×

সাময়িকী

সৃষ্টির পথে স্বপ্নময় অভিযাত্রী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:৪৩ পিএম

সৃষ্টির পথে স্বপ্নময় অভিযাত্রী

ব্যক্তিগত জীবনে শান্তনু ছিল সদালাপী, বন্ধুবৎসল, প্রবল রসবোধ সম্পন্ন মানুষ। আমাদের দুজনের নাট্যগুরু মিলন চৌধুরীর মতো আসর জমিয়ে রাখার অননুকরণীয় ক্ষমতা ছিল ওর। অতিথিবৎসল শান্তনুর আতিথ্য গ্রহণে বন্ধুরা ছিল উন্মুখ।

সৃষ্টির পথে এক স্বপ্নময় অভিযাত্রী শান্তনু বিশ্বাস। অসময়ে চলে যাওয়া এক সৃজনশীল প্রতিভা। শান্তনুর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৫ সালে নাট্যকার নির্দেশক মিলন চৌধুরীর মাধ্যমে। চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালী থানার মোড়ে সাধুর দোকানের আড্ডায়। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর রাজনীতি যখন প্রায় নিস্তব্ধ, তখন সংস্কৃতিই হয়ে উঠলো প্রতিবাদের প্রধান হাতিয়ার। স্বপন দত্ত, মিলন চৌধুরী ও অন্যদের প্রণোদনায় সি ডি এ ভবনের সামনের আইল্যান্ডে আয়োজন করা হলো ‘পঞ্চ পাণ্ডবের ছড়া পাঠ’। সেখানে ছড়া পড়লেন অজয় দাশগুপ্ত, খালিদ আহসান, শান্তনু বিশ্বাস, মুনির হেলাল এবং আমি। সেই প্রথম শান্তনু বিশ্বাসের কাব্য প্রতিভার সঙ্গে পরিচয়। শান্তনুর একাধিক কবিতা বিভিন্ন সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে সুনীল নাথ সম্পাদিত ‘মফস্বল’ পত্রিকায় প্রকাশিত ওর চমৎকার একটি কবিতার কথা। শান্তনুর গান আসলে পাঠযোগ্য চমৎকার কবিতা। পঁচাত্তরের শেষভাগে মিলন চৌধুরীর নির্দেশে এক সন্ধ্যায় উপস্থিত হলাম হাজারী লেইনের দশ মহাবিদ্যা বাড়ির পাশে এক নির্মীয়মাণ ভবনে। সেখানে চলছিল গণায়নের আত্মপ্রকাশের প্রস্তুতি। মহড়া হচ্ছিল মিলন চৌধুরী রচিত ও নির্দেশিত ‘চর্যাপদের হরিণী’ নাটকের। সেখানে দেখলাম রণজিত রক্ষিত, স্বপ্ন আচার্য, মনোতোষ ধর, শিশির সেন, দেবব্রত দেওয়ানজী প্রমুখের সঙ্গে শান্তনুকে নাটকের নৃত্যাংশের তাল সঙ্গত করছে। বুঝতে পারলাম সঙ্গীতের সঙ্গে শান্তনুর রয়েছে সখ্য। সেই সখ্য যে কতো গভীর তা বুঝতে পারলাম বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক মিলন চৌধুরীর ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’-এর গায়েন চরিত্রের অভিনয়ে। এর কিছুদিন পর শান্তনু সুর করে শোনালো ত্রিবিব দস্তিদারের কবিতা ‘পাথরঘাটার ঘণ্টা বাজে কী হইল কী হইল...’। আমার লেখা দু’একটা গানেও চমৎকার সুর করলো শান্তনু। তার মধ্যে ছড়াগান ‘রাজপুত্তুর রাজকন্যার দেশে যাবে...’ এবং ‘তুমি এসো’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ‘দপ্তরী রাজ দপ্তরে’ নাটকে ওর লেখা ও সুর করা গান ছিল একাধিক। পরবর্তীকালে ‘ইনফরমার’ নাটকের গানগুলো খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। শান্তনুর সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে যে ব্যাপক প্রকাশ, তার প্রস্তুতি পর্ব ছিল সেটা। ছিয়াত্তর সালের জানুয়ারি মাসে রহমতগঞ্জের ‘সি এন্ড বি’ হলে গণায়নের আত্মপ্রকাশ। ‘গফুর-আমিনা সংবাদ’ নাটকে ভাষ্যকারের চরিত্রে শান্তনুর অভিনয় চমকে দিলো সবাইকে। ওর প্রমিত বাংলা উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি হয়ে উঠলো অনুকরণযোগ্য। ‘চর্যাপদের হরিণী’ নাটকে ‘জীবন’, ‘একটি অবাস্তব গল্প’ নাটকে জেলার চরিত্রে ওর দুর্দান্ত অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছে সকলে। এ নাটকগুলোতে আমিও ছিলাম শান্তনুর সহঅভিনেতা। প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ হয়েছি ওর সাথে অভিনয় করে। ছিয়াত্তরে ঘটলো আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ সুচরিত চৌধুরী তাঁর পিতা আসুতোষ চৌধুরী সংগৃহীত লোকগাথা ‘আমিনা সোন্দরী’ মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নিলেন মিলন চৌধুরীর নির্দেশনায়। সেখানে শান্তনু, আমিসহ আরো অনেকে যুক্ত হলাম। এখানে ‘এছাক মিয়া’ চরিত্রে শান্তনুর অভিনয় আরেক মাত্রা পেলো। তাল ও লয় জ্ঞান যে ওর কতো পাকা তা বুঝতে পারলাম আমরা, দেখলো দর্শক। সাতাত্তরে প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসবে অভিনয়ের পর শেষ হলো আমাদের ‘গণায়ন’ পর্ব। ১৯৭৮ সালে মিলনদা, শান্তনু, আমি, ঢালী আল মামুন ও শিমুল বড়ুয়া মিলে গড়ে তুললাম ‘অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট’। একে একে যুক্ত হলো পারভেজ, জ্যোতির্ময়, শেখর দা, প্রদীপ, নান্নু, সাফা, দোদুল, শুভ্রা, লক্ষ্মীদি, নিজাম, অঞ্জু প্রমুখ। মিউনিসিপ্যাল স্কুলের মাঠে ঘেরা দিয়ে অভিনীত হলো ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’ নাটকটি পরপর পাঁচবার শান্তনুর গানে ও সকলের অভিনয়ে মুগ্ধ হলো হাজার হাজার মানুষ। এ বছরই দেখা মিললো নাট্যকার শান্তনু বিশ্বাসের। শান্তনুর প্রথম নাটক ‘কালো গোলাপের দেশ’। অভিনীত হলো ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে সেন্ট স্কলাটিকাস মঞ্চে। শুভ্রার অভিনয়ে অভিষেক হলো। এর অল্প কিছুদিন পর শান্তনু নিয়ে এলো আরেকটি নাটক ‘দপ্তরী রাজ দপ্তরে’। ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ঢোল বাদক একুশে পদকে ভূষিত বিনয়বাঁশী জলাদাস। যায় দিন ফাগুনো দিনের পরে এ নাটকেও শান্তনু আর বিনয়দার যুগলবন্দি অভিভূত করলো দর্শকদের। ছিয়াত্তর থেকে ঊনাশি পর্যন্ত শান্তনুকে পাওয়া গেছে অভিনেতা, গায়ক, নাট্যকার হিসেবে। ১৯৮১তে পেলাম নির্দেশক শান্তনু বিশ্বাসকে। নিজের লেখা ‘নবজন্ম’ নাটকের নির্দেশনা দিলো নিজেই এবং অভিনয়ও করলো কেন্দ্রীয় চরিত্রে। খুলে গেল নতুন দুয়ার। এই নতুন দুয়ার দিয়ে বেরিয়ে শান্তনু গড়ে তুললো নতুন দল ‘কালপুরুষ’।

