফকিরনী নদীর উভয়তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম ফারুক হোসেন জানান, এ মুহূর্তে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। দুর্গত এলাকাগুলোতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন। শিগগিরই এ বিষয়ে তথ্য জানা যাবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুশফিকুর রহমান জানান, বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণের প্রস্তুতি চলছে। একই সঙ্গে মোমবাতি, খাবার স্যালাইনসহ অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করা হবে। চিলমারী (কুড়িগ্রাম) : বন্যায় চিলমারী উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন থাকায় গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। টানা বৃষ্টিপাত ও বন্যায় সংরক্ষিত খড় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষত চরাঞ্চলে এ সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। সরেজমিন দেখা যায়, অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে প্লাবিত হয়েছে চিলমারী ইউনিয়নের বৈলমনদিয়ারখাতা, কড়াইবরিশাল, মনতোলা, শাখাহাতি, গাজীরপাড়া, ঢুষমারা অষ্টমীরচর ইউনিয়নের খোর্দ বাশপাতারী, নটারকান্দি, গয়নার পটল, মুদফাৎকালিকাপুর, ডাটিয়ারচর, নয়ারহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ খাউরিয়ারচর, তেলীপাড়া, বজরাদিয়ারখাতা, খেরুয়ারচর, ফেইচকারচর, রমনা ইউনিয়নের পাত্রখাতা, জোড়গাছ, নয়াগ্রাম, উত্তর রমনা, টোনগ্রাম, ডাটিয়া পাড়া, মাঝিপাড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষজন গরু-ছাগল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। এসব এলাকার মানুষজন জানান, ১২ দিন থেকে বন্যার পানিতে সব কিছু ডুবে আছে। গরু-ছাগল নিয়ে তারা বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। এ অবস্থায় গবাদিপশুর খাবার সংকট হওয়ায় তারা বিপদে পড়েছেন। এর ফলে এসব এলাকার অনেকেই তাদের গবাদিপশু স্বল্প মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : গত ২৪ ঘণ্টায় রাজবাড়ী গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া গেজ স্টেশন পয়েন্টে পদ্মার পানি ২৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এদিকে পদ্মার পানি হু হু করে বাড়তে থাকায় নদী তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা ও ফসলি জমি বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। তবে পদ্মার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। রাজবাড়ীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম জানান, পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে ওইসব স্থানে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App