অভিনেতা শান্তনুর শক্তির পরিচয় আগেই পেয়েছে দর্শক। বিশেষ করে আমার লেখা ও মিলনদার নির্দেশনায় বাজলো রাজার বারোটা’য় ‘রাজা’ চরিত্রে, মহেশ নাটকে ‘জমিদার’ চরিত্রে এবং জুতা আবিষ্কার নাটকের ‘প্রহরী’ চরিত্রে ওর অভিনয় অবিস্মরণীয়। একজন সহঅভিনেতা হিসেবে শান্তনুকে পাওয়া ছিল আমার জীবনে অনন্য প্রাপ্তি। মঞ্চে ওর সঙ্গ আমাকে প্রতিনিয়ত প্রাণিত করতো। কালপুরুষ গঠনের পর ওর প্রাত্যহিক সঙ্গ না পেলেও শিল্পকর্মের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হইনি। এখানেও রচনা করেছে ইনফরমার ও নির্ভার। মাঝে অরিন্দম প্রযোজনা করেছে চ্যাপলিনের জীবন নিয়ে শান্তনুর লেখা ও নির্দেশিত নাটক ‘ভবঘুরে’। উল্লেখ্য যে, নবজন্ম থেকে নির্ভার পর্যন্ত ওর লেখা নাটক ও নিজেই নির্দেশনা দিয়েছে। নাটক রচনায় ওর বহুমুখী ভাবনার পরিচয় মেলে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধ, ভোগবাদী বিশ্বে মানুষের অন্তর্জগতে অভিঘাত- এ সবই শান্তনুর নাটকে উঠে এসেছে। ওর শেষ নাটক ‘নির্ভার’-এ আমরা দেখতে পাই, চাওয়া-পাওয়ার অসম প্রতিযোগিতায় দ্বিধান্বিত মানুষের গল্প। অন্তর্জগতে ক্ষত-বিক্ষত মানুষের মনে প্রশান্তির খোলা হাওয়া দিতে পারে বিশ্বাস ও ভালোবাসা; আর ভালোবাসার হাত ধরেই মানুষ হতে পারে নির্ভার। নির্দেশক শান্তনু ছিল চূড়ান্ত ভালোর প্রত্যাশী। অভিনেতা-অভিনেত্রীর সর্বোচ্চ শক্তিটাকে ও স্পর্শ করতে চাইতো। সেট, লাইট, মিউজিক, অভিনয় নিখুঁত না হলে এর স্বস্তি হতো না। কারণ ও জানতো, এই অতৃপ্তিই শিল্পীকে সফল করে। এক পর্যায়ে শান্তনু দলের দায়িত্ব ওর সহধর্মিণী ও সহযাত্রী শুভ্রাকে দিয়ে গানের জগতে মনোযোগী হলো। গানের প্রচলিত বাণী ও সুরকে ভেঙে নতুন ধারার প্রয়াসী হয়েছে ও। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতকে মিলিয়ে ভালোলাগার দিগন্ত রচনা করতে চেয়েছে শান্তনু। এটা ওর বৈচিত্র্যপিয়াসী মনের পরিচায়ক। গান নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও দলের জন্য গল্পের নাট্যরূপ ও বিদেশি নাটকের অনুবাদে শান্তনু কার্পণ্য করেনি। মৃণালের চিঠি, মাতৃচরিত, প্রার্থী, খোলা হাওয়া তার প্রমাণ। শান্তনুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস ‘প্রসেনিয়াম’। নাটক এবং নাটক বিষয়ক চিন্তাকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে হলে নাট্য পত্রিকার বিকল্প নেই। এ কথাটি শান্তনু জানতো ও বিশ্বাস করতো। তাই লেখা, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির অভাব সত্ত্বেও ও ‘প্রসেনিয়াম’-এর অনেক সংখ্যা প্রকাশ করেছে। নাট্যদলের বাইরেও শান্তনুর প্রশংসনীয় কাজ হলো ফুলকির শিশুদের নিয়ে নাটক নির্মাণ। মোমেন ভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ও এ কাজে ব্যাপৃত হয়েছিল। ক্ষীরের পুতুল এবং রূপসী ও বামন সাতজনা পরিচালনা করেছিল শান্তনু। ব্যক্তিগত জীবনে শান্তনু ছিল সদালাপী, বন্ধুবৎসল, প্রবল রসবোধ সম্পন্ন মানুষ। আমাদের দুজনের নাট্যগুরু মিলন চৌধুরীর মতো আসর জমিয়ে রাখার অননুকরণীয় ক্ষমতা ছিল ওর। অতিথিবৎসল শান্তনুর আতিথ্য গ্রহণে বন্ধুরা ছিল উন্মুখ। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া শান্তনু পারিবারিকভাবেও ছিল অত্যন্ত সফল। স্ত্রী শুভ্রা এবং ওর দুই কন্যা ওকে বন্ধু হিসেবেই পেয়েছে। দীর্ঘ বিরহের পর শান্তনু ফিরেছিল নাটকে অতিসম্প্রতি। গত মাসের ২৮ তারিখে ও অভিনয় করেছিল ‘নির্ভার’ নাটকে। কিন্তু কে জানতো সকলকে চির বিরহের বেদনায় ভাসিয়ে চলে যাবে শান্তনু! কে জানতো ১২ জুলাই হবে শোকের আরেক নাম!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App